নয়ন মোঙ্গিয়া, দ্য লাস্ট স্পেশালিস্ট

ক্রিকেটে উইকেটরক্ষদের কাজটা বোধহয় ফুটবলের গোলরক্ষকদের মত।

যতই ভাল খেলুন দিনশেষে পাদপ্রদীপের আলোয় ব্যাটসম্যান কিংবা বোলাররাই। উল্টো পান থেকে চুল খসলেই সবার আগে কোপটা পড়ে কিপারদের উপর। পুরো ম্যাচ জুড়ে কেবল একটা ক্যাচ ছুটলেই দর্শকদের টিপ্পনি থেকে সতীর্থদের চোখ-রাঙানি সবই সহ্য করতে হয় তাদের।

আমাদের আজকের গল্পের নায়ক ভারতের হয়ে গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনটা সামলেছেন প্রায় এক দশক। মহেন্দ্র সিং ধোনি, ডিনেশ কার্তিক, রবিন উথাপ্পা কিংবা হালের ঋষাভ পান্তদের ব্যাটসম্যান কাম উইকেটরক্ষক যুগের সূচনার পূর্বে তিনিই ছিলেন সর্বশেষ স্পেশালিষ্ট উইকেটরক্ষক। ভারতের এই সাবেক উইকেটরক্ষকের নাম নয়ন মোঙ্গিয়া।

নয়ন মঙ্গিয়ার জন্ম ভারতের বরোদায়। কিশোর বয়স থেকেই ভারতের বয়স ভিত্তিক দলগুলোতে জায়গা করে নেন তিনি। ভারত অনুর্ধব-১৯ জাতীয় দলের হয়ে পাঁচ ম্যাচে ৩০৫ রানের পাশাপাশি গ্লাভস হাতে ১৭ ডিসমিসাল করেন। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে সৌরাষ্ট্রের বিপক্ষে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয় তাঁর।

সে ম্যাচে উইকেটের পেছনে একটি ক্যাচ নিলেও আট নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে শূন্য রানেই সাজঘরে ফেরেন। পরের বছর ভারত এ দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরকালে কিংবদন্তি উইকেটরক্ষক অ্যালান নট স্বয়ং তাঁর প্রশংসা করেন। তার ভাষ্যমতে উইকেটের পেছনে দাঁড়ানোর প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভা রয়েছে মোঙ্গিয়ার।

পরের মৌসুমেই বরোদার প্রধান তারকায় পরিণত হন তিনি। পাঁচ ম্যাচেই দুই সেঞ্চুরিতে প্রায় ৮০ গড়ে করেন ৫৫৫ রান। সে সময় বরোদা দলে তার সতীর্থ ছিলেন জাতীয় দলে উইকেটরক্ষক কিংবদন্তি কিরণ মোরে। মঙ্গিয়ার অমন ফর্মের সামনে বর্ষীয়ান মোরেকে তখন বড্ড ম্লান দেখাচ্ছিল। তবে মোরের পরামর্শে মোঙ্গিয়া নিজেকে আরও ধারালো করে তোলেন। অবশেষে মোরের অবসরের পর জাতীয় দলে ডাক পান তিনি।

১৯৯৪ সালে লক্ষ্মৌতে শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্টে জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে মোঙ্গিয়ার। অভিষেক ম্যাচেই ৪৪ রানের পাশাপাশি উইকেটের পেছনে পাঁচটি ক্যাচ লুফে নেন তিনি। তখনকার ভারত খেলতে নামত অনিল কুম্বলে, ভেংক্টপতি রাজু এবং রাজেশ চৌহানের মতো স্পিনারদের নিয়ে।

স্পিননির্ভর ভারতীয় পিচে সাপের মতো বাঁকানো কুম্বলের লেগস্পিন কিংবা রাজুর বাঁ-হাতি স্পিন উইকেটের পেছন থেকে ধরা ছিল দুরহের ব্যাপার। বছরের পর বছর সুনিপুণ হাতে সে কাজটাই করে গিয়েছেন মঙ্গিয়া। কেবল বল ধরাই নয়, উইকেটের পেছন থেকে ক্রমাগত বোলারদের পরামর্শ দিতেন তিনি।

