একটা চিঠির গল্প বলি। চিঠিটা পেয়েছিলাম আমার ক্লাব রিয়েল মাদ্রিদ এর কাছ থেকে। পড়িনি। পড়ার আগেই ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।
চিঠিটা কবে পেয়েছিলাম, জানেন? ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালের দিন। ঠিক সকাল ১১ টায়। ট্রেইনারের টেবিলে বসে আছি। পায়ে ইঞ্জেকশন নিতে হবে। কোয়ার্টারফাইনাল ম্যাচে আমার উরুর পেশী ছিঁড়ে গিয়েছিলো। পেইন কিলার নিলে অবশ্য কোন সমস্যা হচ্ছিলো না। সমস্যা হবে কিভাবে, সমস্যা তো হয় ব্যাথা করলে। পেইনকিলার নিলে ব্যাথাটা দমে যাচ্ছিলো।
আমার ট্রেইনারকে বলেছিলাম, ‘যদি মরে যাই, মরে যেতে দেবেন। তাতে আমার কিসসু যায় আসেনা। শুধু খেলতে চাই। আমি শুধু খেলতে চাই।’ ঠিক এগুলোই বলেছিলাম।
টেবিলে বসে পায়ে বরফ ঘষছি। এইসময় রুমে এলেন আমাদের দলের চিকিৎসক ড্যানিয়েল মার্টিনেজ। হাতে একটা খাম। উনি বললেন, ‘অ্যাঞ্জেল, এটা রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এসেছে।’
মানে কি?
‘ওরা বলছে, খেলার মতো কন্ডিশন এখন তোমার নেই। তোমাকে যাতে আমরা না খেলাই, জোর করছে ।’
বুঝতে পারছিলাম কি হচ্ছে আশপাশে। বাজারে জোর গুজব রিয়াল মাদ্রিদ বিশ্বকাপের পর জেমস রদ্রিগুয়েজ কে সাইন করাতে চাচ্ছে। আমি জানি ওকে আনতে হলে আমাকে বিক্রি করবে রিয়াল। আমার জায়গাটাতো খালি করতে হবে খেলার জন্যে। বিক্রির পণ্যটাকে ওরা নষ্ট করতে চাচ্ছেনা। সহজ হিসেব। ফুটবল যে একটা ব্যাবসা, সেই ব্যাবসায়িক দিকটি আমজনতা কখনো দেখতে পায়না। কিংবা দেখতে দেয়া হয়না।
ড্যানিয়েলকে বললাম চিঠিটা দিতে। হাতে পেয়েই কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেললাম। পড়ারও প্রয়োজন বোধ করিনি। ওকেই আবার ছেঁড়া টুকরো গুলো দিয়ে বললাম, ‘ফেলে দাও। আজ সব সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা শুধু আমার।’
ম্যাচের আগের রাতে আমার এক ফোঁটা ঘুম হয়নি। এর একটা কারণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের হোটেলের বাইরে ব্রাজিলিয়ান ফ্যানরা সারাটা রাত আতশবাজি ফুটিয়েছে। শব্দ ছিলো মারাত্মক। ঠিক জানিনা, শব্দ যদি নাও থাকতো ,ঘুমুতে পারতাম কিনা। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের রাত,সারাটা জীবন যার স্বপ্ন দেখেছি সেই স্বপ্নটা যখন এত কাছে… এই অনুভূতিটা কোনভাবেই আমি বুঝিয়ে বলতে পারবোনা।
ফাইনালে আমি সত্যি সত্যি খেলতে চেয়েছিলাম। তাতে যদি আমার ক্যারিয়ার শেষও হয়ে যেতো, আপত্তি ছিলোনা। সেই সাথে আমি আমার দলের জন্যে কোন জটিল পরিস্থিতিও তৈরী করতে চাইনি। একদম ভোরে বিছানা ছেড়ে গেলাম ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে। সাবেলা। আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক। খুব কাছের মানুষ আমরা বলতে পারেন। তাঁকে যদি আমি বলতাম শুরু থেকেই খেলতে চাই, লোকটার উপর খুব চাপ হয়ে যেতো। আমাকে খেলানোর জন্যে তাঁর মনে একটা চিন্তা কাজ করতো। সেরকম কিছু করিনি। ওকে গিয়ে আমি আমার বুকে হাত রেখে বলেছি, তোমার যাকে খেলালে ভালো মনে হয়,তাকেই খেলাবে।
বললাম, ‘যদি আমাকে বসাতে হয়, তাও সই। যদি অন্য কাউকে বসাতে হয় তাহলে সেই অন্য কেউই। আমি শুধু বিশ্বকাপটা জিততে চাই। আমাকে যদি নামাও, মরে যাবার আগ পর্যন্ত খেলবো।’
কেন যেন কেঁদে ফেললাম। কোনভাবেই জলটা আটকাতে পারলাম না। সেই সময়টা হয়তো জানে কেন কেঁদেছি।
