আমি যখন ক্রিকেট দেখতে শুরু করেছি, তার ঠিক আগে আগে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে দুটো সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে। আর ভালো করে ক্রিকেটটাকে দেখার মতো অবস্থায় যেতে না যেতে আরও দুটো পরিবর্তন হয়ে যায়। যেটা বুঝতে আমার বেশ কিছু বছর সময় লেগেছিল।
১৯৭৫ নাগাদ হবে, কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ বোম্বের ব্র্যাবোর্ণ স্টেডিয়ামে ভারতীয় অনুর্ধ ১৯ দলের ক্যাম্পে যোগ দিয়েছেন। প্রথম দিনের প্র্যাকটিসের শেষে একবাটি ডাল, আলু গোবিটোবি টাইপের সবজির সঙ্গে তিনটে রুটি পেয়েছেন রাতের খাওয়া হিসাবে। হরিয়ানার জাঠ তনয়, আদতে পাকিস্তানের পশ্চিম প্রান্ত যাঁর দেশ, তার ওইটুকু খাবারে কী হবে। কোচ কাম ম্যানেজার কেকি তারাপোরেকে বলতে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘আবার কীসের জন্য খাবার চাই? ওতে পেট ভরে যাওয়া উচিত তো!’
কপিল মিনমিন করে তবু বলেন, ‘আরে আমি ফাস্ট বোলিং করি তো!’ কেকি অম্লান বদনে বলে দেন, ‘ভারতে ফাস্ট বোলিং করে না কেউ!’
আর ১৯৭৮ পাকিস্তান সফরেই ওলটপালট হয়ে যায় এসব, প্রসন্ন আগেই অবসর নিয়েছেন। ১৯৭৯এর ইংল্যন্ড সফরে অবস্থানের পরিবর্তন একবারেই নিশ্চিত হয়ে গেল। অবসর নিলেন চন্দ্রশেখর এবং বিষেন সিং বেদি। আর ওই পাকিস্তান সফরে ফয়সলাবাদে ওপেন করে প্রথম ওভারেই সাদিক মহম্মদের মাথায় বল তুলে ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম কোনও ব্যাটসম্যানকে হেলমেট পরতে বাধ্য করলেন যিনি তাঁর নাম, কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ। স্পিন কেন্দ্রিক আক্রমণের ভারতে দুম করে পাঁচ ফুট ১১র এক রাজধানী এক্সপ্রেস নতুন বল নিয়ে আউট স্যুইং অফকাটে খবরের কাগজের পিছনের পাতার হেডলাইন হতে শুরু করলেন।
আমার প্রথম স্মৃতি কিন্তু কপিলের জন্য খুব একটা গৌরবের নয়, মনে আছে কপিল বল করছেন হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে, জাভেদ মিঁয়াদাদ আর আসিফ ইকবাল ব্যাট করছেন। শেষ দিন, আসিফ ইকবালের শেষ টেস্ট। ইডেন উদ্যান তখন ইডেন উত্তাল আসিফ বোধহয় ১৫ না ১৬ করেছিলেন, মনে নেই। তবে যেটা মনে আছে প্যাভিলিয়ন প্রান্তে কিরমানির কাছে বল যেতেই মিয়াঁদাদ এবং ইকবাল এক রান চুরি করে নিয়ে চলে গেলেন। বেশ দু-তিনবার।
সিরিজটা জিতেছিল ভারত, গাভাস্কারের ব্যাট আর কপিলের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে। স্পিন চতুর্ভূজের কেউ নেই, শিবলাল যাদব, দিলীপ দোশি। রজার বিনির অভিষেক, প্যারাডাইম শিফট হয়েই গেল ওই সিরিজটা থেকে।
আর যেটা বুঝতে পারিনি সেটা হল। ভারতের একমাত্র আন্তর্জাতিক স্তরের ব্যাটসম্যান সুনীল মনোহর গাভাসকার, ঈশ্বরীয় মোড থেকে মাঝারিয়ানা মোডে পরিবর্তিত হয়ে গেছেন এবং ভারতের এক নম্বর ক্রিকেটারের নাম ওই কপিলদেব রামলাল নিখাঞ্জ।
জাম্পকাট করে চলে যেতে হবে ১৯৮১র ডিসেম্বরে মেলবোর্নে। কুঁচকির চোটে প্রথম দিন থেকেই সমস্যায় তিনি। তার উপর সিরিজে প্রথমবারের জন্য ফর্মে থাকা গাভাসকারের এলবিডব্লিউ নিয়ে ঝগড়া। এরই মধ্যে কখন যে অস্ট্রেলিয়া ২-০র দিকে এগিয়ে চলে গেছে।
