২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। গ্রুপ পর্বে বাজে ভাবে হেরে বিদায় নিয়েছে সৌরভ গাঙ্গুলি, শচীন টেন্ডুললকারদের ভারত দল। ভারতীয় সমর্থকরা অবশ্য দলের এমন হতাশাজনক পারফরম্যান্স মেনে নিতে পারেননি। মহেন্দ্র সিং ধোনির বাড়িতেও উগ্রবাদী সমর্থকরা হামলা করে। প্রায় অনেক ক্রিকেটারের বাড়িতেই হামলার চেষ্টা করে সমর্থকরা।
তখন শচীন টেন্ডুলকার তাঁর দলের এক তরুণ পেসারকে বাড়ির কি অবস্থা জিজ্ঞেস করতেই ওই পেসার বলেন, ‘পাজি, আমার গ্রামে ৮ হাজার লোক বাস করে, আর ওই আট হাজার লোকই আমার জন্য সিকিউরিটি। শচীন হাসলেন এবং বললেন, তাহলে আমাদের সবার উচিত তোমাদের বাড়ি যাওয়া।’
সেই তরুণ পেসারের নাম মুনাফ প্যাটেল। ভারতীয় ক্রিকেটের আক্ষেপ বলতে পারেন! দুর্দান্ত পেস, স্যুইং, ইয়োর্কার কি ছিলো না তার কাছে। নিজের নাম সফলতার চূড়ায় নেওয়ার সবকিছুই ছিলো তার মধ্যে। শুধু ছিলো না ধারাবাহিকতা! শেষ পর্যন্ত ইনজুরিতে তাঁর ক্যারিয়ারটা নিষ্প্রভ থেকেই শেষ হয়ে যায়!
পুরো নাম মুনাফ মুসা প্যাটেল। জন্ম ১২ জুলাই ১৯৮৩। গুজরাতের ইখর অঞ্চলে জন্ম নেন মুনাফ। ছোট্ট একটা গ্রাম! মাত্র ৮ হাজার মানুষের বসবাস। ছোট থেকেই ক্রিকেটের প্রতি বেশ ঝোঁক ছিলো মুনাফের। স্কুলে পড়ার পাশাপাশি সুযোগ পেলেই ক্রিকেট খেলতেন তিনি। তবে পরিবারের সমস্যায় নবম শ্রেণির পরই তাঁকে ক্রিকেট ছাড়তে হয়।
অন্যর জমিতে কাজ করে যা পেতেন সেটা দিয়েই কোনো রকমে সংসার চালাতেন মুনাফ প্যাটেলের বাবা। তাদের বাড়িতে খুব বেশি খাবারের যোগান কখনোই ছিলো না। বছরে একবার নতুন কাপড় জুটলেও জুটতো! নাহলে পুরাতনটা দিয়েই কোনোরকমে চলে যেতো।
এরপর পরিবারের হাল ধরতে ক্রিকেট বাদ দিয়ে কাজে মন দেন মুনাফ। একটা টাইলস ফ্যাক্টরিতে টাইলস প্যাকেট করার কাজ করতেন তিনি। আট ঘন্টার কাজে প্রতিদিন ৩৫ রুপি করে পেতেন। এই কাজের জন্য একবার তাকে স্কুল থেকেও বলা হলো এই বয়সে যদি সে কাজ করে তাহলে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে! তবে ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ভালোবাসাটা মনে মনে পুষে রেখেছিলেন।
শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। কয়েক বছর এভাবে চলার পর প্যাটেল তার গ্রামেরই একজনের সান্নিধ্যে পায়! তাঁর নাম ইউসুফ ভাই। যিনি লোকাল এক ক্লাব চ্যাপালসের হয়ে ক্রিকেট খেলতেন। মুনাফ তখন ইউসুফ ভাইকে অনুনয়-বিনয় করলেন তাকে যেনো বারোদা নিয়ে যায়, যাতে করে তিনি তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়তে পারেন।
সেই ইউসুফ ভাই মুনাফকে শুধু বরোদা নিয়েই যাননি; বরং তাকে এক জোড়া খেলার জুতোও কিনে দিয়েছিলেন! ৪০০ রুপিতে জুতো কিনে দেওয়ার পর ইউসুফ তাঁকে নিয়ে যান একটি ক্রিকেট ক্লাবে। তবে, মুনাফের বাবা এতে মোটেও খুশি ছিলেন না। প্রতিদিন রাতের খাবারের সময় তাঁর বাবা তাকে ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলতেন এবং তাঁর সাথে কাজে হাত দিতে বলতেন। মুনাফ সব শুনে চুপ করে থাকতেন! ছেলের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা দেখে মা তখন বাবাকে বোঝাতেন! যেনো ছেলেকে ক্রিকেট খেলতে দেয়।
ইখর গ্রামের কেউ কেউ তখন কাজের উদ্দেশ্যে আফ্রিকা পাড়ি দিতো। জাম্বিয়া, মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ের মতো দেশগুলোতে কৃষি কাজ কিংবা যেকোনো কাজের জন্যই যেতো তারা। প্যাটেলের একজন চাচাও ছিলো যিনি কিনা আফ্রিকার একটি দেশ জাম্বিয়ায় থাকতেন। তাই মুনাফের বাবাও চাইতেন মুনাফ যেনো আফ্রিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
প্যাটেল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এতে আমার বাবার কোনো দোষ নেই! কারণ ক্রিকেটে এতো সুযোগ আছে, টাকা কামানো যায় সেটা তারা কিভাবেই বা বুঝবে।’
এরপরই অবশ্য প্যাটেলের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়; যখন তিনি বরোদায় সাবেক ভারতীয় উইকেটরক্ষক কিরন মোরের অ্যাকাডেমিতে যান। সেখানে এক ইংলিশ ব্যাটসম্যানের সাথে দেখা হয় মুনাফের। ওই ইংলিশ ব্যাটসম্যানের নাম অবশ্য খোদ মুনাফেরই মনে নেই! বাঁ-হাতি ওই ব্যাটসম্যানকে ৪-৫ টি বাউন্সার দেন মুনাফ। একটা তাঁর গ্লভসে, একটা কাধে আরেকটা বল লাগে হেলমেটে!
