আমিনুল ইসলাম বুলবুলরা অনেক চেষ্টা করেও চীনে ক্রিকেটের শেকড় তৈরি করতে পারেননি।
তবে ক্রিকেটে চীনের অবদানটা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। চায়নাম্যান বোলিংয়ের কথা তো জানেনই। আমরা বরং আম্পায়ারিংয়ে চীনের অবদানের কথা বলি। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন ক্রিকেট আম্পায়ার কিন্তু এই চীনের বংশোদ্ভুত!
তবে লোকে তাঁকে ক্যারিবিয়ান বলে জানে।
ক্রিকেট এবং ক্যারিবীয়ান জয়যাত্রা দুটো এগিয়েছে সমানতালে। কেবলমাত্র ক্রিকেটার নয় ভারত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ থেকে উঠে এসেছেন ডেভিড শেফার্ড, স্টিভ বাকনার, বিলি ডকট্রোভের মতো আম্পায়াররা। আম্পায়ার হিসেবে ক্রিকেট ইতিহাসে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন তাঁরা।
ক্রিকেট আম্পায়ারিং নিয়ে আলোচনা উঠলেই সবার প্রথমে মনে পড়ে তাদের নাম। কিন্তু সবাই ভুলে যায় তাঁদের অনুপ্রেরণাকে, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আম্পায়ারিংয়ের প্রবাদ পুরুষকে। তিনি ডগলাস সাং হিউ, ক্যারিবিয়ানের প্রথম আম্পায়ার।
টনি কোজিয়ার তাকে আখ্যায়িত করেন ক্রিকেট ‘আম্পায়ারিংয়ের প্রতিমূর্তি’ হিসেবে। যদিও সাং হিউ আকারে অতোটা লম্বা নন, মেরেকেটে সাড়ে পাঁচ ফুট হবেন। বেশিরভাগ সময় দেখা যেত ক্রিকেট মাঠে সবচেয়ে খাটো ব্যক্তি তিনিই। তবে মাঠে তার প্রভাব ছিল বিস্তর, ক্রিকেট নৈতিকতার দিক থেকে তিনি ছিলেন অনন্য।
সাং হিউ ছিলেন চীনা বংশোদ্ভূত ক্যারিবিয়ান। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ভারতের মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ দিয়ে আম্পায়ারিং এ হাতেখড়ি হয় তাঁর। সেই সিরিজে ক্যারিবিয়ানরা ৫-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে ভারতকে। তার চেয়ে কম বয়সে এখনো টেস্টে আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়াতে পারেননি কেউই।
১৯৭২-৭১ মৌসুমের ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফির সবগুলো ম্যাচে আম্পায়ারিং করেন তিনি। ফলে সৃষ্টি হয় নতুন রেকর্ড, তার আগেই কেউই এক সিরিজে টানা পাঁচ ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে সুযোগ পাননি। সে সিরিজ শেষে ইয়ান চ্যাপেল তাকে বিশ্বের সেরা আম্পায়ার হিসেবে স্বীকৃতি দেন। নিরপেক্ষ আম্পায়ার দিয়ে ম্যাচ পরিচালনা করা তখনো শুরু না হওয়ায় প্রায়ই আম্পায়ারদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠতো। সেই সময়ে প্রতিপক্ষের অধিনায়ক এমন বিবৃতি নি:সন্দেহে বড় পাওয়া।
তখনকার সময়ে জ্যামাইকা, বার্বাডোজ, ত্রিনিদাদের মাঝে ম্যাচগুলো তুমুল উত্তেজনা ছড়াতো ক্যারিবিয়ানদের মাঝে। আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিয়মিত দর্শকদের মাঝে মারামারি, হানাহানি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু দুই দশকের বেশি সময় ধরে আম্পায়ারিং করলেও পক্ষপাতিত্বমূলক কোনো সিদ্ধান্তের অভিযোগ ছিল না সাং হুয়ের বিপক্ষে। বরং তিনি মাঠে আছেন জানলে যেন আশ্বস্ত হতো দুই দলের সমর্থকরা।
সাং হিউয়ের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় টেস্ট বোধহয় কিংস্টনে ১৯৬৭-৬৮ মৌসুমে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ। প্রথম ইনিংসে কলিন কাউড্রের সেঞ্চুরিতে ৩৭৬ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় সফরকারীরা। জবাব দিতে নেমে জন স্নোর বোলিং তোপে পড়ে ১৪২ রানেই গুটিয়ে যায় স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফলোঅনে পড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য বেশ ভালোই খেলছিল ক্যারিবিয়ানরা।
ঘটনার সুত্রপাত ২০৪ রানে মাথায়, স্ট্রাইকে তখন ব্যাসিল বুচার। ব্যাসিল ডি’অলিভেইরার বলে তার করা লেগ গ্লান্স ঝাঁপিয়ে পড়ে লুফে নেন জিম পার্কস। সাথে সাথেই আঙুল তুলে দেন আম্পায়ার সাং হিউ। যদিও মাঠে উপস্থিত দর্শকরা তার সাথে একমত হতে পারেননি, রীতিমতো মাঠের বাইরে দাঙ্গা লেগে যায়।
বুচারকে ক্রিজে ফিরিয়ে আনার জন্য রীতিমতো স্টেডিয়ামে যুদ্ধাভাব সৃষ্টি হয়। তবে আম্পায়ার সাং হুয়ে ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে অটল। উইজডেন পরে ঘটনার বর্ণনায় লিখেছিল, সাং হুয়ে হলেন বিশ্বের সবচেয়ে পেশাদার আম্পায়ার।
তবে পাকিস্থানের বিপক্ষে একবার ৯৯ রানে রয় ফ্রেডেরিক্সকে আউট না দেবার অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। যদিও তিনি বরাবরই সে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। ক্যারি প্যাকারের বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড সিরিজেও আম্পায়ারিং করেছেন তিনি।
১৯৮০-৮১ মৌসুমের উইজডেন ট্রফির পরই মূলত আম্পায়ারিং থেকে অবসর নেন তিনি। যদিও ছয় বছর পর আবারো ফিরে এসেছিলেন অবসর ভেঙে, ঘরোয়া ক্রিকেটের আম্পায়ারিং করেছেন বছর দুয়েক। তিনি তার ক্যারিয়ারে মাত্র একটি একদিনের ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছেন। যদিও টেস্টে আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়িয়েছেন ৩১টি ম্যাচে।
ক্রিকেট মাঠে ছিলেন ভদ্রতা-নৈতিকতার প্রতিমূর্তি। আবেগকে দূরে সরিয়ে সবসময় চেষ্টা করেছেন সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে। কখনো পেরেছেন, কখনো পারেননি। কিন্তু ক্রিকেট রোমান্টিকদের চিরতরে জায়গা করে নিয়েছেন আই আম্পায়ার। ২০১৪ সালে ৮২ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন ডগলাস সাং হিউ।