আগের দিন দোশি একটি উইকেট নিয়েছেন, আর গ্রেগকে পিছন দিয়ে বোল্ড করেছেন কারসন ঘাউড়ি। কিন্তু ২৪/৩ অস্ট্রেলিয়া মনে হয় জিতে যাবে। কপিল বল করার মতো অবস্থায় নেই, একা দোশি আর ঘাউড়ি আর শিবলাল যাদব কী করবেন! সন্দীপ পাতিল যেখানে বোলিং ওপেন করছেন সেখানে অস্ট্রেলিয়ায় কিম হিউজ, বর্ডার ডাগ ওয়াল্টার্স তখনও রয়েছেন। শুরুটা করলেন দোশিই।
কিম হিউজকে বোল্ড করে আর্মারে। কর্টিজেন ইনজেকশন নিয়ে কুঁচকির ব্যথা অগ্রাহ্য করে নেমেছেন কপিল, ৪-৫ ওভার বল করেছেন। রিদম আসতে শুরু করেছে সবে, সানি গিয়ে বললেন কপিলকে রেস্ট নিতে। বারণ করলেন কপিল, উপমহাদেশে কেরিয়ার গড়ে তুলেছেন তিনি, টেস্ট খেলার আগে তিন বছর রঞ্জি চষে বেড়িয়েছেন। দীর্ঘ স্পেলের অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যেই রয়েছে।
চল্লিশে চার থেকে অস্ট্রেলিয়া ৮৩ রানে গুটিয়ে গেল। মাঝে লেন প্যাস্কো শুধু রান আউট হলেন। কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ, হরিয়ানা হারিকেন, টানা সাড়ে ষোলো ওভার বল করে ২৮ রানে তুলে নিলেন, ইয়ার্ডলি, বর্ডার, মার্শ, লিলি আর শেষ ব্যাট হিগসকে। ভারতীয় ক্রিকেটের এক নতুন রূপকথার জন্ম হল। বিদেশের মাটিতে পেস বোলিং-এর উপর নির্ভর করে টেস্ট জিততে পারে ভারত, এই বিশ্বাসের জন্ম হল।
যদিও এর পরে সিরিজ জয় আসতে আসতে আরও চার বছর লাগবে। চেতন শর্মা বলে কপিল দেবের কোচ দেশপ্রেম আজাদের আরেক শিষ্যের আবির্ভাব হবে ধূমকেতুর মতো। তবু ভারতের বোলিং-এ প্রথম দাঁত নখ দেখা দিল।
কিন্তু এই সময়েই একটা মজার পরিবর্তন হল। কপিলদেব বুঝতে পারলেন তাঁর শরীরকে, বুঝলেন ভারতীয় পেস আক্রমণকে প্রায় একার কাঁধে টানতে গেলে তাঁকে দীর্ঘ সময় ধরে ফিট থাকতে হবে। ফলে পেস কমল, ১৪০এও যা উঠত, তা ১৩৫এ এসে স্থিরতা পেল, সঙ্গে যুক্ত হল লেট স্যুইং, সোয়ার্ভ, অফ কাট আরও শানিত হল। আর এক দিনের আন্তর্জাতিকের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা শুরু করলেন। সে পরের গল্প।
তার আগে বারবিসে যাই। বারবিস ব্রিটিশ গায়ানার অ্যালবিয়নে অবস্থিত। একদিনের ক্রিকেটে ভারতের অবস্থা তখন গুড়িগুড়ি পায়ে চলা শিশুর মতো। সাকুল্যে চারটি একদিনের ম্যাচ জিতেছে গত ৯ বছরে। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ! বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত একটাও ম্যাচ হারেনি, প্যাকার সিরিজের ফলে হয়তো তার বাইরে ইদিক ওদিক, কিন্তু তখনও পর্যন্ত সীমিত ওভারের একছত্র সম্রাট তারা।
গ্রীনিজ, হেন্স, রিচার্ডস, লয়েড, গোমস, বাক্কাস, দুজঁ, মার্শাল, রবার্টস, হোল্ডিং, গার্নার, ডেভিস। হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার। এহেন তারকাখচিত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। ভারত প্রথমে ব্যাট করে করল ২৮২, ৪৭ ওভারে। তখন এসব দেখাত না, শুধু শুনেছি। শুনেছি গাভাসকার ৯০ আর চার নম্বরে নেমে কপিল দেব নিখাঞ্জের ৩৮ বলে ৭২।