ম্যাচের আগে যখন টিম টক হয়, তখন সাবেলা ঘোষনা দিলেন আমার জায়গায় এনজো পেরেজ শুরু করবে। কারন এনজো একেবারে ফিট। কোন সমস্যা নেই। শুনে আমার খারাপ লাগেনি। শান্তিই লাগলো। কোচ তার সেরাদের দিয়ে খেলাবেন। ম্যাচ শুরুর আগে পায়ে আবার ইনজেকশন নিয়ে নিলাম। খেলার দ্বিতীয়ার্ধেও নিয়েছি যাতে কোচ ডাকলেই নামতে পারি মাঠে।
সেই ডাকটা আমার আর আসেনি। হেরে গেলাম। কোনকিছুই আমার কোনরকম নিয়ন্ত্রনে ছিলোনা। আমার জীবনের খুব কঠিন রাতগুলোর একটা। ম্যাচ শেষে মিডিয়া আমার না খেলা নিয়ে যা টা বলতে লাগলো। আমি সত্য কথা বলছি, একটা বিন্দু মিথ্যা কথা বলছি না। বিশ্বাস করুন।
সাবেলার সামনে গিয়ে যে কেঁদে ফেললাম, ও কি আমাকে নার্ভাস ভেবেছিলো? এই ভাবনাটা আমাকে তাড়া করে ফেরে।
বিশ্বাস করুন, ঐ সময়ের ঘটনাটার সাথে নার্ভের কোন সম্পর্ক নেই। আবেগে আমি আটকে ছিলাম। মুহুর্তটা কত দামী, কত সাধনার! প্রায় অসম্ভব একটা স্বপ্নের কত কাছে তখন আমরা।
আমি ছেলেবেলায় যে বাড়িতে থেকেছি ঐ বাড়ির দেয়ালের রঙ কোন একসময় সাদা ছিলো। কবে যে সাদা ছিলো আমার মনে নেই। প্রথম যে রঙটা খেয়াল আছে, বিবর্ণ ধূসর। কয়লার গুঁড়োতে আস্তে আস্তে আমাদের দেয়ালগুলো কালো হয়ে গেলো।
আমার বাবা কয়লা নিয়ে কাজ করতেন। মাইনে যে কাজ করে ওরকম না। বাবা আসলে চারকোল বানাতেন। কাজ করতেন আমাদের বাড়ির পেছন দিকটায়। চারকোল কিভাবে বানানো হয় দেখেছেন কখনো? বার্বিকিউ করার জন্যে দোকান থেকে যে চারকোল কেনেন, ওগুলোর কথা বলছি। দোকানে যত সুন্দরই দেখাক, বানানোর প্রক্রিয়াটা কিন্তু খুবই নোংরা। বাবা এই নোংরা কাজটাই করতেন বাড়ির পেছনের চাতালে । চারকোল বানানোর পর ছোট ছোট চারকোল ব্যাগে ভরে বাজারে বিক্রি করতেন। আসলে শুধু বাবা ই নন, তাঁর সাথে ছোট ছোট দুজন হেল্পার ছিলো। আমি আর আমার বোন।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাবার কাজে সাহাজ্য করতাম। কাজটা কি? চারকোল ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে গোছানো। মজাই লাগতো আসলে কাজটা। ঠিক কাজ মনে হতোনা। আমাদের বয়স তখন কত হবে,নয় দশ। কাজটাজ করে যেতাম স্কুলে। কয়লার ট্রাক এলে চারকোলের ব্যাগগুলো কাঁধে করে লিভিং রুমের ভেতর দিয়ে সামনের দরজা দিয়ে বের হতাম। তারপর বাবা ব্যাগ ট্রাকে উঠাতেন। এই চারকোলের ব্যাগ টানাটানিতেই আমাদের বাড়িটার দেয়ালের রঙ হয়ে গিয়েছিলো কালো।
কাজ যত নোংরাই হোক, এ দিয়েই আমাদের টেবিলে খাবার জুটতো। এই কজ করেই বাবা বাড়িটাকে ব্যাংকের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন।
আমাদের অবস্থা এরকম ছিলোনা। বাবা খুব ভালো মানুষ। একজনের ভালো করতে গিয়ে বেচারা ওইরকম একটা গাড্ডায় পড়ে গিয়েছিলেন। এক বন্ধু তার বাড়ির গ্যারান্টর হতে বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন। বাবা মানুষকে খুব বিশ্বাস করতেন। ব্যাংকের দেনা জমা হয়ে গেলো অনেক এবং সেই বন্ধু একদিন স্রেফ হাওয়া হয়ে গেলো। ব্যাংক তো সোজা পেয়ে বসলো বাবাকে। বেচারা দুদুটো বাড়ির দেনা শোধ করতে শুরু করলেন। আর কিছু করারও ছিলোনা। নিজের পরিবার তো আছেই, তার উপর দু দুটো বাড়ির দেনা! অনেক অনেক চাপ ছিলো মানুষটার উপর।
