কোথায় পাবো তাঁরে!

তারুণ্যের নয়া স্পর্ধা হয়ে জুবায়ের হোসেন লিখন এসেছেন তখন বাংলাদেশের ক্রিকেটে।

বাংলাদেশের জন্য সেটা নতুন এক অভিজ্ঞতা। এর আগে তো আমরা সেরকম লেগস্পিনার পাইনি। তাই ঠিক করলাম, লেগ স্পিন নিয়ে একটা লেখা লিখবো। কিন্তু কী লিখবো? আমি জানিটা কী!

প্রেসবক্সে  তখন সবাই যার যার লেখা নিয়ে ব্যস্ত। কাউকে বিরক্ত করতে সাহস হচ্ছে না। ইতস্তত ঘুরছি, মাথা চুলকে মরছি। তখন তিনি ডাক দিলেন, ‘দেবু, কোনো সমস্যা?’

আমি করুণ হেসে বললাম, ‘লেগ স্পিন নিয়ে একটু বলবেন? আমি একটা লেখা লিখবো।’

তিনি এক গাল হেসে বললেন, ‘আমি নিজেও তো তেমন কিছু জানি না। যাক, কাছে আসো। যা জানি, বলছি।’

তিনি বলা শুরু করলেন।

বিল ও’রিলি, ক্লারি গ্রিমেট, সুভাষ গুপ্তে, চন্দ্রশেখর হয়ে আব্দুল কাদির, শেন ওয়ার্ন …। তিনি বলে চলেছেন। যেন মুখে মুখে এক শিল্প রচনা করে চলেছেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছি। তিনি লেগস্পিনের জাদুকরী সব কৌশলের কথা বলছেন; যেন কোনো শ্লোক আওড়াচ্ছেন।

এক সময় কথা শেষ হয়ে এলো। তিনি সেই ঘোরের মধ্যে থেকেই বললেন-লেগস্পিনারদের বরং তুমি কব্জি জাদুকর বলতে পারো।

আমার মুখ থেকে একটাই শব্দ বেরিয়ে এল – আচার্য্য।

হ্যা, তিনি ছিলেন এক আচার্য্য। ক্রিকেটারদের জন্য তিনি ক্রিকেট কোচ, সাংবাদিকদের জন্য তিনি সাংবাদিকতার গুরু, সঙ্গীতপ্রেমীর কাছে তিনি একজন সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ, সাহিত্যপ্রেমীর কাছে তিনি একজন নিবিষ্ঠ পাঠক। তিনি এক ও অদ্বিতীয় জালাল আহমেদ চৌধুরী।

জালাল আহমেদ চৌধুরী নিজে নিজেকে  ‘একজন ক্রিকেটার’ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। বলতেন, ‘কোচ, লেখক; সবকিছুর আগে তো আমি ক্রিকেটার। ক্রিকেটার মানে একজন খেলোয়াড় কেবল নয়। ক্রিকেটার একজন শুদ্ধাচারী ক্রিকেট ভক্ত। আমি তাই নিজেকে ক্রিকেটার বলি।’

জালাল আহমেদ চৌধুরীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় পত্রিকার পাতায়।

মফস্বলের ছেলে আমি। পত্রিকার পাতায় ভারী ভারী লেখা পড়ে মাথাকে বোঝাই করি। নিতান্ত রস খুজতে মতি নন্দীর দ্বারস্ত হই। সেই সময়ই আবিষ্কার করেছিলা, এই বাংলায় মধুরতম ক্রীড়া লেখনী। হ্যা, আমি আদালতে গিয়েও জবানবন্দী দিতে রাজী আছি যে, জালাল আহমেদ চৌধুরীর চেয়ে মধুর লেখা, মুগ্ধকর লেখা বাংলায় খেলাধুলা নিয়ে আর কেউ কখনো লেখেননি।

তার লেখায় ভারী ভারী শব্দ দিয়ে লোকেদের কাঁধে চেপে বসার ব্যাপারটা ছিল না। আমাদের মত ‘আমিত্ব’ ভরপুর লেখা ছিলো না। ছিলো ছন্দ, ছিল সুর।

একবার বান্দরবন গিয়েছিলেন একটা ক্যাম্প পরিচালনা করতে। সেখান থেকে এসে প্রথম আলোতে একটা লেখা লিখেছিলেন। সেই লেখায় বান্দরবনের আকা-বাঁকা, উচু-নিচু পথের বর্ণনা ছিলো। প্রতিটি লাইনে ওই পথের দুলুনি, ওই সবুজের হাতছানি টের পাওয়া যাচ্ছিলো। লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছিলো, আমি যেন বান্দরবন ঘুরছি।

ততোদিনে জালাল ভাইয়ের সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছে, একটু আড্ডাও হয়েছে।