আসলে নির্মেদ ব্যাটিং মনস্তত্ত্ব ছিল কপিলের। বাঁ আর ডান, উভয় হাতই সাইমন্ডস ব্যাটটাকে লম্বাটে করে ধরত। যাতে দীর্ঘ করতলের সমস্ত চামড়াখন্ডে গ্রিপের রবার ছুঁয়ে থাকে। তারপর বলটা পড়লে বাঁ পাটা এগোত। তারপর কী হত তা জানে শ্যামলাল। দুর্দান্ত ব্যাটফ্লো, তীক্ষ্ণ রিফ্লেক্স এবং সাহসে ভর করে বল বাউন্ডারি ছাড়া পথ পেত না।
আরও পরে ১৯৮৬’র মাদ্রাজের টাই টেস্টে বাকিদের উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসা নিয়ে বকাবকি করে কপিল ব্যাট করতে নামেন এবং নিজে চার ছক্কার ফুলঝুরি ছুটিয়ে সেঞ্চুরি করেন। ফিরে আসতে সহ খেলোয়াড়দের সমবেত হাসির মধ্যে কপিল নিজের পক্ষ রাখেন। তিনি বল ধরে খেলতে জানেন না, পারেন না। বাকিরা তো পারে, তারা কেন বাজে শটে উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসবে। এই বাজে শটে উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসার ফলেই ১৯৮৪’র ৩১ ডিসেম্বরের ইডেন টেস্টে বাদ পড়েন। দীর্ঘ চোট আঘাতহীন টেস্ট জীবনের একমাত্র বাদ পড়া ।
সে থাক, আমরা তো সীমিত ওভারের কথা বলছি। সীমিত ওভারের ব্যাটিং। সেই ব্যাটিং-এর ধরণ নির্ধারণ করার প্রথম ঝলক আমরা দেখলাম বারবিসে। আনতাবড়ি চালানো নয়। নিখাদ সোজা ব্যাটে, পাওয়ার হিটিং-এ ৩টে ছয় আর ৭টা চার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসে প্রথম ধাক্কা হিসাবে গ্রীনিজের উইকেট, সব মিলিয়ে ৩৩এ ২। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে প্রথম আন্তর্জাতিক স্তরের পারফরম্যান্স। ভারতের বিশ্বাস জাগানো পারফরম্যান্স।
এর পরে পরেই বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলতে ভারত যাচ্ছে ইংল্যন্ড। আগের দুই বিশ্বকাপের ছয় ম্যাচে মাত্র একটি জিতেছে তারা, পূর্ব আফ্রিকা অর্থাৎ কেনিয়ার বিপক্ষে। অটেস্টখেলীয় শ্রীলঙ্কার কাছে পর্যন্ত হেরেছে। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেই প্রথম অধিনায়কত্ব পেয়েছেন কপিল। তার আগের পাকিস্তান সফরের সার্বিক ব্যর্থতার মধ্যে একমাত্র কপিল ও মহিন্দার অমরনাথই উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম ছিলেন এবং মহিন্দারের থেকেও কপিল নিয়মিত ছিলেন বলে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সেই একদিনের ম্যাচটিতে বিশ্বাসের পুঁজি গাঁথা হয়েছিল মাঠে আর তারপর ইংল্যন্ডের টানব্রিজ ওয়েলসে এল মোড় ঘোরানো ইনিংস। ভারতীয় ক্রিকেটকে অন্যপথে চালিত করা ইনিংস। নতুন করে আর কী লিখব! বাচ্চা বুড়ো সকলের মুখস্থ। কপিল ব্যাট করতে যখন নামেন তখন ১৭-৫। আজকের জিম্বাবুয়ের সঙ্গে তদানীন্তন টেস্ট দরজায় কড়া নাড়া জিম্বাবুয়ের তরমুজ মুসুরডালের পার্থক্য। স্বাদে এবং আকারে। ইংল্যন্ডে কাউন্টি খেলা তাবড় তাবড় ব্যাট এবং বল।
