বোলিং আক্রমণ ও পরিকল্পনাহীনতার দৈন্যতা

টেস্ট ক্রিকেটে যতগুলো চর্চিত সত্য আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘Bowlers win you matches.’ টেস্ট ম্যাচ জিততে হলে সাধারণত ২০ টা উইকেট নিতে হয় এবং অধিকাংশ দিনেই উইকেটগুলো খুব সহজে আসে না, আদায় করে নিতে হয়। উইকেট আদায় করা আবার সময় সাপেক্ষ এবং কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

বোলাররা যেহেতু মেশিন নয়, তাদেরও বিশ্রামের দরকার পড়ে, অধিনায়কের তখন ‘অপশন’ দরকার হয়। কিংবা একজন বোলারের পরিকল্পনা যখন কাজ করে না, অধিনায়ককে তখন ভিন্ন একজন বোলারের দারস্থ হতে হয়।প্রত্যেক বোলারের ভিন্ন ভিন্ন যোগ্যতা, সেই অনুযায়ী খেলায় অধিনায়কও ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

ইনিংসের শুরুতে যারা বল মুভ করাতে পারেন তারা বোলিং করেন, সে অনুযায়ী ফিল্ড সেট আপ হয়। বল পুরোনো হয়ে গেলে, যারা স্ট্যাম্প টু স্ট্যাম্প বোলিং করেন তাঁদের ডেকে নেয়া হয়। স্পিনাররা চ্যানেল বোলিংয়ের মাধ্যমে রান শুকিয়ে দিবেন যেন ব্যাটসম্যান বড় শট খেলতে বাধ্য হয় এবং উইকেট নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। আবার গতির বোলাররা সংক্ষিপ্ত স্পেলে বোলিং করেন, তারা গতির মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করেন।

কোন ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে কোন বোলার বোলিং করবে, বোলিং এর ধরন কেমন হবে সেটিও নির্ধারণ করতে হয়। আপনাকে যদি টেস্ট ম্যাচ জিততে হয়, এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আপনার টেস্ট মেজাজের বোলার লাগবে, পর্যাপ্ত বোলার লাগবে এবং তাদের ব্যবহারের জন্য পাচটা, ছয়টা, সাতটা পরিকল্পনা তৈরি থাকবে।

পর্যাপ্ত বোলারের সংখ্যাটাও চর্চিত হয়ে একধরনের নিশ্চিতই হয়ে আছে। দলে ৫ জন বোলার চাই। বোলার মানে বোলার; গতির বোলারের সাথে কম গতির বোলারের মিশেল থাকতে পারে, পরিস্থিতি অনুযায়ী স্পিনার কিংবা পেসারের সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে।

চেন্নাইয়ের উইকেটে পাঁচজনই স্পিনার হতে পারেন, আবার ওয়েলিংটনের সবুজ উইকেটে ৫ জনই ফাস্ট বোলার খেলতে পারেন (ভিন্ন ধরনের অপশন থাকা ভালো)। যে কোন পরিবেশেই পাঁচ বোলারের বিকল্প নেই। এই ৫ বোলারের যায়গা করে দিতে গিয়ে সাধারণত টীমগুলো ৬ ব্যাটসম্যান, ১ জন প্রকৃত অর্থের অলরাউন্ডার এবং ৪ জন বোলার নিয়ে খেলেন।

প্রকৃত অর্থের অলরাউন্ডার বলার কারণ, ক্রিকেটের ছোট সংস্করণগুলোতে অনেক নামজাদা অলরাউন্ডারের দেখা মিললেও, টেস্টে খুব একটা দেখা যায় না। সাকিব আল হাসান, বেন স্টোকস, রবীন্দ্র জাদেজার পরে অলরাউন্ডারদের নাম খুজতে হতে পারে।

এ কারণে স্টুয়ার্ট ব্রড, কাইল জেমিসন বা মিশেল স্টার্করা আইসিসি এর টেস্ট অলরাউন্ডার র‍্যাঙ্কিংয়ে সেরা দশে চলে আসেন, জেসন হোল্ডার শীর্ষে চলে যান।  যেই দল গুলোর প্রকৃত অলরাউন্ডার থাকে না, তারা একাধিক ব্যাটিং অলরাউন্ডার ব্যবহার করেন অথবা সরাসরি ৬ ব্যাটসম্যান, ৫ বোলার পদ্ধতিতে চলে যান। কিন্তু বোলারের সংখ্যায় ছাড় দেয়া চলে না।

