সাল ২০০৯।
লাহোরে তৃতীয় টেস্টের সেদিনের খেলায় মুখোমুখি হওয়ার কথা পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার। হোটেল থেকে টিম বাস বের হবার পরই মাঝ রাস্তায় জঙ্গিবাদীদের হামলা। গোলাগুলিতে ৬ নিরাপত্তারক্ষী নিহত! লঙ্কান খেলোয়াড়েরা সবাই তখন বাসে নিচে শুয়ে পড়েছেন।
কি ঘটছে, কিছু সময়ের জন্য নিজেরাও যেনো বুঝতে পারছিলেন না! সেদিন সবাই প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলেন। তবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন থিলান সামারাবিরা। গোলাগুলির মাঝে ১২ ইঞ্চির একটু বুলেট এসে আঘাত হানে সামারাবিরার হাঁটুতে!
চিকিৎসকরা বলেছিলেন তিনি আর ক্রিকেটে ফিরতে পারবেন না। ব্যাপারটায় বেশ ধাক্কা লাগে সামারাবিরার। কিন্তু মাস চারেক পরই সেই বিভিষীকাময় ট্রমা কাটিয়ে ঠিক মাঠে ফিরেছিলেন তিনি। সেদিন সেই হামলায় ভিন্ন কিছুও হতে পারতো তাঁর জীবনে! সেই বুলেটের ক্ষতের দাগ নিয়েই খেলে গেছেন ক্যারিয়ারের বাকিটা সময়। সাদা পোশাকে ছিলেন মিডল অর্ডারে লঙ্কানদের অন্যতম ভরসা।
সামারাবিরার কথা আসলে এখনও বিস্ময়ের সাথে মনে হয়, তিনি প্রতি বল খেলার পর গ্লাভস খুলে ঠিক করতেন কেনো!
সব ক্রিকেটারেরই নিজস্ব স্টাইল কিংবা ধরণ থাকে। আর ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্যময় কিছু জিনিসের কারণেই কিছু খেলোয়াড়েরা বিশেষভাবে সবার মনে থাকে। তেমনি ছিলেন সামারাবিরাও। সামারিবার একটা স্টাইলই ছিলো প্রতি বল পরই গ্লাভসের গ্রিপ খুলে মুখের কাছে নেয়াটা!
লঙ্কান ক্রিকেটে সেসয়ের ‘ক্রাইসিস ম্যান’ হিসেবেই তিনি পরিচিত। দুঃসময়ে ব্যাট হাতে দলের ভরসা হয়ে উঠতেন হরহামেশাই!
১৯৯৮ সালে ভারতের বিপক্ষে শারজাহতে ওয়ানডে অভিষেক। রঙিন জার্সিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণের তিন বছরের মাথায় জায়গা পান টেস্ট দলেও। রঙিন জার্সিতে নিজেকে রাঙাতে না পারলেও টেস্টে ছিলেন বেশ উজ্জ্বল। অভিষেক টেস্টেই আটে ব্যাট করতে নেমে জুড়ে দেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি! লোয়ার অর্ডারে নেমে সামারাবিরার সেঞ্চুরিটা একটু বেশিই নজরে কেঁড়েছিলো নির্বাচকদের।
কারণ তিনি যে দলে স্পিন কোটায় খেলছিলেন! হ্যাঁ, মিডল অর্ডারে লঙ্কানদের অন্যতম সেরা এই অস্ত্র এক সময় ছিলেন স্রেফ একজন স্পিন বোলার। এমনকি ওয়ানডে অভিষেকে ৭ উইকেট পড়ার পরেও তিনি ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাননি! তিনি ছিলেন দশম ব্যাটসম্যান।
পরবর্তীতে আট এমনকি এগারো নম্বরেও তিনি ব্যাট করেছে! টেস্টেও সেই স্পিনার কোটা’তেই খেলেছিলেন। তখন অবশ্য মুত্তিয়া মুরালিধরনের মতো তারকা স্পিনার ছিলো লঙ্কান দলে। শুধু স্পিনার হিসেবে তখন দলে সুযোগ পাওয়াটা অনেকটাই ছিলো আকাশ-কুসুম ভাবনার মতো। তাই ব্যাটিংয়ে বেশ সময় দেন সামারাবিরা। পরিশ্রমও করেছিলেন বেশ!
ধীরে ধীরে নিজেকে আবিষ্কার করেন একজন পিউর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে। নিজের মাঝে এই পরিবর্তনটা না আনতে পারলে হয়তো টেস্টেও ক্যারিয়ারটা লম্বা করতে পারতেন না তিনি। ক্যারিয়ারটা তিনশো ষাট ডিগ্রি মোড় নেয় ভারতের বিপক্ষে অভিষেকের সেই সেঞ্চুরির পর!