পিটার রসন, কেভিন কারেন, ইয়ান বুচার্ট। অধিনায়ক ডানকান ফ্লেচারের স্লো মিডিয়াম আর অ্যান্ড্রু ট্রাইকসের অফস্পিন। তারপর কিরমানি, রজার বিনি আর মদনলালকে সঙ্গে নিয়ে কপিল যেটা করলেন তা নটরাজের প্রলয় নাচনের সঙ্গেই একমাত্র তুলনা করা যায়। বিবিসি সম্প্রচার করেনি, রেকর্ড করেনি, কোনও ধর্মঘট ছিল। কোন লাইভ রেকর্ড নেই। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের জনশ্রুতিতে ঢুকে গেছে সেই ইনিংস।
সেই ইনিংস কপিল দেবের একমাত্র সেঞ্চুরি সীমিত ওভারে। ব্যাটিঙটা নাকি মন দিয়ে করেননি। তবু সেই ইনিংসেই আড়মোড়া ভাঙ্গে ভারত নামের ঘুমন্ত দৈত্যের। প্রথম বিশ্বকাপ জয় ফ্লুক অথবা বিশ্বাস অথবা জেদ ছিল। কিন্তু তারও ২৮ বছর পরে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয় বা তার ২৪ বছর পরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বা বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট খেলিয়ে দেশ হয়ে ওঠার ভিত্তি ছিল সেটা, বিশ্বাস প্রোথিত হয়েছিল সেই সময়েই। আর সেই বিশ্বাস যিনি নিজের হাতে করে যত্ন করে পোঁতেন, লালন পালন করেন, জল দেন তিনি তখন মধ্য কুড়ির এক বহ্নিশিখা। চণ্ডীগড়ের তেজীয়ান ঘোড়া, বল্গাহীন প্রাণশ্রোত। কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ।
অথচ ব্যাটিংটায় যথেষ্ট মন দেননি তিনি। পরবর্তীকালে ওয়াসিম আক্রমের মুখে শুনি যে চার সেরা অলরাউণ্ডারের মধ্যে সবথেকে সহজাত ব্যাটসম্যান ছিলেন কপিল। কিন্তু অতগুলো টেস্টে মাত্র ৫০০০ রান এবং সামান্য ৭টি সেঞ্চুরি সেই প্রতিভার প্রকাশ নয়।
মনে পড়ে যায়, বিশ্বকাপ জেতার পর দিল্লীতে প্রথম জনসংবর্ধনায় বিষেন বেদি যখন মাইক কপিলের হাতে দেন, তখন জনতা সোৎসাহে চিৎকার করে ওঠে, ‘হিন্দিমে বোলিয়ে!’ এলিটীয় ভাষা ইংরাজি নয়, হিন্দিমে বোলিয়ে! জনতার ভাষা হিন্দিমে বোলিয়ে। কপিল, ক্রিকেটের প্রথম জনপ্রতিনিধি। বোম্বে, দিল্লী, ম্যাদ্রাসের মহানগর ছেড়ে চণ্ডীগড়ের মাঝারি শহরের প্রতিনিধি তিনি। কপিলের হাত ধরে প্রথম রাজার খেলা ক্রিকেট আম জনতার ঘরে পৌঁছয়। ছেলেরা মাঠে নামে, ক্রিকেটের ব্যাট হাতে জোরে বল মারতে, বল হাতে জোরে বল করতে।
সুনীল গাভাস্কার যদি প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো শেখান, কপিল শেখান আক্রমণের পন্থা। ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সহজাত অ্যাথলিট। ব্যাটিং বোলিং বা ফিল্ডিং যাঁর কাছে সকালে ঘুম থেকে উঠে এক বড় কাঁসার গ্লাসে দুধ খাবার মতোই সহজ।
বিশ্বকাপের পরে আরও কিছু ওলট পালট হল। খোঁচা খাওয়া বাঘ ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে দেশের মাটিতে পরাভূত হয়ে অধিনায়কত্ব ছাড়লেন বটে, কিন্তু একদিনের বোলিঙটা ধীরে ধীরে রপ্ত করতে শুরু করে দিয়েছেন তিনি, অস্ত্রাগারে যোগ করেছেন ইন্স্যুইং, ইয়র্কার। গতি কমলেও, লেট আউটস্যুইং-এর ধার আরও বেড়েছে।
প্রথম তার ঝলক দেখা গেল অস্ট্রেলিয়ায় ভিক্টোরিয়া ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত মিনি ওয়র্ল্ড কাপে। রবি শাস্ত্রী অডি জিতলেও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ব্যাটে বলে অবদান রাখলেন। সেমি ফাইনালে ১৭ ওভারে তিনি ও বেংসরকার ১০৫ রানের পার্টনারশিপ করে জেতান নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। আর ফাইনাল তিন উইকেট। তার মধ্যে কাশিম ওমরকে করা বিষাক্ত ইয়র্কার।
