কখনো নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়ে রানের জন্য সংগ্রাম করে, আবার কখনো বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে ধুঁকতে থাকা দলকে লড়াইয়ের পুঁজি এনে দিয়েছিলেন লিটন দাস। এরপর বল হাতে তাণ্ডব চালান সাকিব আল হাসান। দু’জনের অনবদ্য পারফরম্যান্সেই সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়েকে ১৫৫ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
আজ ওয়ানডেতে তৃতীয় বারের মত পাঁচ উইকেট শিকার করে দলের জয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি দারুণ এক রেকর্ডও নিজের করে নিয়েছেন সাকিব। ২৭৪ উইকেট শিকার করে সাকিবই এখন ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। আজ পেছনে ফেলেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজার ২৬৯ উইকেট।
লিটন দাস ছাড়াও আজ সাত নম্বরে নেমে শেষের দাবি মিটিয়ে দারুণ এক ইনিংস খেলেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। তবে ব্যাট হাতে ব্যর্থ ছিলেন তামিম ইকবাল ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। তবে উইকেটে থিতু হলেও ইনিংস বড় করতে পারেননি সাকিব আল হাসান, মোহাম্মদ মিঠুন ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
তবে বল হাতে সাকিব দারুণ করলেও ২৭৭ রানের বড় লক্ষ্য তাড়া করতে নামা জিম্বাবুয়েকে প্রথমে চেপে ধরে ছিলেন বাংলাদেশের পেসাররা। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলামের দাপুটে বোলিংয়েই ইনিংসের শুরুতেই চাপে পড়ে জিম্বাবুয়ে।
বড় লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুটাই ভালো হয়নি জিম্বাবুয়ের। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। এই পেসারের গুড লেংথের বল কাট করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান তাদিওয়ানাশে মারুমানি। শূন্য রানে এই ওপেনার বিদায় নেওয়ার এক ওভার পরেই ওয়েসলি মাধেভেরের মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেন তাসকিন আহমেদ।
তাসকিনের একটু ভেতরে ঢোকা বলের লাইনেই যেতে পারেননি এই ওপেনার। ১৭ বলে ৯ রান করে মাধেভেরে ফিরে যাওয়ার পর ১৩ রানে ২ উইকেট হারানো জিম্বাবুয়ের হাল ধরেন ডিয়ন মেয়ার্স ও ব্রেন্ডন টেইলর। সাবলীল ব্যাটিংয়ে চাপ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন দুজন। তবে এই জুটিকে বেশি দূর যেতে দেননি আরেক পেসার শরিফুল ইসলাম।
২৪ বলে ১৮ রান করা মেয়ার্সকে ফিরিয়ে দিয়ে ৩৬ রানের জুটি ভাঙেন শরিফুল। এরপর সাকিব আল হাসান টেইলকে ফিরিয়ে দিলে ৭৮ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে জিম্বাবুয়ে। জিম্বাবুয়ের অধিনায়কের ব্যাট থেকে আসে ৩১ বলে ২৪ রান। রেগিস চাকাভা এক প্রান্তে চেষ্টা করলেও এখান থেকে আর ঘুঁড়ে দাঁড়াতে পারেনি জিম্বাবুয়ে।
সাকিব জোড়া আঘাতে রায়ান বার্ল ও ব্লেসিং মুজারাবানিকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর লুক জঙ্গে রান আউটের ফাঁদে পড়লে ১০৮ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ম্যাচ থেকেই ছিটকে যায় স্বাগতিকরা। এরপর ২৮.৫ ওভারে ১২১ রানে অলআউট হয়ে যায় জিম্বাবুয়ে। চাকাভা করেন দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫৪ রান।
বাংলাদেশের বোলারদের পক্ষে সবচেয়ে সফল ছিলেন সাকিব আল হাসান। ৩৪ রান দিয়ে তিন উইকেট শিকার করেন এই স্পিনার। এছাড়া একটি করে উইকেট পেয়েছেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলাম।
এর আগে টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে শুরুটাই ভালো হয়নি বাংলাদেশের। ইনিংসের প্রথম দুই ওভারে কোন রানই দেননি টেন্ডাই চাতারা ও ব্লেসিং মুজারাবানি। টানা দুই ওভার দারুণ বল করার পর তৃতীয় ওভারের প্রথম বলেই সাফল্য পায় স্বাগতিকরা। মুজারাবানির লাফিয়ে ওঠা বল কাট করতে গিয়ে উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান তামিম ইকবাল।