তখনও জালাল ভাই নিজে লিখতেন। প্রেসবক্সে আসতেন নিয়ম করে। সেই সাথে প্রেসবক্সের পেছনটায় তাকে কেন্দ্র করে জমে উঠত ক্রিকেট, গান কিংবা সাহিত্য নিয়ে আড্ডা। শেষ দিকে লিখতেন না। শরীরে কুলাতো না। তারপরও জোর করে প্রেসবক্সে চলে আসতেন।

খেলার বিরতিতে ধুমপানের জায়গাটা আমাদের জন্য শিক্ষার আসরে পরিণত হতো।

জালাল ভাই কখনোই বেশি কথার মানুষ ছিলেন না। আমাদের একটা সাধারণ ধারণা হলো, আড্ডা জমাতে হলে অনেক কথা বলতে হয়, বাচাল হতে হয়। কিন্তু জালাল ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। আস্তে বলতেন, কম বলতেন; কিন্তু সকলে তার কথা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকবেন।

মাশরাফি থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় আড্ডাবাজকে দেখেছি, জালাল ভাইয়ের সামনে নত হয়ে তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে। ক্রিকেটাররা অপেক্ষায় থাকতেন, তার কাছ থেকে আরেকটা কিছু শিখে নেওয়ার জন্য। শেষবার কলাবাগানে যখন কোচিং করালেন, তখনও দেখেছি ক্রিকেটাররা কী মান্য করতেন এই মানুষটিকে।

আর আমাদের কথা তো বলাই বাহুল্য।

জালাল ভাইয়ের শ্রেষ্ঠতম গুন ছিলো বিনয়। ক্রিকেট বিদ্যায় তিনি যে কারো সমান বা বড় ছিলেন। লেখালিখিতে তিনি সব্যসাচী ছিলেন। সঙ্গীত ও সাহিত্য নিয়ে ছিলো অগাধ ধারণা। বাংলা ক্লাসিক, ইংরেজি সাহিত্যে সমান বিচরণ। কিন্তু এই লোকটিকে দেখে আপনার নিতান্ত মাটির মানুষ ছাড়া কিছু মনে হবে না।

দেশের প্রথম বিসিএসে পাশ করেও ক্রিকেটের টানে ময়দানে ফিরেছিলেন। পাতিয়ালায় কোর্স করতে গিয়ে প্রথম হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তার আচার আচরণে এর কোনো অহং বোধ ছিলো না।

আরেকটা বড় ব্যাপার হলো, ভেদাভেদহীন একটা মানুষ ছিলেন।

তার কাছে টেলিগ্রাফও যা, খেলা ৭১-ও তাই। তার কাছে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানও যা, আজকের তরুণ বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানও তাই। তার কাছে নেভিল কার্ডাসও যা, দেবব্রতও তাই। এমন না যে, গুনের পার্থক্য তিনি বুঝতেন না। বুঝতেন। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে এনে কাউকে ছোট করতে পারতেন না। প্রতিটি মানুষ তার কাছে সৃষ্ঠির সমান সেরা জীব ছিলো।

তাই জালাল আহমেদ চৌধুরীর কাছে ছোট-বড় বলে কিছু ছিলো না।

মজার ব্যাপার হলো, জালাল ভাই সারাজীবন সাংবাদিকতা করেছেন ইংরেজি কাগজে। অথচ বাংলা লেখাতেও তার ধারে কাছে কারো জন্য যাওয়া কঠিন ছিলো।

জালাল ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা আরও একটু নিবিঢ় হলো করোনার সর্বশেষ ঢেউয়ের সময়। আমি দু মাস গ্রামের বাড়ি ছিলাম। রোজ রাতে আমরা নিয়ম করে ফোনে আলাপ করতাম। আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ধরে গল্প করতাম। আমার অবশ্য একটু স্বার্থের লোভ ছিল।

জালাল ভাইকে বলেছিলাম, তাঁর একটা জীবনী ধরণের বই করতে চাই। অনেক আপত্তির পর রাজি হয়েছিলেন। একদিন ঘন্টা আধেক রেকর্ডিংও করেছিলাম; কথা ছিলো ঢাকায় এসে পুরোদমে কাজ শুরু করবো।

তা হলো না। কতো কিছুই তো হলো না।

সর্বশেষ বইটা লিখেছিলাম অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপ জয় নিয়ে। জালাল আহমেদ চৌধুরী ছাড়া এই অনন্য কীর্তির বইটা কাকে উৎসর্গ করা যেতো! ফোনে শুধু বলেছিলাম, একটা সারপ্রাইজ আছে। নিয়ে বাসায় আসবো।

হল না।

কী একটা আশঙ্কায় পড়েছিলাম। হাসপাতালে ভর্তির পর উৎসর্গপত্রটা কপি করে পাঠিয়েছিলাম। তিনি একটু বোধহয় বিব্রত হয়েছিলেন। আনন্দমাখা স্বরে বলেছিলেন, বইটার জন্য অপেক্ষা করছেন। জালাল ভাই, বইটা এখন আমি কার হাতে দেবো?

আমি এখন কোথায় পাবো আপনাকে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link