ওই ব্যাটসম্যান রেগে গিয়ে মুনাফকে ইংরেজিতে অনেক কিছু বললেও তার কিছুই বুঝতে পারেননি মুনাফ। কারণ মুনাফ ইংরেজী জানতে না। তবে মুনাফ বেশ ভয় পেলেন। এরপর মুনাফ দ্রুত সুইমিং পুলে গিয়ে লাফ দিলেন! আর ভাবলেন নিশ্চয়ই এই ইংলিশ ব্যাটসম্যান তাঁর নামে কোচকে বিচার দিবেন। আর কোচ তাঁকে অ্যাকাডেমি থেকে বের করে দিবেন।
তবে মুনাফের ভাবনার উল্টোটাই ঘটেছিলো! মুনাফের গতি আর অ্যাক্যুরেসি দেখে মুগ্ধ হয়ে যান মোরে। সেখানে কিরন তাকে ভালো ব্র্যান্ডের জুতো কিনে দেন এবং এক পয়সাও নেননি বিনিময়ে। বরোদায় মোরের অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন শুরু করেন মুনাফ। এরপর তাকে এমআরএফ পেস স্কুল চেন্নাইতে পাঠানো হয়! যেখানে সাধারণত কেউই হিন্দিতে কথা বলে না! যেখানে অটো ড্রাইভার মানেই মারামারি! সেই চেন্নাই কিনা পরবর্তীতে মুনাফের জন্য হয়ে উঠলো প্রিয় শহর।
প্যাটেল এমআরএফ ক্রিকেট স্কুলে ৫-৬ মাস ছিলেন। ভালো কাপড় পড়া, কিভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে হয় কিছুই জানতেন না মুনাফ! সাবেক অজি গ্রেট ডেনিস লিলি তখন সেখানে বোলিং কোচের দায়িত্বে ছিলেন। লিলি যখনি সবার উদ্দেশ্যে ইংরেজীতে কিছু বলতেন, তখনি মুনাফ হাঁ করে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন! কি বলছে কোচ? – এই প্রশ্নের পর লিলি সবসময়ই হেসে উঠতেন! এবং কাউকে বলতেন মুনাফকে বিষয়টি হিন্দিতে বুঝিয়ে দিতে।
ওই সময়ে অ্যাকাডেমিতে যুক্ত হন আরেক অজি গ্রেট স্টিভ ওয়াহ। মুনাফ প্যাটেলের বোলিং দেখে তিনিও অবাক হয়ে যান! এবং শচীন টেন্ডুলকারকে মুনাফের কথা বলেন। এরপর মুনাফে মুগ্ধ হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে মুম্বাইর হয়ে খেলার সুযোগ করে দেন শচীন।
মুম্বাইয়ের ক্রিকেটাররা প্রায়ই সবার মতো বিভিন্ন পার্টিতে মুনাফকেও ডাকতেন। কিন্তু মুনাফ কখনোই যেতেন না। একবার দেশের বাইরের এক ট্যুরে মুনাফ একটি ক্লাবে যায়। তিনি ভেবেছিলেন তাঁকে হয়তো অ্যালকোহল পান করতে বলবে! কিন্তু মুনাফের সবচেয়ে কাছে বন্ধু সাবেক ভারতীয় ওপেনার গৌতম গম্ভীর তাকে বলেন, ‘ড্রিংক করার কোনো দরকার নেই। কেউ তোমাকে বাধ্য করবে না।’ সেই থেকে আজ পর্যন্ত কখনো অ্যালকোহল পান করেননি বলেও এক সাক্ষাৎকারে জানান মুনাফ।
পরিবারের পক্ষ থেকে ক্রিকেটের প্রতি যেখানে বিধিনিষেধ ছিলো! সেই গন্ডি টপকে ভারত জাতীয় দলের পেস অ্যাটাকের অন্যতম সদস্য হন মুনাফ। তার লেট স্যুইং, রিভার্স স্যুইং এবং দুর্দান্ত ইয়র্কারের কারণে তিনি ছিলেন অদম্য। গড়ে ৮৭ মাইল/ঘন্টায় তিনি বল করতেন। এমনকি ৯০ মাইল/ঘন্টায় তিনি সর্বোচ্চ গতির বল করেন। যা তাকে ভারতীয় ক্রিকেটে সবচেয়ে গতিময় বোলার হিসেবে তুলে ধরে।
২০০৩ সালে মুম্বাইয়ের হয়ে মুনাফের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয়। নিজ রাজ্যে গুজরাতের হয়ে না খেলেই মুম্বাইর হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট শুরু করেন মুনাফ! তাঁর পেস স্কিলের কারণেই মূলত মুম্বাই তাকে দলে ভেড়ায়। মুনাফের পুরো ক্যারিয়ারই মূলত ইনজুরির কারণে বার বার থমকে যায়। মুনাফ বোলিংয়ে গতি আর অ্যাক্যুরেসি দেখাতে পারলেও ইনজুরি তাঁর ক্যারিয়ারে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো।
