না ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আমার প্রিয় ফুটবলার নন। এমন কি পছন্দেরও ফুটবলার নন। কিন্তু স্পোর্টিং লিসবোয়া থেকে নিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড হয়ে রিয়াল মাদ্রিদে যে সূর্য প্রকাশ পেলো, অন্য আকাশের খোঁজে জুভেন্তাসেও তিন বছর থেকে এবং শেষে ম্যান ইউনাইটেডেই ফিরে এল স্বপ্নে উড়াল ভরার জন্য, তাকে তো সেলাম করতেই হয়।
এই প্রজন্মের দুই সেরা ফুটবলার সিআর সেভেন এবং এলএম টেন। কিন্তু মেসির প্রতিভার স্ফুরণ যেখানে ঊষালগ্নেই, সেখানে ক্রিশ্চিয়ানো ধীরে ধীরে নিজেকে এক রোবোটিক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এই লেখাটায় তাঁর খেলার বিবর্তন নিয়ে কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করব।
তবে স্পোর্টিং লিসবনের দিনগুলোকে না। সেখানে সোনা কষ্টিপাথরে যাচাই হয়নি তখনও। তবু ম্যানচেস্টার ম্যাচে উইঙ্গার হিসাবে ভালো খেলার জন্যই ইউনাইটেড তুলে নিল ক্রিশ্চিয়ানোকে ২০০৩-এ।
এইসময় রোনালদো ছটফটে তরুণ প্রতিভা। প্রথম টাচটা খুব সাটল নয়, শোবোটিং করে। যদিও রাইট আউট হিসাবে দুর্দান্ত গতি উইং ব্যাকদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল কিন্তু ২০০৬ বিশ্বকাপের আগের রোনাল্ডো অন্য রকম। ৯৫ ম্যাচে মাত্র ১৮টা গোল।
২০০৬-এর বিশ্বকাপের পরেই বোধহয় পুরোপুরি বদলে গেলেন। ডিগডিগে চেহারার স্থান নিল পেটানো, পেশীবহুল অ্যাথলেটিক চেহারা। এই সময় সেই বিখ্যাত ড্রিবলিং আর স্টেপওভার খাপ খুলল। যদিও গোলস্কোরিং এবিলিটির বিকাশ হল ম্যান ইউয়ের শেষ বছরেই। তখনও উইং ধরেই খেলছেন, কিন্তু রুনির সঙ্গে বোঝাপড়া তখন চূড়ান্ত। ২০০৭-০৮এ তো ৪৯ টা ম্যাচে গোল করলেন ৪২ টা।
২০০৮-০৯ মৌসুমে গোড়ালির অপারেশনের জন্য প্রায় তিনমাস ফুটবল মিস করেও, ৫৩ টা ম্যাচে ২৬ গোল আর ১২টা অ্যাসিস্ট। উইং-এর গতিময় ড্রিবলিং-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে ফিনিশিং-এর তীক্ষ্ণতা।
আর এটাই বোধহয় রিয়াল মাদ্রিদকে প্রলুব্ধ করেছিল, ক্রিশ্চিয়ানোকে তাদের দলে নিতে। গ্যালাক্টিকো ২-এ। কাকা, ক্রিশ্চিয়ানো এবং করিম বেনজেমা। কাকা সেইসময় স্টুপেন্ডাস ফর্মে। মিলান আর ব্রাজিলের হয়ে। কিন্তু ম্যানুয়েল পেলিগ্রিনির অধীনে সিস্টেমটা একটু পালটে গেল।
মিলানে কাকা খেলতেন নাম্বার টেন জায়গায়। অর্থাৎ নাম্বার নাইনের ঠিক পিছনে। এখানে পেলিগ্রিনি খেলাতে শুরু করলেন লেফট উইং-এ, একটু ভিতরের দিকে। মাঝখানে বেনজেমা বা হিগুয়েন, একদম কপিবুক নাম্বার নাইন। আজকের লিভারপুলে যে খেলাটা ফার্মিনহো খেলেন ঠিক সেরকম। নিচ থেকে অপারেট করে রোনাল্ডো আর কাকাকে ইনসাইড আউট হিসাবে খেলতে দেবার সুযোগ করে দেওয়া। যাতে উইং ব্যাকরা অ্যাটাকের সময় আউটসাইড উইঙটা অপারেট করতে পারে এবং দুই ইনসাইড আউট গোল করার মতো অবস্থায় চলে যায়। বেঞ্জিমা ততক্ষণে টপ অব দ্য বক্সে।