সকল সফল দলই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। টেস্টে ভারতের উত্থানের গল্পটাই খেয়াল করুন, ব্যাটিং কখনোই ভারতের জন্য সমস্যার কারণ ছিলো না। শচীন, শেবাগ, দ্রাবিড়, গাঙ্গুলি, লাক্সম্যান, ব্যাটিংয়ের সবথেকে বড় নামগুলো থাকার পরেও ঠিক সফলতা আসছিলো না ওই বোলিং ব্যর্থতার কারনে। ধোনি এই অবস্থার পরিবর্তন করেন। অশ্বিন ক (অশ্বিন) ছয় নম্বরে ব্যাটিং করিয়ে পাঁচ বোলারের কোটা পূর্ণ করেন, ফলাফল আমরা নিজেরাই দেখেছি।

প্রথমবারের মত ইন্ডিয়া দেশের বাইরেও টেস্টে শক্তিশালী দল হয়ে ওঠে। একাধিকবার বর্ষসেরা টেস্ট দল হওয়া এই পদ্ধতির যৌক্তিকতাই প্রমাণ করে। পরবর্তীতে জাদেজা, পান্ডিয়ারা ৭ নাম্বারে ব্যাটিং করেছেন কিন্তু ৫ বোলারের ধারণা থেকে ইন্ডিয়া বের হয় নি। গত দশ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে তাদের উত্থান তো চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে।

আপনাকে প্রক্রিয়াটিতে ভরসা রাখতে হবে। আপনি যদি কোন খেলোয়াড়ের উপরে ভরসা করতে না পারেন, তাকে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনার নির্ভর‍যোগ্য একজন ব্যাটসম্যান খেলছেন না, এডজাস্ট করার জন্য একজন ফ্ল্যাশি, ফ্ল্যামবয়ান্ট ব্যাটসম্যান বসিয়ে আরেকজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান খেলাতে পারেন। কিন্তু অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান খেলানো সমাধান নয়।

আপনি বরং ওই দুই ব্যাটসম্যানকে জানিয়ে দিচ্ছেন, আমরা তোমার/তোমাদের উপরে ভরসা করি না। তোমরা কেউ এককভাবে দায়িত্ব পালনের যোগ্য না। অমুক নেই তাই তোমরা দুইজনে মিলে তার অভাব পূরণ করবে। আপনি এই দুই ব্যাটসম্যানেরই ক্ষতি করছেন। বরং ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটে একজন অতিরিক্ত বোলার আরো বেশি প্রয়োজন। এখানে ব্যাটিং করা সহজ, উইকেট নেয়াটা কঠিন।

কঠিন কাজটা করার জন্যই অতিরিক্ত একজন বোলার দরকার। এবং আপনার দলে একজন সাকিব আল হাসান থাকার পরেও যদি সর্বমোট বোলারের সংখ্যা হয় ৪, দল নির্বাচনে আপনি মোটেও যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন না। আপনার আট নাম্বারে খেলা ব্যাটসম্যান যদি বোলিং না করেন, আপনি দল নির্বাচনে যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন না। নিশ্চিতভাবেই তাহলে তিনি আট নাম্বারের ব্যাটসম্যান না, আপনি সেই পজিশনটাও নষ্ট করছেন, ওই ব্যাটসম্যানের আসল পজিশনটাও নষ্ট করছেন।

পাঁচ বোলার নিয়ে খেলা কেবলমাত্র বোলিং অপশনকেই সমৃদ্ধ করে না, প্রতিপক্ষকে একটা বার্তাও ছড়িয়ে দেয়, আমরা টেস্টটা জয়ের জন্যই মাঠে নামছি। টেস্ট ক্রিকেটে এই মনস্তাত্ত্বিক লড়াইটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বরং আগের টেস্টেই ছয় ব্যাটসম্যান, পাঁচ বোলার খেলানোর পরের টেস্টেই আট ব্যাটসম্যান, চার বোলার (সাকিবের বদান্যতায়) খেলানো আপনার পরিকল্পনার দৈন্যতাকে প্রকাশ করে। আপনার কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেই, আপনার পরিকল্পনায় আপনারই বিশ্বাস নেই। আপনার খেলোয়াড়দের আপনি নির্দিষ্ট সুযোগ দিতে পারছেন না। খেলোয়াড়দের থেকে সেরাটা আপনি কিভাবে আশা করতে পারেন?

এমন পরিকল্পনাহীন খেলায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়লাভ করা যায়। খেলোয়াড়েরা মাঠে সবটুকু উজাড় করে দিতে পারেন। কিন্তু শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আপনাকে রানের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়তে হবে, তাদের অতিরিক্ত একজন বোলার থাকায় সেই রান তাড়া করাও আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না। ফলে, জয়টা বড়জোড় জিম্বাবুয়ে থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পর্যন্ত যেতে পারে, বাকিরা আপনাকে কোন সুযোগই দিবে না। গত ২১ বছর ধরে অনবরত শিখতে থাকা টেস্ট ক্রিকেটে এই শিক্ষাটা নেয়াও জরুরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link