এরপর তাঁকে ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার একটি স্পোর্টস প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয় তার বোলিংয়ে আরো উন্নতি করতে। এরপর তিনি ২০০৬ সালে ভারতীয় দলে ফেরেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভারত ‘এ’ দলের হয়ে তিনি খেলেন। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশের হয়েও খেলেন তিনি। সেখানেই তাঁর পেস, অ্যাক্যুরেসি দেখিয়ে নজরকাঁড়েন নির্বাচকদের! আর জায়গা করে নেন জাতীয় দলে।
৯ মার্চ, ২০০৬। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন মুনাফ। অভিষেকেই ৯৭ রানে ৭ উইকেট তুলে নিয়ে নিজেকে জানান দেন এই ডান হাতি পেসার। একই সফরে ৩ এপ্রিল ইংলিশদের বিপক্ষেই ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন তিনি। তার পাঁচ বছর পর ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় মুনাফের। অদ্ভুতভাবেই মুনাফ প্যাটেল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে অভিষিক্ত হন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে!
মুনাফের প্রথম ম্যাচ জয়ী পারফরম্যান্স ছিলো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ডিএলএফ কাপে। সেখানে তিনি ফিল জ্যাকস, মাইকেল ক্লার্ক ও স্টুয়ার্ট ক্লার্ককে আউট করেন। এরপর ২০০৬ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১৮ রানে তিন উইকেট শিকার করেন তিনি! যেখানে ব্যক্তিগত প্রথম ম্যাচ সেরার পুরষ্কার পান মুনাফ।
২০০৭ বিশ্বকাপে মুনাফ ভারতীয় দলের সদস্য ছিলেন! যেখানে প্রথম পর্বেই বাদ পড়ে ভারত। এরপর আবারো ইনজুরিতে দলের বাইরে থাকেন তিনি! তার বদলি সুযোগ পান আরেক পেসার লক্ষ্মীপতি বালাজি। তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাদের মাটিতে হারায় ভারত। ২০০৩ সালের পর প্রথমবার প্রোটিয়া বধ করে ভারত। ওয়াইন পারনেলকে আউট করে ভারতকে ১ রানের জয় এনে দেন মুনাফ।
২০১১ বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়ে তিনি ভারতের হয়ে নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স দেখান। যেখানে তিনি ১১ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী ছিলেন। এবং সেটাই ছিলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর সবশেষ সেরা পারফরম্যান্স। বার বার ইনজুরিতে পড়ায় ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি মুনাফ। তবে দুইবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণ আর ২০১১ বিশ্বকাপ শিরোপা তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) বেশ কয়েক আসরে খেলেছেন তিনি। ২০০৮ সালে আইপিএলের উদ্বোধনী আসরে রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে খেলার সুযোগ হয় তাঁর। যেখানে তিনি তিন আসর খেলেন। পরবর্তীতে তিন আসরের জন্য আবার মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে যান। ছয় আইপিএল আসরের পর ২০১৪ আসরের নিলামে অবিক্রিত ছিলেন মুনাফ! এরপর ২০১৭ সালে গুজরাট লায়ন্সের হয়ে দল পেলেও নিয়মিত খেলার সুযোগ পাননি এই পেসার।
ধারাবাহিকতা একটা আর্ট, যেটা সবাই ধরে রাখতে পারে না। ক্রিকেটে যারা প্রতিনিয়ত ভালো পারফরম্যান্স দেখাবে তারাই সফলতা পাবে এটাই নিয়ম। ধারাবাহিকতাই সাফল্যের একটা বড় রহস্য বলা চলে। মুনাফ প্যাটেল ছাড়াও ভারতীয় দলে ইরফান পাঠান, শ্রীশান্ত, আরপি সিংয়ের মত প্রতিভাবান পেসাররা এলেও কেউই ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারেননি। ইনজুরি আর অধারাবাহিকতায় হারিয়ে গেছেন তারা ব্যর্থতার অতল গহবরে। সেই হারিয়ে যাওয়া দলের আরেকজন হলেন মুনাফ প্যাটেল। ইনজুরি তাঁকে ছুঁতে দেয়নি সফলতার উচ্চ সিঁড়ি।