এই সিস্টেমে কাকা মানাতে পারলেন না, তার উপর আহত হলেন। ক্রিশ্চিয়ানো কিন্তু মাদ্রিদের দ্বিতীয় বছর থেকেই বিশ্বমানের গোলস্কোরারে পরিণত হতে শুরু করেছেন। মাদ্রিদেই শুধু বিশ্বমানের নয়। সর্বকালের অন্যতম সেরা স্কোরারে পরিণত হলেন। রাইট ইনসাইড উইং পজিশনে খেলা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। কাকা সরে গেলে লেফট ইনসাইড উইঙটা হয়ে গেল রোনালদোর আর ডানদিক ডি মারিয়ার দখলে। সেটা দ্বিতীয় সিজন থেকেই। মাদ্রিদে খেলা ৪৩৮টি খেলায় ক্রিশ্চিয়ানো ৪৫০ টি গোল এবং ১৩১ টি অ্যাসিস্ট করে। মাদ্রিদের সর্বকালের সেরা হিসাবে ডি স্টেফানোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় চলে গেলেন।
২০১৩র পর গারেথ বেল টটেনহ্যাম থেকে মাদ্রিদে যোগ দিলে দুই ন্যারো উইং পজিশনে কার্লো আন্সেলত্তির কোচিং-এ খাপ খুললেন দুজনে। বেল আর রোনালদো। বেনজেমা তখন ভরকেন্দ্র। রোনালদো ব্যাকপোস্টের পোচার কাম হেডার কাম টপ অব দ্য বক্স গোল স্কোরার। বেল ডান দিকের উইঙের দিকে সরে গেলে বাঁদিকে মার্সেলো চলে আসতে শুরু করলে রোনাল্ডো তখন গোল স্কোরার হিসেবে ফার্স্ট অপশন হয়ে গেলো রোনালদো। এই সময় ড্রিবলিং কমে স্টেপওভার করে ওয়ান টাচে ওয়াল খেলে জায়গা করে গোলে দুরন্ত গতির শট আছড়ে পড়তে লাগল।
অথচ, কার্লো আনচেলত্তির পতন কিন্তু রোনালদোর প্রায় ভগবানের মত গোলস্কোরিং-এই লুকিয়ে ছিল। আসল ফর্মেশনে রোনালদো ন্যারো ইনসাইড লেফট খেলার কথা। কিন্তু মার্সেলোর বদান্যতায় রোনাল্ডো চলে যেতে শুরু করলেন ফার্স্ট পোস্টে, বামপ্রান্তিক আক্রমণে। ডানদিকে বেল তখনও কর্ণার ফ্ল্যাগ থেকে সেন্টার করছেন। আর রোনালদো ফলো করে দ্বিতীয় পোস্টে। ফরমেশনই পালটে গেল। এক বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এলো বটে। কিন্তু ফাইনালে রোনালদো পেনাল্টি ছাড়া কিছুই করতে পারলেন না।
এরপর মঞ্চে প্রবেশ করলেন জিনেদিন জিদান। বয়স বাড়ছে রোনালদোর। তাই উইং প্লে সম্পূর্ণভাবে চলে গেল মার্সেলোর দখলে। রোনালদো তখন রাইট ব্যাক আর ফুলব্যাক নয়, দুই ফুলব্যাকের মাঝে স্থির স্ট্রাইকার হিসাবে ফলস নাইনে। আসল নাইন বেঞ্জেমা দ্বিতীয় পোস্টে। বেলের চোট, ইস্কো অথবা আসেনসিও দুলছেন পেন্ডুলামের মতো দশ নম্বর পজিশনে। ডান দিকে কার্বাহাল। তার নিচে বিশ্বের সেরা মিডফিল্ড টনি ক্রুজ, লুকা মডরিচ এবং ক্যাসেমিরো।
রোনালদো প্রতিভার সঙ্গে সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন বয়সোচিত মেহনত। সাধারণ ৩০ বর্ষীয়রা যদি দু ঘন্টা খাটেন তিনি খাটেন চার। গতি, স্পট জাম্প এবং পাওয়ার বাড়িয়ে তিনি তখন বিশ্বের সেরা গোল স্কোরার। কিন্তু খেলা যত জটিল হচ্ছে, রোনালদোর প্রভাব ম্যাচে তত কম। শেষে নতুন চুক্তির সময় মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্টিনো পেরেজের সঙ্গে মনোমালিন্য এবং শেষ বয়সে নতুন মৃগয়ার খোঁজে ওল্ড লেডির দলভুক্ত হওয়া।
কিন্তু, এখানে এসে নতুন সমস্যা। জুভেন্টাসের প্রথম দলের ফরোয়ার্ড লাইন তখন মানজুকিচ, হিগুয়েন, দিবালা। রোনালদো এসে পৌঁছলে, গঞ্জালো হিগুয়েনকে ছেড়ে দিল জুভেন্টাস, চেলসিতে, লোনে। কিন্তু, শুরুতেই সংঘাত। মান্দজুকিচ বামদিকে, রোনালদো মাঝখানে আর দিবালা ডানে। মাঝখানে রোনালদোর নড়াচড়ার সুযোগ কমে গেল। বিস্ফোরক গতির কারণে উইং থেকে ভিতরে ঢুকতে সুবিধা ছিল, সে জায়গায় মানজুকিচ। সব মিলিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে আয়াক্সের বিরুদ্ধে গোল করেও নিষ্প্রভ রোনালদো এবং জুভেন্টাসের বিদায়।
