অবহেলিতের পোস্টার বয়

‘আমি প্রতিদিন ভোরে আমাদের টিমের বাস ড্রাইভারের কাছে যেতাম আর আমার ব্যাগ তাকে দিতাম। এরপর আমি দৌড়ে স্টেডিয়াম পর্যন্ত যেতাম। বাসও একই সময়ই প্রবেশ করতো। এরপর অনুশীলন শেষে আমার ময়লা কাপড় ড্রাইভারকে দিতাম আর বলতাম তোমার সাথে হোটেলে দেখা হবে। এরপর আমি স্টেডিয়াম থেকে দৌড়ে হোটেলে পৌঁছাতাম। আমি যদি কখনো টিম বাসের পিছনে বসতাম তারা সবাই সামনে বসতো। আমাকে ইচ্ছে করেই একা থাকতে হতো। আমি যদি বাসের পেছনে বসতাম, তারা সেখান থেকে উঠে সামনে গিয়ে বসতো।’ 

এই কথাগুলো দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের প্রথম আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় মাখায়া এনটিনির বেশ কষ্ট আর আক্ষেপ নিয়েই বলেছিলেন  অন্যতম সেরা এই পেসার। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটে এখনকার মতো তখনো কোটা পদ্ধতি ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের জন্য কোটা থাকলেও আফ্রিকান ব্ল্যাকদের জন্য কোনো কোটা ছিল না। ৯০ এর দশকের দিকে সেই নিয়মে কিছুটা পরিবর্তন এলে দলে সুযোগ পান মাখায়া এনটিনি।

এনটিনিকে নিয়ে আলোচনার আগে ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ এবং ‘আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ’ এই দুইটি ব্যাপার নিয়ে একটু বলতে চাই। দক্ষিণ আফ্রিকায় দুই ধরনের কালো মানুষ আছে! হ্যাঁ, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যেও সেখানে জাতের পার্থক্য আছে। সাহারা মরুভূমির দক্ষিণ প্রান্তের বসবাসকারীরা হলেন আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ। আর বাকিরা হলেন সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই পরিচিত। ‘আফ্রিকান ব্ল্যাক’ বা ‘আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ’ শব্দটা মূলত যুক্তরাজ্য থেকেই উৎপত্তি।

এই জাতি ভেদের মারপ্যাচে পড়েছিলেন মাখায়া এনটিনি। আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় তিনি কত লাঞ্ছনা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন হিসেব নেই! টিম হোটেলে একসাথে থাকলেও তাকে কখনোই লাঞ্চ কিংবা ডিনারের জন্য ডাকা হতো না। সতীর্থরা কোনো প্ল্যান করলেও তাকে সেই প্ল্যানে রাখতো না। এমনকি সবকিছু তাঁর সামনেই হতো! তবু তিনি ছিলেন সবকিছু থেকে উপেক্ষিত। তিনি পুরোটা ক্যারিয়ারে চলেছেন একাই।

এনটিনির আক্ষেপটা এক জায়গায়। সবাই একসাথে খেলতো, একই জার্সি পড়তো, সবাই একসাথে একই জাতীয় সংগীত গাইতো। তবু কেন ছিল জাত, বর্ণের ভেদাভেদ।

৬ জুলাই, ১৯৭৭। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপ প্রোভিন্সের এমডিঙ্গি অঞ্চলে জন্ম নেন মাখায়া এনটিনি। শহর থেকে অনেক দূরের এক গ্রামে থাকতেন এনটিনির পরিবার। স্কুলের গন্ডি পেরোনোর আগেই পরিবারের প্রায় সব কাজই তিনি শিখে ফেলেছেন। মাঠে গরু চরানো, ঘাস খাওয়ানো, পানি আনা সবকিছুই করতেন তিনি।

এভাবেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। কোনো রকম সংসার চলার মতোই তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল। এক জোড়া জুতোতে বছর পার করতেন। তাও জুতো পড়তেন শুধু স্কুলে যাবার সময়। যাতে করে লম্বা সময় সেটি ব্যবহার করা যায়।

তবে, শীতকালে বেশ সমস্যা হতো। জুতো ছাড়া ঠাণ্ডায় খালি পায়ে হাঁটাও ছিল বেশ কষ্টের। তাই গরুর গোবরে পা মাড়িয়ে এরপর হাঁটতেন! যাতে করে পা গরম থাকে। এভাবেই আফ্রিকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন এনটিনি।