বাবা একেবারে শুরুতে চারকোলের ব্যাবসা করতেন না। আমাদের বাড়ির সামনের রুমটাকে একটা ছোট্ট দোকানমতো বানিয়েছিলেন। ব্লিচ, ক্লোরিন,সাবান ইত্যাদি পরিস্কার করার জিনিষপত্র ড্রামে করে কিনে ছোট ছোট বোতলে ভরে বিক্রি করতেন। ভালোই ছিলো বিক্রিবাট্টা। আমাদের শহরে লোকজন পরিস্কার করার সিআইএফ কিনতে একেবারে ব্র্যান্ড ব্যাবহার করছে, সেরকমটা ভাবা কঠিন। খুব বেশি খরচসাপেক্ষ হয় গোটা ব্যাপারটা। আমাদের দোকানে এলেই হতো। খুব সস্তায় এক বোতল ডি মারিয়া, ব্যাস কাজ সারা।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো। একদিন তাদের ছোট ছেলে ব্যাবসায় বাগড়া বাধিয়ে দিলো। আসলে মরতেই বসেছিলো ছেলেটা।
হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন। আমিই সেই শয়তান।
ঠিক শয়তান বলাটাও ঠিক হচ্ছেনা। আমার আসলে খুব এনার্জি ছিলো। একেবারে হাইপার অ্যাকটিভ বাচ্চা যাকে বলে। সেই একদিন মা দোকানে সাবান বিক্রি করছিলেন আর আমি ওয়াকারে করে বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাড়ির সামনের দরজাটা খোলাই ছিলো। খোলা না থাকার কোন কারন নেই, কাষ্টমারেরা ও পথেই আসতো দোকানে। বিক্রি নিয়ে মা ব্যস্ত ছিলেন আর আমি এই ফাঁকে সোজা বাইরে…ঘুরে দেখতে চাচ্ছিলাম বাইরেটা!
হাঁটতে হাঁটতে সোজা রাস্তার মাঝখানে। মা রীতিমতো স্প্রিন্ট দৌড়ে গাড়ি চাপার হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। মা খুব নাটক করে বলে ঘটনাটা। ডি মারিয়া ক্লিনিং শপের ওদিনই শেষ দিন। মা বাবাকে বললেন, এভাবে হবেনা। বাচ্চাকাচ্চা সব মরে শুটকি হয়ে যাবে। আমাদের অন্যকিছু করতে হবে।
এরপরেই সেই কয়লা ওয়ালার সাথে বাবার দেখা। ভদ্রলোক সান্তিয়াগো দেল এস্ত্রো থেকে ট্রাকে করে কয়লা আনতেন। মজাটা হচ্ছে গোটা এক ট্রাক কয়লা কেনার সামর্থ্য বাবার ছিলোনা। বহু অনুরোধ করার পর ভদ্রলোক আমাদের প্রথম কয়েকটা শিপমেন্ট বাকীতে দিতে রাজি হন। প্রতিবারই এসে আগের ট্রাকের টাকা নিয়ে পরের ট্রাক কয়লা দিতো মানুষটা। দুটো বাড়ি, পরিবারের মানুষগুলো…ভরণপোষণ…সব মিলিয়ে খুব ঝামেলা…। বাবার কাছে ক্যান্ডি বা এরকম কিছু চাইলে বাবা বলতেন, “দু দু্টো বাড়ি আর এক ট্রাক কয়লার দাম দিতে হবে বাবা। পরে দেবোনে”।
এই কথাগুলো বলা বাবার একেবারে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো।
এক দিনের কথা মাথায় একেবারে গেঁথে আছে। আমার জীবন বদলে যাবার দিনটা। বাবার সাথে ব্যাগের ভেতর চারকোল ঢুকাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, বৃষ্টি হচ্ছে। মাথার উপর টিনের চাল। কঠিন বৃষ্টি। ঘন্টা কয়েক পরেই আমি স্কুলে যাবো। ওখানে বেশ গরম, বাঁচোয়া। বাবাকে এই ঠান্ডায়, মাথার উপর বৃষ্টি নিয়ে কাজ করতে হবে সারাটা দিন। যদি চারকোল বিক্রি না হয়, আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে।
মাথার ভেতর ভাবনা এলো। নিজেকেই বলা শুরু করলাম, এই অবস্থাটা বদলানো দরকার। খুব দরকার। এজন্যে আমি ফুটবলের কাছে কৃতজ্ঞ।
মাঝে মাঝে অবশ্য জীবনের দামে দেনা চুকোতে হয়। ফুটবল শুরু করেছিলাম খুব অল্প বয়সে। দুষ্টুমি করে মায়ের মাথা খেয়ে ফেলতাম আমি। তাই মা আমাকে একদিন নিয়ে গেলেন ডাক্তারে কাছে। ডাক্তারকে বললেন, ‘ডাক্তার, আমার ছেলেটা খালি দৌড়য়। একটা মুহূর্তের জন্যে চুপ করে কোথাও বসতে পারেনা। কি করি বলুনতো!’
ডাক্তার খুব ভালো লোক। আর্জেন্টিনার মানুষ। আর্জেন্টাইন হলে যা হয়, উনি বললেন, ‘সারাদিন ছুটোছুটি করে কি করো? ফুটবল খেলো?’
