উইকেটের সহজ ধারাপাত

এমন স্লো-লো-টার্নিং উইকেটে জিতে কি লাভ? বিশ্বকাপ কি এরকম উইকেটে হবে?

– ভালো উইকেট বা ভালো ব্যাটিং উইকেটে খেলে হেরে গেলে কি খুব লাভ হতো? হেরে যাওয়া কি খুব ভালো অনুশীলন? আত্মবিশ্বাস কমতে থাকা কি ভালো প্রস্তুতি?

জয়ের চেয়ে ভালো প্রস্তুতি, আত্মবিশ্বাসের চেয়ে বড় রসদ কি আর আছে?

আর সেই জয় যদি হয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, তাহলে আত্মবিশ্বাসের পারদও থাকার কথা উঁচুতে। হ্যাঁ, স্রেফ আত্মবিশ্বাস দিয়েই আমরা বিশ্বকাপে হাতি-ঘোড়া করে ফেলব না। তবে ভালো কিছু হতেও পারে। কিন্তু ক্রমাগত হারতে থাকা ভালো কিছু নয়, এটা নিশ্চিত।

উইকেটের কথা বলি। বিশ্বকাপের প্রাথমিক পর্ব হবে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বাংলাদেশ যেহেতু ওমানের গ্রুপে, এই গ্রুপের ম্যাচগুলি হয়তো ওমানেই হবে। জানি না, সেখানকার উইকেট কেমন। ধরে নিলাম স্পোর্টিং , কিংবা ব্যাটিং বান্ধব। তার পরও ওমান, পাপুয়া নিউ গিনি ও স্কটল্যান্ডের সঙ্গে লড়াইয়ে গ্রুপ সেরা হওয়া উচিত। তাঁদের সঙ্গে জয়ের জন্য এখনই ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে খেলা জরুরি নয়।

গত বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে বরং পরীক্ষা অনেক বেশি কঠিন ছিল। ধর্মশালায় হাড়কাঁপানো শীত, বাতাস, পেস সহায়ক কন্ডিশন ও উইকেটে খেলতে হয়েছে। নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ডের জন্য কন্ডিশন ছিল বেশি উপযোগী, তাদের ভালো কয়েকজন সুইং বোলারও ছিল। এমনকি ওমানেরও সুইং বোলার ছিল। সেই চ্যালেঞ্জ উতরে যাওয়ার পর এবার না পারার কারণ নেই।

যদি পরের ধাপ বা সুপার টুয়েলভ-এর কথা বলি, খেলা হবে আরব আমিরাতের তিন মাঠে। এর মধ্যে শারজাহর মাঠ ছোট, উইকেট বেশির ভাগ সময় ব্যাটিং সহায়ক থাকে। আবু ধাবি ও দুবাইয়ে কিছু খুব ভালো ব্যাটিং উইকেট আছে, কিছু আছে ১৬০-১৭০ রানের উইকেট।

তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, বিশ্বকাপের আগে প্রায় এক মাস ধরে এই মাঠগুলোয় আইপিএল চলবে। আইপিএল শেষ হওয়ার পরপরই বিশ্বকাপ। মাত্র তিনটিই মাঠ। টানা ব্যবহারে উইকেটগুলো ক্লান্ত হবে, জীর্ণ হবে। মিরপুরের মতো না হলেও কিছুটা মন্থর নিশ্চিতভাবেই হবে। কে জানে, মিরপুরে অনুশীলন তখন কাজে লাগতেও পারে।

কোচ রাসেল ডমিঙ্গো যে সিরিজ শুরুর আগে বললেন, ভালো উইকেটে খেলতে চান!

– আমরা প্রেসবক্সে তখনই কয়েকজন আলোচনা করছিলাম যে, কোচ এটা বলে থাকতে পারেন অস্ট্রেলিয়াকে ধোঁয়াশায় রাখতে। এছাড়া আর কোনো কারণ থাকার কথা নয়।

ম্যাচের আগের দিন যখন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ উইকেটের প্রসঙ্গে বললেন, ‘এটা বললে তো সবই বলে দিলাম…’, তখন আরও নিশ্চিত হয়ে যাই, মিরপুরের চেনা উইকেটই থাকছে।

এসব উইকেটে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট কি হওয়া উচিত?

– ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’

প্রতিপক্ষ যখন অস্ট্রেলিয়া বা এই ধরনের দল, অবশ্যই এবং অবশ্যই এই ধরনের উইকেটে খেলা উচিত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব দলই নিজেদের শক্তি আর প্রতিপক্ষের দুর্বলতা মাথায় রেখে ঘরের মাঠের সুবিধা নিতে চায়। এটা একদমই সহজ ও স্বাভাবিক।

বিশেষ করে এই বর্ষা মৌসুমে, মিরপুরের উইকেট এমনিতেই কঠিন থাকে। একটু ভেজা, একটু নরম। কোনো বল স্কিড করে, কোনোটা থেমে আসে। কোনো বল লাফায়, কোনোটা নিচু হয়। আমরা সেটাকে রোল করে, ঘষেমেজে অস্ট্রেলিয়ানদের শট খেলার মঞ্চ কেন তৈরি করে দেব?

অস্ট্রেলিয়াকে আমরা নিজেদের আঙিনায় খুব বেশি পাই না। ইংল্যান্ডকে পাই না। দক্ষিণ আফ্রিকাকে পাই না। তাদের বিপক্ষে জয়ের জন্য অবশ্যই নিজেদের পছন্দের উইকেট আমরা পেতে চাইব। জিম্বাবুয়ে বা এই ধরনের দল হলে ভিন্ন ভাবনা থাকতে পারে। তবে সেসব সিরিজেও পছন্দের উইকেট রাখা দোষের কিছু নয়। ক্রিকেট দুনিয়ার নিয়ম এটা। আমরা আয়ারল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডসে গেলে কি স্লো-লো উইকেট পাব?

ক্রিকেটের মজাই তো এটা যে পার্থে গেলে বল নাকে বাতাস দেবে, কেপ টাউনে গেলে শরীরে ছোবল দেবে, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে গেলে সাপের মতো হিস হিস করবে, ওয়েলিংটনের সবুজ গালিচায় চোখে সর্ষে ফুল দেখতে হবে, চেন্নাইতে লাটিমের মতো ঘুরবে, গলে হাঁটুর ওপরে উঠবে না, সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবে দাঁড়িয়ে থাকলেই রান আর রান। এসব চ্যালেঞ্জের কারণেই ক্রিকেট সুন্দর।

দুনিয়ার এত খেলার মধ্যে ক্রিকেটের ইউনিক ব্যাপারই এগুলো। আকাশে মেঘ থাকলে খেলা একরকম, বৃষ্টির পর একরকম, রোদ কম-বেশি হলে একেকরকম, বাতাস কম-বেশি থাকলে একেকরকম, উইকেটের মাটির কারণে খেলায় কত প্রভাব, এসব কারণেই ক্রিকেট এতটা মোহনীয়।

‘না’ প্রসঙ্গে আসি। কোথায় এরকম উইকেটে টি-টোয়েন্টি চাই না?

বিপিএলে চাই না, ঘরোয়া ক্রিকেটে চাই না।

উইকেট প্রসঙ্গে এই ব্যাপারটা অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। ঘরোয়া আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।

আমাদের অবশ্যই বাউন্সি উইকেটে খেলা শিখতে হবে। সু্ইং সামলানো শিখতে হবে। এমনকি টার্নিং উইকেটেও আমরা সত্যি বলতে, ভালো ব্যাট করি না। টি-টোয়েন্টিতে নিষ্প্রাণ ও ব্যাটিং উইকেটে খেলে, বড় বড় রান করে কলিজা বড় করতে হবে। শটের রেঞ্জ বাড়াতে হবে। বিশ্বাস বাড়াতে হবে। কিন্তু সেসবের মঞ্চ কোনটা? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসব উইকেটে খেলে শিখতে হবে?

না, অবশ্যই না। শিখতে হবে ঘরোয়া ক্রিকেটে। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে। হাই পারফরম্যান্সের ট্রেনিংয়ে ও তাদের ম্যাচে। ‘এ’ দলের সিরিজে ও সফরে। শিখতে হবে সেসব জায়গায়। সেসব জায়গায় খেলে ও শিখে একটা পর্যায়ে যেতে পারলে, যদি কখনও ভারত-ইংল্যান্ডের মতো ২-৩টা দল বানাতে পারি, কোয়ালিটি পেসার-স্পিনার এত থাকে, বিধ্বংসী সব ব্যাটসম্যান এত এত থাকে, তখন আবার নিজ দেশেও ভিন্ন কিছুর চ্যালেঞ্জ আমরা নিতে পারব (যদি প্রয়োজন হয় বা প্রস্তুতির দরকার পড়ে)।

অসংখ্যবার বলা পুরনো কথা আবার বলতে হচ্ছে। দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট ও এইচপি-এ দলের ম্যাচ হতে হবে নানারকম উইকেটে। কোথাও বাউন্স হবে, কোথাও সুইং করবে (এই দেশের আলো-হাওয়া মাটির বাস্তবতায় যতটা বানানো সম্ভব), কোথাও উইকেট থাকবে স্লো, কোথাও ভয়ঙ্কর টার্ন করবে, কোথাও নিখাদ ব্যাটিং উইকেট হবে। ওসব জায়গায় নিয়মিত খেলতে হবে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এসব পরখ করার বা আলগা-হাওয়াই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জায়গা নয়। অস্ট্রেলিয়ার মতো এসব দলকে নিজেদের আঙিনায় পেলে অবশ্যই তাদেরকে আমরা গতিহীনতায় ‘মারতে’ চাইব, বাউন্সহীনতায় ‘মারতে’ চাইব, টার্নে ‘মারতে’ চাইব।

সেটা যে ফরম্যাটেই হোক, যখনই হোক।

বাংলাদেশ সিরিজের বাকি তিন ম্যাচ হেরে গেলেও সেই সত্য বদলাবে না। জিতে গেলে সত্য আরও প্রতিষ্ঠিত হবে।

– ফেসবুক থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link