ব্যাট হাতে যে তিনি নেহায়েৎ মন্দ ছিলেন সেটা বলাও মুশকিল। দলের বিপদে বারবারই রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি। নিচের দিকে ব্যাট করাতে তেমন সুযোগ পাননি বড় রান করার। ১৯৯৬ সালে দিল্লীতে ভারত এক্সট্রা ব্যাটসম্যান খেলাতে না পেরে মঙ্গিয়াকে প্রমোশন দিয়ে ইনিংস উদ্বোধন করতে পাঠায়।

সুযোগ পেয়ে সেদিন ব্যাট হাতে নিজের জাত চেনান তিনি, শক্তিশালী অজি বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে খেলেন ১৫২ রানের ম্যাচ জেতানো এক ইনিংস। এই ইনিংসই প্রমাণ করে ব্যাট হাতেও কম ছিলেন না মঙ্গিয়া, কেবল সুযোগটাই পাননি।

দলের জন্য নয়ন মোঙ্গিয়া ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে আজহার মেহমুদের ক্যাচ লুফে নিতে গিয়ে আঙুল ভেঙ্গে গেলে পুরো টুর্নামেন্ট ভাঙা আঙুল নিয়েই খেলেন। ভারতের হয়ে এক টেস্টে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের রেকর্ড তার দখলেই। প্রথমে ১৯৯৬ সালে ডারবানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক টেস্টে ধরেন আটটি ক্যাচ।

পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে পাকিস্থানের বিপক্ষে একই কীর্তির পুনরাবৃত্তি ঘটান তিনি। ২০০৪ সালে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন মঙ্গিয়া। ভারতের হয়ে ৪৪ টেস্টে ১৪৪২ রান করার পাশাপাশি উইকেটের পেছনে ৯৯ ক্যাচ ধরেন তিনি। এছাড়া ১৪০ টি একদিনের ম্যাচে ১১০ টি ক্যাচ ধরার পাশাপাশি ৪৪ টি স্ট্যাম্পিং করেন।

তার বিরুদ্ধে একবার ম্যাচ গড়াপেটায় জড়িত থাকার অভিযোগ না হলেও কিছুই প্রমাণিত হয়নি। তবে, সেই অভিযোগটা তাঁর ক্যারিয়ারের কলঙ্ক হয়ে টিকে আছে।

ক্রিকেট ছাড়ার পর ২০০৪ সালে থাইল্যান্ড জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। যদিও বেশিদিন ছিলেন না সে পদে। বর্তমানে ক্রিকেট এক্সপার্ট হিসেবে স্টার নিউজের সাথে যুক্ত রয়েছেন তিনি।

আসলে বলার মত ‘গ্রেট’ ক্যারিয়ার তাঁর ছিল না। তবে, নব্বই দশকে যারা ক্রিকেট অনুসরণ করেছেন তাঁদের জন্য নয়ন মোঙ্গিয়া একটা কাল্ট চরিত্র। স্রেফ টুকটাক ব্যাটিং জেনেও স্রেফ উইকেটের পেছনের দক্ষতা দিয়েও যে জাতীয় দলকে লম্বা সময় সার্ভিস দেওয়া যায় তাঁর শেষ উদাহরণ তিনি।

সেই সময় থেকে উইকেটরক্ষকদের চরিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখনকার উইকেটরক্ষকরা একেকজন অলরাউন্ডার। ব্যাট হাতে আরও বেশি পারদর্শী। মহেন্দ্র সিং ধোনি, কুমার সাঙ্গাকারা কিংবা অ্যাডাম গিলক্রিস্টরা উইকেটরক্ষকদের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছেন। আজকাল আবার উইকেটরক্ষকদের বেশি মনোযোগ দিতে হয় ব্যাটিংয়ে। আর এই করতে গিয়ে উইকেটের পেছনের শিল্পটাই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link