এভাবেই শুরু হলো আমার ফুটবল খেলা।
ফুটবল নিয়ে আমি ঘোরগ্রস্থ মানুষ বলতে পারেন। সেই শুরু থেকেই। আমি শুধু ফুটবলই খেলেছি। প্রতি দু মাস অন্তর অন্তর আক্ষরিক অর্থেই আমার বুটের তলা ভেঙে যেতো, খেলতাম এতো বেশি। মা শেষে আঠা দিয়ে ঠিক করতেন বুটের তলা। দুমাস পরপর নতুন একজোড়া বুট কেনার টাকা আমাদের ছিলোনা। সাত বছর বয়স যখন ,পাড়ার দলের হয়ে ৬৩ টা গোল করে ফেলেছি। ভালোই খেলতাম মনে হচ্ছে এখন। তো একদিন আমার বেডরুমে মা এসে বললেন, ‘রেডিও চ্যানেল তোর সাথে কথা বলতে চায়।’
স্টেশনে গেলাম ইন্টারভিউ দেয়ার জন্যে। খুব লাজুক ছিলাম ঐ বয়সটায়, মুখ দিয়ে দুএকটার বেশি শব্দই বেরোয়নি।
ওই বছরেই বাবার কাছে ফোন এলো। রোজারিও সেন্ট্রালের ইয়ুথ টীমের কোচ আমাকে দলে নিতে চান। খুব কজার একটা পরিস্থিতি, জানেন! আমার বাবা হচ্ছেন নিওয়েল ওল্ড বয়েজ এর বিরাট সমর্থক। আর আমার মা রোজারিও সেন্ট্রালের পাঁড় ভক্ত। রোজারিওতে না থাকলে আসলে এই দুটো দলের সমর্থকদের মধ্যকার খুব আবেগের রাইভালরিটা ঠিক বুঝবেন না। একেবারে দুই মেরু বলতে পারেন। জীবন মরন টাইপ আরকি। দুইদলের মধ্যকার খেলা হলে আমার বাবা মা একেবারে তাদের সবটুকু দিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেন। অবশ্যই নিজের দলের গোলের সময় আর কি।
যে জেতে তার কথার চোটে আরেকজন মনে করেন গোটা সপ্তাহ একেবারে কেঁচো হয়ে থাকতে হয়। খুবই কঠিন অবস্থা।
তো বুঝতেই পারছেন সেন্ট্রাল থেকে কল আসায় মায়ের অবস্থাটা। একেবারে উত্তেজনার শেষ সীমায়।
বাবা বললেন, ‘বুঝতে পারছিনা আসলে। অনেক দূর তো এখান থেকে। নয় কিলো! আমাদের তো গাড়ি নেই। ওকে আনা নেয়া করবো কিভাবে?’
মা বললেন, ‘আরে এইটা কোন ব্যাপার? চিন্তা করোনা, আমি নিয়ে যাবো।’
জন্ম হলো আমাদের গ্রাসিয়েলার।
গ্রাসিয়েলা আমাদের পুরোনো জংধরা সাইকেলের নাম। হলুদ রঙের। ঐ সাইকেলে চড়িয়েই আমার মা আমাকে প্রতিদিন ট্রেনিং এ নিয়ে যেতেন। সাইকেলের সামনে একটা ছোট্ট ঝুড়ি আর পেছনে আরেকজন বসার জন্যে একটু জায়গা। এই নিয়ে আমাদের গ্রাসিয়েলা। একটা ছোট্ট সমস্যা তখনো ছিলো, আমাদের সাথে তো আমার বোনটাও যাবে। কিন্তু বসবে কি করে? বাবা তখন বুদ্ধি করে সাইকেলের পাশে কাঠের একটা পিঁড়ি জুড়ে দিলেন। ওখানে বসতো বোন।
একজন মা ছোট্ট একটা ছেলেকে সাইকেলের পিছনে আর ছোট্ট একটা মেয়েকে পাশে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। সাইকেলের সামনের ঝুড়িতে কিটব্যাগ, বুট আর কিছু স্ন্যাকস। আসা যাওয়া…ভয়াবহ সব এলাকা…ঝড়ের মধ্যে, বৃষ্টিতে কিংবা তীব্র ঠাণ্ডায়, আলো কিংবা অন্ধকারে। পরিবেশ কি তাতে মায়ের কিচ্ছু যায় আসেনা। মা সাইকেল চালাচ্ছে…কল্পনা করুনতো একবার দৃশ্যটা!
গ্রাসিয়েলা আমাদের নিয়ে যেতো সবখানে। যেখানে যেতে চেয়েছি, সবখানে। আমাদের ছোট্ট গ্রেসিয়েলা!