তারপর আবার অধিনায়কত্ব ফেরত পাওয়া। ইংল্যন্ড সফর, অস্ট্রেলিয়া সফর কপিল তখন মধ্য গগনে। কী বোলিং, কী ব্যাটিং! আর ফিল্ডিং তো ছিলই, আজহারউদ্দীনের আগে, কপিল দেবই প্রথম ভারতের আন্তর্জাতিক মানের আউটফিল্ডার। সুললিত ভঙ্গিমায় বাউন্ডারি লাইন থেকে বল উইকেটরক্ষকের হাতে চকিতে ছুঁড়ে দেওয়ার কাঁধের জোর কপিলের আগে ভারত দেখেনি।
সেই বল ছোঁড়ার ভঙ্গিমাতেও নটরাজ খেলা করেন। আর ক্যাচিং! স্লিপ ফিল্ডিং-এ ব্যাটসম্যানদের আধিপত্যে প্রথম থাবা বসান কপিলদেব। বিশ্বনাথের অবসরের পর দ্বিতীয় স্লিপটি নিজের পকেটস্থ করেন বেশ কিছু বছরের জন্য, যদ্দিন না আজহারুদ্দিন নিজের অবস্থিতি জানান দিচ্ছেন।
অথচ অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়। সোজাসাপ্টা মানুষ তিনি। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া তাঁর আসে, ১২৫এর বা ১৮৩র ভারতের বিরুদ্ধদলকে ৮৭ বা ১৪০এ শুইয়ে দেওয়া তাঁর আসে। কিন্তু প্রচণ্ড গতিতে সব পরিকল্পনা তছনছ করে দেওয়া গ্রাহাম গুচের স্যুইপের বিরুদ্ধে প্ল্যান ‘বি’ প্ল্যান ‘সি’ তাঁর ছিল না। তাই ভারতের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক, ইংল্যন্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জেতা অধিনায়ক কপিল দেবের ভারতের সেরা অধিনায়কদের তালিকায় নাম ওঠে না। স্বাভাবিকভাবেই হট ফেভারিট হয়ে ৮৭র বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠতে না পারা অধিনায়ক কপিলের ব্যর্থতায় কলামে টিক লাগিয়ে যাবে।
কোচিং-এর ক্ষেত্রেও এমনই হয়েছিল। ভারতীয় দলের কোচ হিসাবে যে স্বল্প সময় তাতে সাফল্য আসেনি। টেকনিক জানেন তিনি, নতুন বোলারটির হাত সোজা, সিম সোজা, ফলো থ্রু বা অ্যাকশন ঝটকাবিহীন করে আঘাতের সম্ভাবনা কম করা তাঁর পক্ষে সম্ভব। কিন্তু যে কাজ তিনি স্বচ্ছন্দে করতে পারেন সে কাজ যখন অন্যরা বহু চেষ্টা করেও পারেন না, তখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ভুল শুধরানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। প্রতিভাবানরা এমনই হন। তাঁরা সব কাজ নিজে হাতেই করে ফেলেন যেন কিছুই না। কিন্তু কিভাবে করেছেন বলতে গেলে ঘাম ছুটে যায়।
এই যে তিন আঙুলের ডগায় আউট স্যুইং গ্রিপে বলটি ধরে ছুটে আসছেন, প্রথমে নিচু হয়ে, তারপর গতি বাড়িয়ে দুই পা নিতম্বে তালে তালে ছুঁইয়ে তারপর বলটা আর দুটো হাতকে কম্বল মুড়িয়ে যত্নে শিশুকে ঘুম পাড়ানোর মতো করে ঘুরিয়ে নিলেন, তারপর শেষে ছিলাছেঁড়া ধনুকের মতো পিঠটি বাঁকিয়ে লাফ এবং ঠিক কানের পাশ দিয়ে হাত নামিয়ে বাঁহাতের ফলো থ্রু, বাম পায়ের সঠিক সময়ে পিভট করে ঘুরে যাওয়া। শুরুর দিকে পাঞ্জাব ম্যাচে ২২টা নোবল করা বোলারের সারা জীবনে হাতে গোনা নোবল করা, নিজের ব্যাকরণ রচনা করে তা অক্ষরে অক্ষরে মানা। এগুলোকে ব্যাখ্যা করতে গেলে একটাই শব্দ উঠে আসে, ন্যাচরাল, সহজাত!