একবার মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফিরছিলেন এনটিনি। তখন বর্ডার ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট অফিসার রেমন্ড বুই তাঁকে লক্ষ্য করে এমনি এক বল করার জন্য ডাকেন। এনটিনি এতো জোরে বলটি ছোঁড়েন যে রেমন্ড বুইও অবাক হয়ে যান। বুই তখনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন এনটিনির প্রতিভা সম্পর্কে। আর এই বুইয়ের হাত ধরেই এনটিনি জীবন বদলে যায়। গরু চরানো থেকে উঠে এলেন ক্রিকেটের ময়দানে।

ক্রিকেটে উন্নতির জন্য কিং উইলিয়ামস টাউনের ডেল কলেজে এনটিনিকে নিয়ে আসেন বুই। সেখান থেকেই তার ক্রিকেটের পথ চলার শুরু।

১৯৯৪ এবং ১৯৯৫ সালে বর্ডার স্কুলের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেন এনটিনি। সেখান থেকে সুযোগ পেয়ে যান বয়স ভিত্তিক জাতীয় দলে। একই বছর ১৯৯৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি। ইংল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান অ্যালেক স্টুয়ার্টের উইকেট শিকার করেন তিনি।

তাঁর ঠিক দু’বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলে ডাক পান এনটিনি। সবকিছু যেন তার কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। পরিবারকে যখন জানালেন তার ক্রিকেটের অবস্থানের কথা তারা নিজেরাও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তবে সেই সিরিজে কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি তার।

পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পার্থে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন তিনি। প্রথম আফ্রিকান ব্ল্যাক ক্রিকেটার হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলে খেলেন তিনি। তবে এটা কতটুক সত্য সেটা নিয়েও আছে বেশ সংশয়! এনটিনি নিজেও বেশ কয়েকবার এই ব্যাপারে কথা বলেছেন।

এনটিনির আগে হার্শেল গিবস এবং পল অ্যাডামস দক্ষিণ আফ্রিকা দলে খেলেছেন যারা কিনা আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন। সে যাই হোক, অভিষেক ম্যাচেই ১০ ওভারে ৩০ রানের বিনিময়ে ২ উইকেট শিকার করেন এনটিনি।

এনটিনির বোলিং স্টাইল ছিল সাবেক ক্যারিবিয়ান গ্রেট ম্যালকম মার্শালের মতো। এরপর একই বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ক্যাপটাউনে টেস্ট অভিষিক্ত হন তিনি। প্রথম ব্ল্যাক আফ্রিকান টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেকে দুই উইকেট শিকার করেন তিনি। ২০০৩ সালে লর্ডসে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান খেলোয়াড় হিসেবে দশ উইকেট শিকারের কীর্তি গড়েন! তার পেস আর বাউন্সে ইংলিশরা ঘরের মাঠেই ছিল কোণঠাসা।

২০০৫ সালে নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙে এক দুর্ভেদ্য রেকর্ড গড়েন যা আজও টিকে আছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পোর্ট অব স্পেনে ১৩২ রানের বিনিময়ে ১৩ উইকেট শিকার করেন! যা আজও দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট ইতিহাসের সেরা বোলিং পারফরম্যান্স।

২০০৬ সালে ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের সেরা বোলিং পারফরম্যান্স দেখান তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ২২ রানে ৬ উইকেট শিকার করে এক অনন্য রেকর্ড গড়েন তিনি। যা এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকার সেরা বোলিং ফিগার।

এরপর ২০০৭ সালে এনটিনি তার টেস্ট ক্যারিয়ারের ৩০০ তম উইকেট শিকার করেন। নিজের খেলা ৭৪ তম টেস্টে এই কীর্তি গড়েন তিনি। ওই বছর শেষে এনটিনি আইসিসি র‍্যাঙ্কিংয়ে ওয়ানডেতে নবম এবং সব ফরম্যাটে মিলিয়ে বিশ্বের তৃতীয় সেরা বোলার নির্বাচিত হন।

তার অদ্ভুত বোলিং অ্যাকশনের জন্যই তাকে সামলাতে হিমশিম খেতে হতো ব্যাটসম্যানদের। পপিং ক্রিজের একদম শেষ প্রান্ত থেকে আড়াআড়ি ভাবে বল করা এনটিনির পেস আর বাউন্সে খেই হারাতো ব্যাটসম্যানরা। আর সে কারণেই এনটিনিকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘মডিঙ্গি এক্সপ্রেস’ নামে।