সাত বল খেলেও রানের খাতা খুলতে পারেননি বাংলাদেশের অধিনায়ক। ওয়ানডেতে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ শূন্য রানে আউট হওয়ার রেকর্ড এখন তামিমের দখলে। ১৯ বার রানের খাতা খুলতে পারেননি এই ওপেনার। ১৮ শূন্য নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন হাবিবুল বাশার সুমন। সব ফরম্যাট মিলিয়েও সর্বোচ্চ ৩৪ বার রানের খাতা খুলতে পারেননি তামিম।
দলীয় ৫ রানে তামিম ফিরে যাওয়ার পর দলের হাল ধরেন লিটন দাস ও সাকিব আল হাসান। লিটন রানের জন্য সংগ্রাম করলেও দারুণ ব্যাট করছিলেন সাকিব। তিন বাউন্ডারিতে কাটিয়ে ছিলেন জড়তাও। কিন্তু অতি আক্রমণাত্মক হতে গিয়েই নিজের উইকেট বিলিয়ে দেন এই অলরাউন্ডার। মুজারাবানির অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরের বল কাট করতে গিয়ে কাভারে ক্যাচ দেন সাকিব।
২৫ বলে ১৯ রান করে সাকিব বিদায় নেওয়ার পর উইকেটে এসে দারুণ শুরু পেয়ে ছিলেন মোহাম্মদ মিথুনও। তবে তিনিও সেই শুরু ধরে রাখতে পারেননি। চাতারার অফ স্ট্যাম্পের বেশ বাইরে করা লেংথ বল খেলতে গিয়ে উইকেটের পিছনে ধরা পড়েন তিনি। বাজে শট খেলে ১৯ বলে ১৯ রান করে ফিরে যান এই ব্যাটসম্যান। মিথুনের বিদায়ের পর সুবিধা করতে পারেননি মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতও।
মিথুনের দেখানো পথেই হাটেন তিনি। রিচার্ড এনগারাভার অফ স্ট্যাম্পের বেশ বাইরের বল জায়গায় দাঁড়িয়ে কাট করতে গিয়ে তিনিও ধরা পড়েন উইকেটের পিছনে। সময়ের দাবি মেটাতে না পেরে ১৫ বলে মাত্র ৫ রান করে মোসাদ্দেক ফিরে গেলে চাপে পড়ে বাংলাদেশ। ৭৪ রানে ৪ উইকেট হারানো বাংলাদেশের হাল ধরেন লিটন দাস ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
পঞ্চম উইকেট জুটিতে দুজন যোগ করেন ৯৩ রান। পঞ্চম উইকেটে ৬৮ বলে এই জুটি পঞ্চাশ করার পর পরের ৩৫ বলে করে ৪৩ রান। ৫২ বলে ৩৩ রান করে মাহমুদউল্লাহ ফিরে গেলে ভাঙে এই জুটি। মাহমুদউল্লাহ ফিরে গেলেও পথ হারাননি লিটন। এই ওপেনার তুলে নেন ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি।
তবে সেঞ্চুরি করার পর আর বেশি দূর যেতে পারেননি লিটন। ১১৪ বলে ১০২ রান করে ফিরে যান এই ব্যাটসম্যান। লিটনের ইনিংসে ছয় না থাকলেও ছিল আটটি চার। লিটন যখন ফিরে যান তখন ৪২ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ২০৯ রান।
লিটন ফিরে যাওয়ার পরেও রানের গতিতে ভাটা পড়তে দেননি আফিফ হোসেন ধ্রুব ও মেহেদী হাসান মিরাজ। সপ্তম উইকেট জুটিতে দুজন যোগ করেন ৫৮ রান। কিন্তু ৪৮ তম ওভারে জোড়া ধাক্কায় লুক জঙ্গে দুজনকেই ফিরিয়ে দিলে শেষের ঝড় তুলতে পারেনি বাংলাদেশ।
আফিফ করেন ৩৫ বলে ৪৫ রান ও মেহেদী হাসান মিরাজের ব্যাট থেকে আসে ২৫ বলে ২৬ রান। শেষের দিকে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের ৮ রানে ভর করে ৫০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ২৭৬ রান সংগ্রহ করে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের পক্ষে জঙ্গে তিনটি উইকেট শিকার করেন। এছাড়া দুটি করে উইকেট পেয়েছেন রিচার্ড এনগারাভা ও মুজারাবানি।
- সংক্ষিপ্ত স্কোর
টস: জিম্বাবুয়ে
বাংলাদেশ: ২৭৬/৯ (ওভার: ৫০; লিটন- ১০২, তামিম- ০, সাকিব- ১৯, মিথুন- ১৯, মোসাদ্দেক- ৫, মাহমুদউল্লাহ- ৩৩, আফিফ- ৪৫, মিরাজ- ২৬, সাইফউদ্দিন- ৮) (জঙ্গে- ৯-০-৫১-৩, মুজারাবানি- ১০-২-৪৭-২, রিচার্ড- ১০-১-৬১-২)
জিম্বাবুয়ে: ১২১/১০ (ওভার: ২৮.৫; মাধেভেরে- ৯, টেইলর- ২৪, মেয়ার্স- ১৮, চাকাভা- ৫৪) (সাকিব- ৯.৫-৩-৩০-৫, সাইফউদ্দিন- ৪-০-২৩-১, শরিফুল- ৬-০-২৮-১, তাসকিন- ৫-০-২২-১)
ফলাফল: বাংলাদেশ ১৫৫ রানে জয়ী।