ডেনিস লিলি এবং মুত্তিয়া মুরলিধরনের মধ্যে একমাত্র বোলার হিসাবে সীমিত ওভার এবং টেস্ট ক্রিকেট উভয় ফরম্যাটেই সর্বাধিক উইকেটের বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী, কনিষ্ঠতম হিসাবে ১০০০ রান এবং ১০০ উইকেটের মালিক তিনি, কনিষ্ঠতম হিসাবে ১০০, ২০০ এবং ৩০০ উইকেট শিকারিও তিনি। একমাত্র ক্রিকেটার হিসাবে ৫০০০ রান এবং ৪০০ উইকেটের ডাবলের অধিকারী কপিল দেব নিখাঞ্জ।
বোলার কপিলদেবের কথা বলতে গেলে পড়ন্ত বেলার দুটো বলের কথা বলতে হয়। সামনে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক অ্যালান বর্ডার, উইকেটের কাছে এসে কপিল বলটি ছাড়লেন তাঁর সুললিত ডেলিভারি অ্যাকশনে, বলটা কোণাকুণি যেতে যেতে ব্যাটের ঠিক কাছাকাছি দিক পরিবর্তন করল, সাধারণ ক্ষেত্রে বলটির চতুর্থ স্টাম্প দিয়ে বেরিয়ে যাবার কথা, কিন্তু দিক পরিবর্তন করল। বর্ডার বুঝে পা নিলেন অফ স্টাম্প বরাবর, কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। ব্যাট নিয়ে আসার আগেই উইকেট ধরাশায়ী।
বিশ্বকাপে একই বল তিনি ডানহাতি ইয়ান বোথামের জন্যও রাখলেন, বা পিটার কারস্টেন। উভয়েই মিডল স্টাম্প বরাবর ব্যাট নিয়ে এসে দেখলেন কোকাবুরা লাইনচ্যুত। অফ স্টাম্প নড়ে গেছে, বেল উড়ে গেছে প্রথম স্লিপের দিকে। আর উইকেটের কাছ থেকেই ইন স্যুইং! জিজ্ঞাসা করুন জিওফ মার্শকে। পা ব্যাটের মধ্যে ফাঁক না রেখেও গলে যাওয়া বল উইকেট নড়িয়ে দিলে অবিশ্বাস ছাড়া কিছু বাকি থাকে না ব্যাটসম্যানের।
আউট স্যুইং তো সহজাত। কট মার্শ বোল্ড লিলির মতো না হলেও কট কিরমানি বোল্ড কপিল কিন্তু আঞ্চলিক উপগাথা লিখেছে বেশ কিছু। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, অধ্যাবসায় এবং সঠিক লাইন ও লেন্থ এবং ফিটনেসের উপর জোর। উপমহাদেশের ক্রিকেটে চোটের জন্য কখনও টেস্ট মিস করেননি কপিল, একবার মাত্র ক্যারিয়ারে অবিবেচকের মতো স্ট্রোক নিয়েছিলেন বলে বাদ পড়েছিলেন ইডেন টেস্টে। ‘নো কপিল, নো টেস্ট’ ধ্বনিতে ছেয়ে গেছিল ইডেন। গাভাসকারের স্ত্রীকে কমলালেবু ছুঁড়েছিল দর্শক। প্রতিবাদে সানি আর খেলেননি ইডেনে।
সে অবশ্য অন্য ইতিহাস। হচ্ছিল কপিলের কথা, উইজডেন পত্রিকা যখন ২০০২এ শতাব্দীর সেরা ক্রিকেটার বাছতে বসে তখন সচিন এবং সুনীল, দুই মুম্বইকারের আগে নাম আসে কপিল দেবেরই। কপিল দেব ভারতীয় ক্রিকেটের এক অধ্যায়ের নাম। একজন মার্চেন্ট গেলে, একজন সুনীল আসবেন। একজন সুনীলের জায়গায় একজন সচিন। সচিনের অবসরের ফাঁক ভরতে চলে আসেন বিরাট কোহলি। কিন্তু কপিলদেবের অবসরের সিকি শতাব্দী পরেও একজন কপিল দেব আসেন না। মাঝে মাঝে ইরফান পাঠান বা হার্দিক পাণ্ড্যাদের নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি, কিন্তু বাস্তবের কপিল কেউ হন না।