সেন্ট্রালে আমার সময়টা ছিলো খুব কঠিন। মা না থাকলে ফুটবল খেলাটা ছেড়েই দিতাম। দুবা এরকম পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিলো। আমার বয়স তখন ১৫। শরীরটা ঠিকঠাক বাড়েনি। শুটকাপটকা ধরনের শরীর আমার। আমাদের কোচ ছিলেন একটু অ্যাগ্রেসিভ ধরনের। শরীর দিয়ে খুব এগ্রেসিভ হয়ে খেলে এরকম খেলোয়াড়দের বেশি পছন্দ করতেন। আমিতো ওরকম না, ছিলামও না, এখনও নই। তো একদিন কি হলো, ডি বক্সের ভেতরে একটা হেড করতে ঠিকঠাক লাফিয়ে উঠতে পারিনি।
ট্রেনিং শেষে কোচ সবাইকে ডাকলেন। আমাকে সবার মাঝে রেখে বললেন, ‘খেলাতো পারিস না কোন **টাও। জীবনে কোন ***টাও ছিঁড়তে পারবানা। শালা***’
এরকম একটা পরিস্থিতি…ওই বয়সী একটা ছেলে…একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কোচের কথা শেষ হবার আগেই একেবারে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কান্নাটা। সবার সামনে একেবারে। দৌড়ে পালিয়েছিলাম ওখান থেকে ।
বাড়ি ফিরে সোজা নিজের রুমে ঢুকে গেলাম। একা একটু কাঁদা দরকার। থাকেনা কিছু সময়, একা থাকা লাগে? একা নিজের সাথে বুঝতে হয়? ওরকম একটা সময় তখন। মা বুঝে ফেলেছিলেন, কোথাও কোন ঝামেলা হয়ে গেছে। ট্রেনিং থেকে ফিরে রাস্তায় খেলি অনেকক্ষন, ঐদিন কোন কথা নেই। কোন খেলা নেই। খুব ভাঙচুর হচ্ছিলো ভেতরে। মা চলে এলেন আমার রুমে। বলতেও খুব ভয় পাচ্ছিলাম। রাগ উঠলে এই এতটা রাস্তা সাইকেল চালিয়ে গিয়ে কোচকে একেবারে খোলা মাঠে মা ঠ্যাঙিয়ে আসবেন, আমি জানি। মা এমনিতে খুব চুপচাপ, শান্ত মানুষ। ওনার ছানাপোনাদের কিছু করছেন তো, দৌড়…ঝেড়ে দৌড় লাগান…আশপাশের এলাকায় থাকাটা একেবারে জীবনের ঝুঁকি বলতে পারেনণইমাকে বললাম মারপিট করেছি।
মা কিন্তু জানতেন ডাঁহা মিথ্যে কথা। অন্য সব মা যা করতেন এই সময়ে, মা ও তাই করলেন। আমার এক টীমমেইটের মা কে ডেকে পুরো ঘটনা শুনে নিলেন।
সব শুনে মা যখন আবার আমার রুমে ফিরলেন, অঝোরে কাঁদছি। বললাম, ফুটবল খেলবো না। আর খেলবো না। পরের দিন আমি আমার রুম থেকেই বের হইনি। স্কুলে যাইনি। সারাটা দিন বিছানায়। খুব বেশি লেগেছিলো ভেতরটায়।মা এসে বিছানায় বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুই খেলবি অ্যাঞ্জেল। আজকেই যাবি তুই। ঐ ব্যাটাকে দেখিয়ে দিতে হবে তুই ফেলনা নোস।’
ওইদিনই আমি মাঠে ট্রেনিং এ ফিরেছি। মাঠে যা হলো তাতে আমি অবাক হয়েছি। মানুষের উপর বিশ্বাস এসেছে। যে মানুষের জণ্যে আমাদের দুবেলা খাবার নিয়ে চিন্তাইয় পড়তে হয়েছে, যে মানুষ আমাকে খোলা আকাশের নিচে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, সেই মানুষের উপরেই বিশ্বাস ফিরেছে। আমার দলের সতীর্থরা আমাকে নিয়ে একটুও রসিকতা করেনি। বরং সাহাজ্য করেছে প্রাণপনে। বাতাসে যখন বল ভেসে এসেছে ডিফেন্সের খেলোয়াড়েরা আমাকে হেড করার সুযোগ করে দিয়েছে। আমার একটু ভালো লাগানোর জণ্য সতীর্থরা মাঠে সবটুকু উজাড় করে দিলো সেদিন। সবাই এত এত খেয়াল রাখলো আমার! এতটা ভালোলাগা আমার কখনো আসেনি।
তখনও খুব শুটকাপটকা ধরনের শরীর। বয়স হয়ে গেছে ১৬। সেন্ট্রালের সিনিয়র দলে নাম আসেনি। বাবা এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। একদিন রাতে সবাই খেতে বসেছি। বাবা বললেন, ‘তোর কাছে তিনটা অপশন আছে অ্যাঞ্জেল। আমার সাথে কাজে যেতে পারিস। স্কুলের পড়াটা শেষ করতে পারিস। অথবা ফুটবলে আরেকটা বছর দিয়ে দেখতে পারিস। যদি কাজ না হয় আমার সাথে এসে কাজ শুরু করতে হবে।’
কিছুই বলিনি। কি বলবো আসলে? খুব জটিল পরিস্থিতি তো। আমাদের বাঁচার জন্যে টাকাটাও দরকার। শেষমেষ মা বললেন। ‘আরেক বছর খেলুক অ্যাঞ্জেল।’
ডিসেম্বর। ডিসেম্বরের একেবারে শেষের দিকে সেন্ট্রালের পক্ষ হয়ে প্রিমেরা দিভিশিওনে আমার অভিষেক হয়।
আমার খেলোয়াড়ি জীবনের সেই শুরু, ওইদিনই। কিন্তু ভেতরে সত্যটা হচ্ছে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে আরো অনেক আগে। অনেক আগে। আমার বুটের তলা যখন মা আঠা দিয়ে জোড় দিতেন আমাদের যুদ্ধটা শুরু হয়েছে তখন থেকে। গ্রাসিয়েলাতে চাপিয়ে রোদ ঝড় বৃষ্টিতে মা আমাকে যখন ট্রেনিং এ নিয়ে যেতেন, আমাদের যুদ্ধটা শুরু হয়েছে তখন থেকে। এমনকি যখন আর্জেন্টিনায় পেশাদার ফুটবলার হিসেবে যাত্রা শুরু করি, যুদ্ধটা তখনো চলছে। সাউথ আমেরিকার বাইরের কারো পক্ষে বিষয়টা বোঝা খুবই কঠিন। এখানে থেকে না দেখলে, ঐ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে না গেলে কারো পক্ষে বিশ্বাস করা আসলেই কঠিন।
কলম্বিয়াতে একবার ন্যাশিওনাল এর বিপক্ষে খেলতে যেতে হয়েছিলো আমাদের। ঐদিনের কথা আমার খুব বেশি করে মনে আছে। প্রিমিয়ার লিগ বা লা লিগায় যেরকম এয়ার ট্রাভেল ওখানে এয়ার ট্রাভেলটা ওরকম না। বুয়েনস আয়ারসে খেললে যেরকম সেরকমও না। কারণ ঐ সময় রোজারিওতে কোন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ছিলোনা। ছোট্ট একটা এয়ারপোর্ট। যেদিন ওখানে যে বিমান থাকবে সেটাতেই চড়তে হবে। কোন প্রশ্ন করা যাবেনা। করে হবেইবা কি?
এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি ইয়া বড় এক কার্গো প্লেন বসে আছে রানওয়েতে। পেছনে বিরাট র্যাম্প ওয়ালা কিছু কার্গো প্লেইন আছেনা? গাড়ি টাড়ি নেয় যে প্লেইনে ওগুলো। দেখা গেলো ওটাই আমাদের, ওতেই চড়তে হবে। নামটাও আমার পরিস্কার মনে আছে। হারকিউলিস।
র্যাম্প নেমে এলো। ওয়ার্কাররা প্লেইনের ভেতরে ম্যাট্রেস ঢোকানো শুরু করলেন।
হতভম্ব হয়ে আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। হচ্ছেটা কি?
গেলাম প্লেইনের সামনে বসার জন্যে। ওয়ার্কারেরা হাতে হেডফোন ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘পেছনে চলে যান। ওখানেই আপনাদের বসার জায়গা।’
প্লেইনের তীব্র শব্দ আটকানোর জণ্যে আমাদেরকে মিলিটারি হেডফোন দেয়া হয়েছিলো। প্ল্যাটফর্মে উঠে দেখি কয়েকটা সীট আছে। আর বাকিদের জন্যে প্লেইনের মেঝেতে কার্পেট পাতা। কার্পেটে শুয়ে যাও, আপত্তি নেই কারো। প্লেইন চলা শুরু করলো, আমরা যারা শুয়েছিলাম, পিছলে নেমে যেতে শুরু করলাম। তীব্র শব্দে কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছিনা। পিছলে যাবার সময় সবাই চিৎকার করে খালি বলছিলো, ‘পেছনে লাল বাটন থেকে সাবধান। খুব সাবধান। চাপ পড়লে সবকয়টা আজকেই শেষ।’ সবাই যে একই কথা বলেছি টা আমরা অবশ্য জেনেছি প্লেইন থেকে নামার পর, ও সময় আমরা কেউই তো শুনতেই পাইনি।
অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। ঐ জীবনে দিন কাটিয়ে না এলে তাহলে বিশ্বাস করবেন না।
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের – মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা – এরকম ব্যাপারটা। আমার দলের অন্যান্যদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। সত্যিই হয়েছিলো। আমাদের নিজেদের প্রাইভেট প্লেইন, হারকিউলিস!
