অতিকায় অজি অধিপতি

১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে যখন বিশ্বকাপজয়ী ব্যাটসম্যান অ্যালান বোর্ডারের ক্যারিয়ার প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন তার বিকল্পের জন্য ভাবছিলো অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দল। সমাধানটা করলেন বোর্ডার নিজেই, পরামর্শ দিলেন রিকিকে আসন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে দলে রাখার। এদিকে রিকি তখন ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের বন্যা ভাসিয়ে যাচ্ছেন। একাধারে করেছিলেন পাঁচটি সেঞ্চুরি।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দল বরাবরই বিশ্ব ক্রিকেটের মঞ্চে ‘বিগ শট’ নিয়ে আসার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। সেই স্যার ডোনাল্ড ব্র‍্যাডম্যান থেকে শুরু করে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, স্টিভ ওয়াহ, ব্রেট লি, এমনকি শেন ওয়ার্ন, শেন ওয়াটসন পর্যন্ত অনেক অজি রথী-মহারথী মিলে মাতিয়ে রেখেছেন ক্রিকেটভক্তদের। এঁদের কাতারে নাম লেখানো আরেক প্রতিভাধর তারকা রিকি থমাস পন্টিং, ওরফে পান্টার, অধিনায়ক হিসেবে যার যাত্রা কখনো ভোলার মতো না৷

পন্টিংয়ের জন্ম তাসমানিয়ার লরেন্সটোনে। একদিক থেকে সৃষ্টিকর্তা তাঁকে বাড়তি সুবিধা দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, কারণ তাঁর জন্ম হয়েছিল পুরোদস্তুর এক ক্রীড়াসুলভ পরিবারে। বাবা গ্রেইম পন্টিং ক্লাবে ক্রিকেট খেলেছেন। চাচা গ্রেগ ক্যাম্পবেল টেস্ট খেলেছেন ১৯৮৯-৯০ পর্যন্ত। বয়স হবার পর থেকেই বেড়ে উঠেছেন খেলাধুলার মধ্যে।

ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবল খেলতেন। এমনকি ফুটবলকেই পেশা হিসেবে নিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। দূর্ভাগ্য, কিংবা বলা যায় সৌভাগ্যক্রমেই বয়সভিত্তিক দলে খেলতে গিয়ে হাত ভাঙেন পন্টিং। সেই থেকে ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে হাতে তুলে নেন ক্রিকেট ব্যাট।

ক্রিকেটে শুরুটা অবশ্য খুব একটা সহজ ছিলনা৷ ক্লাস টেন অবধি পড়ার পর লেখাপড়া ছেড়ে দেন। স্কটিশ কলেজে যোগ দেন গ্রাউন্ডস্ম্যান হিসেবে৷ তারপর আস্তে আস্তে শুরু করেন বয়সভিত্তিক দলে খেলা। একে একে খেলেছেন নর্দান তাসমানিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের অনূর্ধ্ব ১৩, ১৪, ১৬ আর ১৯ দলে৷ অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলতে খেলতেই শুরু করেন প্রথম শ্রেণির ঘরোয়া ক্রিকেটের যাত্রা।

মাত্র আঠারো বছর বয়সেই দূর্দান্ত সব সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে সাড়া ফেলে দেন। তাসমানিয়ার ক্রিকেট কর্তারা তাঁকে পাঠান অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট একাডেমিতে। সেখানে নজরে পড়ে যান তৎকালীন কোচ রডনি মার্শের। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি পন্টিংকে।

১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে যখন বিশ্বকাপজয়ী ব্যাটসম্যান অ্যালান বোর্ডারের ক্যারিয়ার প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন তার বিকল্পের জন্য ভাবছিলো অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দল। সমাধানটা করলেন বোর্ডার নিজেই, পরামর্শ দিলেন রিকিকে আসন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে দলে রাখার। এদিকে রিকি তখন ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের বন্যা ভাসিয়ে যাচ্ছেন। একাধারে করেছিলেন পাঁচটি সেঞ্চুরি।

তবুও ভাগ্যের শিঁকে ছেড়েনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে তাকে থাকতে হয় অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবেই৷ ১৯৯৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অবশেষে তার অভিষেক ঘটে। সেটি ছিল চার দেশীয় ওয়ানডে সিরিজ। অভিষেক ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে  ছয় বলে মাত্র এক রান করেন তিনি। ক্যারিয়ের দুরন্ত সময়ে থেকেও জাতীয় দলে তার ছন্দ ফিরে পেতে সময় লেগেছিল। তৃতীয় ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে করেন ৬২ রান৷

এরপর আসে বিশ্বকাপ, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই বিশ্বকে নিজের জাত চেনান রিকি পন্টিং। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১১২ বলে ১০২ রানের ইনিংস খেলে গড়েন ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ড। টেস্ট ম্যাচেও দেখান নিজের কৃতিত্ব। অ্যাশেজ টেস্টে প্রথম ইনিংসে ২০২ বলে ১২৭ রান করে সাদা পোশাকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি।

২০০২ সালে স্টিভ ওয়াহ এর অবসরের পর এবার অস্ট্রেলিয়া দল খুঁজতে থাকে তাদের নতুন দলনেতাকে। বিভিন্ন হিসাব মিলিয়ে রিকিকেই বেছে নেন নির্বাচকেরা। অধিনায়কত্ব লাভের পরেই তার সামনে আসে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ। দলের সেরা বোলার শেন ওয়ার্নের অনুপস্থিতিতেও টানা ১১ ম্যাচ অপরাজিত থেকে পন্টিংয়ের নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় টিম অজি।

পুরো সিরিজেই তার অধিনায়কত্বের পাশাপাশি ছিল অসাধারণ ব্যাটিং কৃতিত্ব। ফাইনালে মাত্র ১২১ বলে চারটি চার এবং আটটি ছয়ের সাহায্যে ১৪০* রানের ইনিংস খেলে ৩৫৯ রানের বড় পুঁজি এনে দেন অস্ট্রেলিয়াকে। এর ফলে অস্ট্রেলিয়া পায় ১২৫ রানের বড় জয়। অধিনায়কের ক্যারিয়ারেও তাঁর সফলতার ফুলঝুরি।

তিনিই একমাত্র অধিনায়ক যিনি অস্ট্রেলিয়াকে জিতিয়েছেন টানা দুইটি বিশ্বকাপ। তাঁর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া প্রথমবারের মত জিতে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। তিনিই অস্ট্রেলিয়াকে সবচেয়ে বেশি ওডিআই জিতিয়েছেন। তবে সমাপ্তিটা হলো ব্যর্থতা দিয়ে। ২০১১ সালে নিজেদের মাটিতে অ্যাশেজ হারার দায়ভার কাঁধে নিয়ে পন্টিং সরে দাঁড়ান অধিনায়কত্ব থেকে৷

অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক রিকি পন্টিং। পৃথিবীর ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান আর অধিনায়কের তকমাও জুটবে তাঁর নামের সাথেই। বলা হয়, পথচলার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হলো থামতে জানা৷ প্রায় পনেরো বছরের লম্বা ক্যারিয়ারের সময়োপযোগী ইতি টানতেও তাই কালক্ষেপণ করেননি।

২০১১ সালের বিশ্বকাপ ও অ্যাশেজ পরাজয়ের পর ২০১২ সালেই সবধরণের ক্রিকেট থেকে অবসরে যান তিনি। তবে খেলা ছাড়লেও পন্টিং মাঠ ছেড়ে দেননি। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট টিমের সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। ক্রিকেটের সাথেই তাঁর বসবাস!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...