তবু কপিল দেবের কারণেই আপামর ক্রিকেট অনুরাগীর মনে বিশ্বাস জাগে, ফলে অ্যাসেম্বলি লাইন প্রোডাকশনের মতো ঘন্টায় ১৪০এ বল করা বোলিং পুল আমরা পেতে থাকি। স্পিনের দেশে একটা কুম্বলে, একটা হরভজন বা অশ্বিন জন্মান, কিন্তু শয়ে শয়ে শ্রীনাথ, বেঙ্কটেশ, জাহির, ইশান্ত, নেহরা, বুম্রাহ, শামি, উমেশরা জন্ম নিতে থাকেন। কপিলই তাঁদের অগ্রগামী মশাল, প্রথম আহ্নিকের অঞ্জলি।
ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে এসে ম্যাচ ফিক্সিং-এর হালকা অভিযোগ, গতি কমে যাবার পরেও খেলা চালিয়ে যাবার অভিযোগ, এগুলো ক্রিকেটে তাঁর অবদানের কথা চিন্তা করলে ভুলে যাওয়াই যায়। কিন্তু ভোলা যায় না আজীবন তাঁর শেখার ইচ্ছা। শেষ ধাপে এসেও তিনি রিভার্স স্যুইং, ইন্স্যুইঙ্গিং ইয়র্কার অথবা স্লোয়ার বল করতে শিখেছেন। সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন। মনোজ প্রভাকরের সঙ্গে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের জন্য একটা জুটি তৈরি করেছেন।
কপিল দেব কোনও তারকা নন।
তিনি অমাবস্যার রাত্রির সমগ্র আকাশ। ঝিকিমিকি তারাদের যিনি বুকে করে সাজিয়ে রাখেন, উপমহাদেশের মাটিতে বছরের পর বছর খেটে যাওয়ার নজির, মেলবোর্নের ৫ উইকেট, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট জয়, ইংল্যন্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ জয়, কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে ফলো অন বাঁচাতে এডি হেমিংসকে পরপর চারটে ছয় অথবা ডোনাল্ড, ম্যাথিউজ, ম্যাকমিলান, শ্যুলজদের পিটিয়ে পোর্ট এলিজাবেথের সেঞ্চুরি তার এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেই আকাশের তারাদের দেখে নীহারিকার মতো কাটিয়ে চলে যান একজন বেঙ্কটেশ প্রসাদ, সুব্রত ব্যানার্জি বা ইরফান পাঠান। আর আকাশের তারাদের দিকে চেয়ে পথ খুঁজে পান শ্রীনাথ, জহির, ইশান্ত বা শামি।
আধুনিক ক্রিকেটের ভারতীয়করণ করেছেন কপিল, ৮৩’র বিশ্বজয়, ভারতের কোণে কোণে যে জনজাগরণের সৃষ্টি করে, তার ফলশ্রুতি ছোট শহর থেকে ধোনি, রায়না, ইরফান, ঋদ্ধিমান বা শ্রীশান্তদের উঠে আসা।
ভারতীয় ক্রিকেটের প্রমিথিউস তিনি। ক্রিকেট দেবতার মন্দির থেকে আগুন নিয়ে এসে প্রথম যিনি সারা ভারতে ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করতে মশাল জ্বালান। আধুনিক ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম পুরুষ কপিল দেব, ভারতীয় ক্রিকেটকে এক সার্বিক রূপ দেবার প্রথম কৃতিত্বের অধিকারী কপিল দেব, চওড়া চোয়াল, কটা চোখ, পুরু গোঁফ আর চওড়া হাসি দিয়ে যিনি আজও রূপকথা লিখে চলেন। আপামর অনুরাগীর মনে, মননে।
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্রাপবুক