তারপরেও একধরনের সুখ নিয়ে আমি ঐ স্মৃতির দিকে তাকাই। রোমন্থন করি। আর্জেন্টিনায় ফুটবল দিয়ে যদি কিছু করতে হয়, যা করা দরকার তাই করতে হবে। দিতে হবে সর্বোচ্চটাই। যেই প্লেইনই এয়ারপোর্টে থাকুক, তাতেই চড়তে হবে। কোন প্রশ্ন করা যাবেনা।
সুযোগ থাকলে সেই প্লেইনে চড়তে হবে ওয়ান ওয়ে টিকেট কেটে। আমার জন্যে এরকম সুযোগটা ছিলো পর্তুগালের বেনফিকায়। আমার ক্যারিয়ারের দিকে তাকিয়ে অনেকে চোখ কপালে তুলে ফেলতে পারেন। ভাবতে পারেন, ‘ওয়াও, ছেলেটা বেনফিকায় খেলেছে, তারপর রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, এবং পিএসজি।’ বিষয়টা হয়তো দেখতে খুব সাধারন লাগছে। এর মাঝে যে কি গেছে তা কারো জন্যে কল্পনা করাও কঠিন। ১৯ বছর বয়সে বেনফিকায় গিয়ে আমি দুই সীজনও খেলতে পারিনি। আমার বাবা চাকরি ছেড়ে চলে এলেন পর্তুগালে। নিজের স্ত্রীর সাথে তখন গোটা এক মহাসাগর দুরত্ব তাঁর। মাঝে মাঝে রাতে বাবাকে ফোনে কথা বলতে শুনতাম। বাবা কাঁদতেন, বাচ্চাদের মতো কাঁদতেন। মাকে খুব মিস করতেন বাবা।.
কখনো কখনো মনে হতো জীবনে একটা বড় ভুল করে ফেলেছি। হচ্ছেনা কিছুতেই। শুরু থেকে খেলতে পারছিনা। মনে হতো সব ছেড়েছুড়ে সোজা বাড়ি চলে যাই।
এরপর এলো ২০০৮ এর অলিম্পিক। আমার জীবন বদলে দিয়েছে সেই অলিম্পিক। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে আমার ডাক পড়লো। বেনফিকায় আমি তখনো পুরো নব্বই মিনিট খেলার সুযোগ পাইনি। ঐ সময়টার কথা আমি কখনো ভুলবোনা। এই টুর্নামেন্টে আমি সুযোগ পেয়েছিলাম লিওনেল মেসির সাথে খেলার। অন্য পৃথিবীর, এক অতিমানব খেলোয়াড়। ওর সাথে ফুটবলটা খেলে আমি সবচে বেশি মজা পেয়েছি। আমাকে কিছুই করতে হতোনা, শুধু ফাঁকা একটা জায়গা বের করে একটা ছোট্ট দৌড় দিতে হতো। বল আসবেই ওই জায়গায়। ম্যাজিক। একদম ম্যাজিকের মতো।
আপনার আমার চোখ যেভাবে কাজ করে, লিওর চোখ ওভাবে কাজ করেনা। আমাদের চোখ দুপাশ থেকে দেখে। লিও তো সেরকম করে দেখেই, পাখির মতো ওপর থেকে দেখার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে লিওর। আমি জানিনা এটা কিভাবে সম্ভব।
আমরা ফাইনালে গেলাম। আমাদের বিপক্ষে নাইজেরিয়া। আমার জীবনের সবচে স্মরণিয় সম্ভবত ঐ দিনটা। আমার গোলে আর্জেন্টিনা অলিম্পিকে গোল্ড পেয়ে গেলো…অনুভূতিটা আসলে বোঝাতে পারবোনা।
আমার বয়স তখন মাত্র ২০ বছর। বেনফিকায় পুরোটা সময় খেলার সুযোগ পাচ্ছিনা। পরিবার আলাদা দুই দেশে থাকেন। ঐ টুর্নামেন্টে খেলার জন্যে ডাক পাবার আগে খুব অসহায় একজন মানুষ ছিলাম আমি। প্রচন্ড অসহায়। আর ঠিক দু বছরের মাথায় আর্জেন্টিনার হয়ে সোনা জিতলাম, বেনফিকাতে খেলছি এরপর ট্রান্সফার হয়ে গেলাম মাদ্রিদে।
খুব গর্বের একটা সময়। শুধু আমার জন্যে না। আমার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সতীর্থ যাঁরা আমাকে দিনের পর দিন সাহস দিয়ে গেছেন, সমর্থন দিয়ে গেছেন সবার জন্যে গর্বের। শুনতে পাই আমার বাবা আমার চেয়ে ভালো ফুটবলার ছিলেন। তাঁর সময়ে খেলতেন আমার চাইতে অনেক ভালো। হাঁটু ভেঙে তাঁর স্বপ্নটা ভাঙে। শুনেছি আমার দাদা আমার বাবার চাইতে ভালো খেলতেন। এক ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই পা হারিয়ে তাঁর স্বপ্নটাও হারিয়ে যায়।
আমার স্বপ্নও অনেকবার মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো। অনেকবার।
বাবা নিরলস কাজ করে গেছেন…টানা দিনের পর দিন…টিনের চালার নীচে…প্রচন্ড গরম, তীব্র শীতের ভেতর…মা সাইকেলের প্যাডেল চালিয়ে গেছেন রোদ,ঝড়,বৃষ্টিতে…ফুটবল নিয়ে আমি দৌড়ে বেড়িয়েছি উন্মাদের মতো।
ভাগ্যে বিশ্বাস করেন কিনা জানিনা। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে আমি প্রথম যে দলের বিপক্ষে গোলটা করেছি, দলটার নাম জানেন?