পরের বছর সেই কারণে ৯ নম্বরে নিয়ে আসা হয় হিগুয়েনকে। মানজুকিচের বিদায়ের সূচক তৈরি। রোনালদো আবার বাম ইনসাইড উইং-এ প্রথম সুযোগ নিতে তৈরি। আর অ্যালেক্স সান্দ্রো বাম উইঙ ব্যাকে খেলতে শুরু করতেই গত মাস থেকে রোনালদোর গোল স্কোরিং সংখ্যায় বাড়ছে। কিন্তু ড্রিবলের সংখ্যা সেই ২০০৮-০৯ মৌসুমের রোনালদোর তুলনায় তলানিতে এসে ঠেকেছিল। সিরি ‘এ’ এলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে আবার ব্যর্থতা।
গত বছর বরং ডান দিকে দিয়ে অপারেট করার জন্য নিয়ে আসা হয় ফেদেরিকো কিয়েসাকে, সঙ্গে সেকেন্ড স্ট্রাইকার পজিশনে আলভেরো মোরাতাকে। কিন্তু ওয়েস্টন ম্যাককেনিই হোক বা অ্যারন র্যা মসে। রোনালদোর সঠিক ‘ফয়েল’ তৈরি হয়ে উঠতে পারেননি কেউই। ফলত: এতোদিনের স্কুডেটা, সেও হাত ফসকে ইন্টারের কাছে চলে গেল। সেরি আর সেরা খেলোয়াড়ও তুলে নিলেন লুকাকু। রোনালদোর হতাশা বাড়ছিল জুভেন্টাসে।
তাই সবাইকে চমকে দিয়ে এই মৌসুমে আবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। এবারে আপফ্রন্টে সঙ্গে গ্রিনউড, রাসফোর্ড, মার্শাল ও কাভানি। বল বাড়াবার জন্য উইং থেকে রয়েছেন স্যাঞ্চো, পিছন থেকে ব্রুনো ফার্নান্ডেজ ও পল পগবা। সঙ্গে রাফায়েল ভারানেও এসেছেন রিয়াল থেকে ডিফেন্স শক্ত করার জন্য। ৩৬-এর রোনালদো একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবেন নাকি!
রোনালদোর মত খেলোয়াড় লাখে একটা হয়। একটা সম্পূর্ণ প্রজন্মে একটাই হয়। যারা প্রতিভাকে ঘষে মেজে সূর্যের তেজের কাছাকাছি নিয়ে চলে যায়। মেসি আর রোনালদোকে নিয়ে তর্ক দুই ফ্যানক্লাবের চলতেই থাকুক কিন্তু এই প্রজন্ম যে ভাগ্যবান যে তারা মেসি আর রোনালদোকে একই সময়ে দেখেছে তা ভুললে চলবে?
একটা সময় ফুটবলে ৩০ মানেই অবসর জীবনের চিন্তা মাথায় ছিল। এখন, স্পোর্টস মেডিসিন এবং ফিজিক্যাল ট্রেনিং-এর প্রভূত উন্নতির কারণে মধ্য তিরিশেও সিরিয়াস ও সচেতন ফুটবলাররা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচ তো ৩৮এ মিলানে ফিরে এসে ক্লাবটাকে গহ্বরের খাদ থেকে টেনে তুলছেন। মেসি বছর তিনেকের ছোট হয়েও বার্সা কাঁপিয়ে পিএসজিতে চলে গিয়েছেন।
কিন্তু ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো? তিনি তো কখনই নিশ্চিন্তের আশ্রয়ে বছরের পর বছর থেকে যাননি। যখনই দেখেছেন মরচে পড়ছে তীক্ষ্ণতায়। বা একঘেয়েমি পেয়ে বসছে। তখনই আকাশ মাটি পালটে ফেলে উঠে পড়ে লেগেছেন নিজেকে প্রমাণ করতে। লিডারশিপ অ্যাবিলিটি ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে, ২০১৬’র ইউরো কাপ এবং নেশনস লিগে।
আশা করছি, আগামী ইউরোতেও বা আসন্ন চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বুড়ো বয়সে শুধুমাত্র নাম্বার নাইন হিসেবেই ঝলকানি দেখাবেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো দস স্যান্তোস আভেইরো। অন্তত: চেষ্টার যে খামতি থাকবে না যেখান থেকে চলার শুরু ছিল তাকে আবার শিখরে পৌঁছনোয় তা হলফ করে বলা যায়। মৌসুমের প্রথম দুই ম্যাচ আপামর ম্যানইউ সমর্থককে স্বপ্ন দেখাচ্ছে কিন্তু।
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক