লোকটার ক্যারিয়ার তখনো প্রায় ৭০ অপরাজিত’র মত শক্তপোক্ত দেখাচ্ছিল। কিন্তু ক্রিকেটজীবনের মতই অফস্টাম্পের বাইরে একটা আউটসুইঙ্গারের অমোঘ প্রলোভন এড়াতে না পেরে সজোরে চালাতে গিয়ে ক্যারিয়ার নামক উইকেটটাই খুইয়ে বসে লোকটা। সেই আউটসুইঙ্গারের নাম ছিল ‘কাভি আজনাবি থি’।
বাঙালি নায়িকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার গুঞ্জন, সিনেমাটির ফ্লপ হওয়া, ক্রিকেট থেকে অনেকটাই ফোকাস সরে যাওয়া, সব মিলে মিশে কিছুদিন পরেই দুটি জিনিস হারিয়ে ফেলে লোকটি। ক্রিকেট জীবন এবং অভিনয় জীবন। লোকটা ছিল এইরকমই। তিনি সন্দীপ প্যাটেল – দ্য গ্ল্যামারাস সন্দীপ পাতিল
প্রচণ্ড আক্রমণাত্বক ব্যাটিং করা সন্দীপ তাঁর প্রতিভার প্রতি চরম অবিচার করে মাত্র পাঁচ বছরের টেস্ট জীবন আর সাড়ে পাঁচ বছরের ওডিআই জীবনেই তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের নটে গাছটি মুড়িয়ে ফেলেছিল। ১৫ জানুয়ারি ১৯৮০ থেকে ১২ ডিসেম্বর ১৯৮৪-এর মধ্যে ২৯টি টেস্ট এবং ৬ ডিসেম্বর ১৯৮০ থেকে ২৬ মে ১৯৮৬-এর মধ্যে ৪৫টি ওয়ানডে খেলা লোকটির সাহসী ক্রিকেট আজও মনে গাঁথা আছে তখনকার ক্রিকেটপ্রেমীদের। লোকটা ছিল এইরকমই।
১৯৮১-৮২তে ম্যাঞ্চেস্টার টেস্টে ৭৩ থেকে ১০৪-তে যেতে লোকটা নিয়েছিল নয়টি বল। ইয়ান বোথামের একটি ওভারের শেষ ২ বলে ৪, ৩ এবং উইলিসের পরের ওভারে ৪, ৪, ৪, ০, ৪, ৪, ৪। উইলিসের তৃতীয় বলটি ছিল নো বল।
৮০ রানে দাঁড়িয়ে উইলিসের ওভারে লোকটার ছয়টি শটের দু’টি ছিল কভার ড্রাইভ, দু’টি স্কোয়ার কাট, একটি বোলারের মাথার উপর দিয়ে ড্রাইভ এবং আর একটি বিশাল হুক। ফলোঅনের ভ্রূকুটির সামনে দাঁড়িয়ে লোকটা সেদিন এক ঘন্টার একটু বেশি সময়ে কপিল দেবের সঙ্গে জুটিতে করেছিল ৯৬ রান। লোকটা ছিল এইরকমই।
১৯৭৯-তে রঞ্জিতে সেমিফাইনালে দিল্লীর বিরুদ্ধে ১৪৫ করে ভারতীয় দলে ঢোকা লোকটার টেস্ট রান ছিল ১৫৮৮, চারটি শতরান আর সাতটি অর্ধশতরান সহ। সর্বোচ্চ ১৭৪ সে করেছিল (তার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি) অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অ্যাডিলেডে লিলি-প্যাসকো-হগের বিরুদ্ধে, ২২ টি চার আর একটি ছয় সহ, পাঁচ ঘন্টায়।
তার আগের টেস্টে প্রথম ইনিংসে হগ আর প্যাসকোর বলে গলা আর কানে গুরুতর আঘাত পেয়েও অধিনায়কের কথাতে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করেছিল লোকটা, ইনিংস পরাজয় এড়াতে। পরের সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বোলিং ওপেন করেছিল লোকটা, কপিলের সঙ্গে। লোকটা ছিল এইরকমই।
লোকটার ওডিআই রান ছিল ১০০৫, ৯টি অর্ধশতক সহ। সর্বোচ্চ ছিল ৮৪। ওয়ানডে অভিষেকে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৬৪ রান করে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ হয়েছিল লোকটা। নয়টি টেস্ট উইকেট আর ১৫টি ওডিআই উইকেটও পেয়েছিল লোকটা।
আর ১৯৮৩ সালে তার খেলা একমাত্র বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হবার পথে আটটি ম্যাচে ২১৬ রান করেছিল লোকটা, সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো ৫১ অপরাজিত সহ।এই লোকটাই ১৯৮৪ সালে দিল্লীতে ৪১ রান দাঁড়িয়ে ম্যাচ বাঁচাবার তোয়াক্কা না করে ফিল এডমন্ডসকে মাঠের বাইরে ফেলতে গিয়ে আউট হয়, ভারত হেরে যায়।
পরের টেস্টে কলকাতাতে বাদ পড়ে সে আজহারউদ্দীনকে জায়গা করে দিয়ে। আজহারের পরপর তিনটি টেস্ট সেঞ্চুরি লোকটার টেস্ট ক্যারিয়ারে দাঁড়ি টেনে দেয়। ১৯৮৬ সালে ওয়ানডে ক্যারিয়ারও শেষ হয় তার।
মজা হয় তারপরে। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ – রঞ্জিতে মধ্যপ্রদেশের অধিনায়ক হয় লোকটা এবং ১৯৯০-তে মুম্বাইয়ের বিরুদ্ধে করে ১৮৫। তখন লোকটার বয়েস ৩৪। লোকটা ছিল এইরকমই।
খেলা ছাড়ার পরে ১৯৯৬ সালে অজিত ওয়াদেকারকে সরিয়ে ৬ মাসের জন্য ভারতীয় দলের ম্যানেজার হওয়া লোকটা ২০০৯ সালে বিদ্রোহী লিগ আইসিএল ছেড়ে এসে এনসিএ-র ডিরেক্টর হন ডেভ হোয়াটমোরকে সরিয়ে। আর ২০১২ সালে হন নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান।
২০০৩ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে কেনিয়ার কোচ হিসেবে দলকে সেমিফাইনালে তুলেছিলেন লোকটা, ভারতের কাছে হেরে যাবার আগে। লোকটা বর্ণময়তার পিছনে না দৌড়লেও শেষ পর্যন্ত রঙিন থেকে গেছেন আজও। সন্দীপ পাতিল – লোকটা আজও এইরকমই।