এনটিনির ছেলে থান্ডো এনটিনিও একজন পেশাদার ক্রিকেটার। বাবা দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার হলেও থান্ডো এনটিনিকেও বর্ণবাদের শিকার হতে হয়। থান্ডো এনগিডি ২০১৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের সদস্য ছিলেন। সম্প্রতি ঘরোয়া ক্রিকেটে নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স করে এই পেসার স্বপ্ন দেখছেন জাতীয় দলে খেলার।

এনটিনির ক্যারিয়ারে ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৮ সালে এনটিনিকে সম্মান দেখিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ডার ক্রিকেট কমিটি একটি ম্যাচ আয়োজন করে। সেখানে একটি দলের নেতৃত্ব দেন এনটিনি। এনটিনি তার পুরো ক্যারিয়ারে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন। কত লাঞ্ছনা সহ্য করেই তিনি এতদূর এসেছেন। কত চড়াই উৎড়াই পেরিয়েছেন তা শুধু এনটিনিই জানেন।

সব কিছুর জবাব তিনি বল হাতেই দিয়েছেন। আর রেমন্ড বুই তাঁর হাতে যেই বল তুলে দিয়েছেন সেই বল দিয়েই এনটিনি অর্জন করে নিয়েছেন সব সম্মান। এনটিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ নির্বাচিত হন! প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার হিসেবে এই সম্মান তিনি অর্জন করেন।

২০০৩ বিশ্বকাপের সময় ক্যাপটাউনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তুমি একজন তারকা ক্রিকেটার হিসবেই বাড়ি ফিরবে। সবাইকে বলো যে তুমি কোথেকে উঠে এসে একজন তারকা হয়েছ।’

এই নেলসন ম্যান্ডেলাই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রথম আওয়াজ তোলেন এবং দীর্ঘসময় নির্বাসনে থাকার পর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০১০ ফিফা বিশ্বকাপ দক্ষিণ আফ্রিকায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হলিউড তারকা চার্লিস থেরন ও ফুটবল তারকা ডেভিড বেকহ্যামের সাথে মঞ্চে উঠেন মাখায়া এনটিনি। তাঁর জনপ্রিয়তা কোথায় ছিল নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন! দলের সবচেয়ে ঘৃণিত খেলোয়াড়টাই কিনা দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের একজন হলেন।

অ্যালান ডোনাল্ড ও শন পোলকের পর দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ টেস্ট উইকেটশিকারি তিনি। এনটিনি ১০১ টেস্টে ৩৯০ উইকেট শিকার করেছেন। তন্মধ্যে ১৮ বার পাঁচ উইকেট ও চার বার নিয়েছেন দশ উইকেট। ১৭৩ ওয়ানডেতে ২৬৬ উইকেট শিকারের পথে চারবার নিয়েছেন পাঁচ উইকেট।

আর টি-টোয়েন্টিতে ১০ ম্যাচে নিয়েছেন ৬ উইকেট। ২৮৪ আন্তর্জাতিক ম্যাচে এনটিনি নিয়েছেন ৬৬২ উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে ৫২৪ ম্যাচে শিকার করেছেন ১১০২ উইকেট! ৩৩ বার পাঁচ উইকেট আর পাঁচবার শিকার করেছেন পাঁচ উইকেট। পুরো ক্যারিয়ারে ব্যাট হাতে তিনি ২৫৫০ রান করেছেন।

২০১১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান এনটিনি। তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) চেন্নাই সুপার কিংসের হয়েও খেলেছিলেন। ক্রিকেট থেকে অবসরের পর বেশ কিছুদিন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দলে কোচিংয়ের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ক্যারিয়ারের শেষেও বৈষম্য, কোনো ফেয়ারওয়েলই পাননি তিনি।

এত অর্জনের পরও এনটিনি দক্ষিণ আফ্রিকা দলে খুব বেশি সম্মানিত হননি। তিনি নিজেই বলেছিলেন খুব কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে হয়েছে তাঁকে, ‘জিতলে আনন্দ হতো, কিন্তু হারলে প্রথম দোষটা আসতো আমার ঘাড়ে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link