হারকিউলিস সিএফ।
অনেকটা তো বললাম, এবারে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন ফাইনালের আগে আমি কেন সাবেলার সামনে গিয়ে কেঁদেছি। আমি নার্ভাস ছিলাম না। আমার ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম না। এমনকি ম্যাচের শুরু থেকে খেলতে পারবো কিনা সেটাও আমার মাথায় ছিলোনা।
এই বুকে হাত রেখে বলছি, আমি শুধু স্বপ্নটাকে ছুঁয়ে দিতে চেয়েছি। চেয়েছিলাম আমার দেশে আমাদের নামটা যেন কিংবদন্তীর মতো করে সবাই মনে রাখে। একদম কাছে চলে গিয়েছিলাম আমরা…একদম।
একারনে আমাদের দলের প্রতি মিডিয়ার আচরনে মনটা ভেঙে গিয়েছিলো। নেগেটিভিটি, সমালোচনা কখনো কখনো সীমা ছাড়িয়ে যায়। খুব অসুস্থ ব্যাপারটা। আমরাতো সবাই মানুষ। এমন অনেক কিছুইতো হয় আমাদের যে বিষয়গুলো অন্যেরা কোনদিন জানতেও পায়না।
ফাইনাল কোয়ালিফাইং খেলা গুলোর আগে আমি সাইকোলজিষ্ট দেখানো শুরু করেছিলাম। মাথার ভেতর সব খুব অসহ্য লাগতো। সাধারনত আমি পরিবারের উপর খুব নির্ভর করি এরকম সময়গুলোতে। ওবার তা হয়নি। জাতীয় দলের উপর প্রেশারটা বেশি, অসম্ভব বেশি ছিলো। সাইকোলজিষ্টের সাথে দেখা করাটা আমার খুব কাজে দিয়েছিলো। ফাইনালের দুই ম্যাচে খুব রিলাক্সড ছিলাম, নির্ভার ছিলাম।
নিজেকে বার বার মনে করিয়ে দিয়েছি, আমি পৃথিবীর সেরা একটা দলের অংশ। খেলছি নিজের দেশের জন্যে। ছেলেবেলায় যে স্বপ্ন দেখেছি, সেই স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি। মাঝে মাঝে পেশাদারিত্ব এই খুব সাধারন বিষয়গুলো মাথা থেকে সরিয়ে দেয়। সরিয়ে না দিলেও ঢেকে রাখে।
এরপর খেলাটা আমার কাছে নিছক খেলাই হয়ে গেলো। আজকাল সবাই ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউবে দেখে নেয় সবকিছু।
খেলার ফলাফল খুব সহজে জেনে যাওয়া যায় কিন্তু ওর পেছনে কত কত যে ঘাম, আনন্দ-বেদনার কাব্য লুকিয়ে আছে তা কেউ দেখতে পায়না। মেয়েকে সাথে নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি সহ ছবি তুলেছি, ছবি দেখে সবার ধারণা বাহ, সবতো ঠিকই চলছে। কোথাও কোন গড়বড় নেই। কিন্তু কেউ জানেনা ঐ ছবিটা তোলার ঠিক এক বছর আগে আমার এই মেয়েটাই প্রিম্যাচিওর অবস্থায় জন্মেছিলো, দুমাস টানা হাসপাতালে ছিলো মেয়েটা। সারা শরীরে লাগানো ছিল টিউব, তাঁর।
ছবিটায় ট্রফিটার সাথে আমাকে কাঁদতে দেখা গেছে। সবাই ভাবছে জেতার আনন্দে কাঁদছি। ফুটবলের জন্যে কাঁদছি। সত্যিটা কি জানেন? কেঁদেছি আমার মেয়েটার জন্যে। এইযে ও বেঁচে আছে, আমার সাথে বেঁচে ধরে আছে ট্রফি, এই আনন্দে আমি কেঁদেছি।
সবাই বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখেছে, ফলটা দেখেছে।
০-১
কত সম্ভব অসম্ভব যুদ্ধ জয় করে আমরা ক’জন সে জায়গায় পৌঁছেছিলাম, কেউ কি তা জানে?
লিভিং রুমের দেয়াল কি করে সাদা থেকে কালো হয়ে যায়, তা কি জানে কেউ?
টিনের চালার নিচে আমার বাবার দিনের পর দিন পরিশ্রমটা কেউ দেখেনি।
রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে গ্রেসিয়েলায় প্যাডেল চাপা আমার মাকে কি ওরা কখনো দেখেছে?
ওরা হারকিউলিস সম্পর্কে কি জানবে কখনো?
– প্লেয়ার্স ট্রিবিউন অবলম্বনে