নিজের ব্যাটিং সামর্থ্য অভিষেক ম্যাচেই প্রমাণ করেছিলেন থিলান। অভিষেক ম্যাচের কয়েক ম্যাচ বাদেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লোয়ার অর্ডারে দারুন এক ফিফটিও করেছিলেন। সেখান থেকেই মূলত ধীরে ধীরে মিডল অর্ডারে উঠে আসা সামারাবিরার।
ক্রিকেট পরিবার থেকেই উঠে এসেছিলেন সামারাবিরা। ১৯৯৩-৯৫ এর মাঝে তার বড় ভাই দুলিপ সামারাবিরাও শ্রীলঙ্কার হয়ে সাত টেস্ট ও পাঁচ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। তবে, ক্যারিয়ারটা লম্বা করতে পেরেছিলেন থিলান সামারাবিরাই। টেস্ট ক্রিকেটটাই তাঁর টেকনিকের সাথে ছিলো যুঁথসুঁই। দলের বিপর্যয়ে প্রায়শই ত্রানকর্তা হিসেবে রূপ নিতেন তিনি।
২০০৪ সালে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে সিরিজের প্রথম টেস্টে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৯ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে লঙ্কানরা। বিপদের সময় ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হন সামারাবিরা। তাঁর করা সেঞ্চুরিতে ২৪৩ রান করতে সক্ষম হয় লঙ্কানরা। ওই ইনিংসের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ঘুরে দাঁড়ায় লঙ্কানরা। সনাত জয়সুরিয়ার ডাবল সেঞ্চুরিতে ২০১ রানের জয় তুলে নেয় সফরকারী শ্রীলঙ্কা।
২০০৮ সালে পোর্ট অব স্পেন টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে ১৬ রানে পিছিয়ে তখন লঙ্কানরা। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ৩২ রানে ৪ এবং ৯৯ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ম্যাচে তখন চরম বিপাকে লঙ্কানরা। সেখান থেকে সামারাবিরার ১২৫ রানের অনবদ্য ইনিংসে ২৩৮ রানের লিড পায় সফরকারীরা। ওই টেস্টে ৬ উইকেটে হারলেও সামারাবিরার ইনিংসেই মান রক্ষা হয় লঙ্কানদের।
পরবর্তীতে ২০১০ সালে ভারতের লঙ্কা সফর। সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে স্বাগতিকরা। তৃতীয় টেস্টে কলম্বোতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে সামারাবিরার ১৩৭ রানের অপরাজিত ইনিংসে ৪২৫ রানে থামে লঙ্কানদের ইনিংস। প্রথম ইনিংসে ভারত ৪৩৬ রান করলে লিড পায় ১১ রানের!
সেখান থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ৮৭ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে লঙ্কানরা। খাদের কিনারা থেকে দলকে উদ্ধার করে ৮৭ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন তিনি। ২৬৭ রানে লঙ্কানরা গুড়িয়ে গেলে ৫ উইকেটের জয় পায় ভারত।
এরপর ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ডারবানে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে ১৬৫ রানে ৫ উইকেট হায়ায় লঙ্কানরা। সেখান থেকে সামারাবিরার সেঞ্চুরিতে ৩৩৮ রান সংগ্রহ করে সফরকারীরা! শেষ উইকেটে ১০২ রানে আউট হন সামারাবিরা। ওই টেস্টে ২০৮ রানের বিশাল ব্যবধানে জয় পায় লঙ্কানরা। দ্বিতীয় ইনিংসেও তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪৩ রান করেন সামারাবিরা।
পরের টেস্টেই ক্যাপটাউনে প্রথমে ব্যাট করে দক্ষিণ আফ্রিকা ৫৮০ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করায়। জবাবে নিজেদের প্রথম ইনিংসে মাত্র ২৩৯ রানে গুড়িয়ে গেলে ফলোয়ানে পড়ে লঙ্কানরা। প্রথম ইনিংসে ৩৪১ রানে পিছিয়ে থেকে ব্যাট করতে নেমে ৯৮ রানে ৪ উইকেট হারায় সফরকারীরা।
সেখান থেকে সামারাবিরার অপরাজিত ১১৫ রানে ৩৪২ রানে অলআউট হয় শ্রীলঙ্কা। মাত্র ২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ১০ উইকেটের জয় প্রায় প্রোটিয়ারা। সেদিন সামারাবিরার ইনিংসেই ইনিংস ব্যবধানে হার এড়ায় লঙ্কানরা।
টেস্ট ক্যারিয়ারে তিনি বরাবরই লঙ্কানদের ক্রাইসিস ম্যান হিসেবেই কাজ করেছেন। দলের বিপর্যয়ে ক্রিজে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি। তবে রঙিন পোশাকে ঠিক মেলে ধরতে পারেননি সামারাবিরা।
৫৩ ওয়ানডেতে মাত্র ২৮ গড়ে করেছেন ৮৫২ রান! আছে দুইটি সেঞ্চুরিও। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে নিয়ে গেছেন লঙ্কানদের সেরা তালিকায়। ১৩২ টেস্টে প্রায় ৪৯ গড়ে রান করেছেন ৫৪৬২! ১৪ সেঞ্চুরির পাশাপাশি করেছেন ৩০টি ফিফটি।
২০০৫-০৬ মৌসুমে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময় পার করেন তিনি। ১৪ ইনিংসে মাত্র চারবার দুই অঙ্কের কোটা পেরোয় সেবার! এরপর প্রায় দেড় বছরের জন্য দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। ঠিক এর উলটো চিত্র ছিলো ২০০৯ সালে। ১১ টেস্টে প্রায় ৭৩ গড়ে ১২৩৪ রান করেন তিনি!
৪ সেঞ্চুরির মাঝে দু’টি রূপান্তর করেন ডাবল সেঞ্চুরিতে। যার মধ্যে দুটি ছিলো পাকিস্তানের বিপক্ষে। ওই মৌসুমকে সামারাবিরার ক্যারিয়ারের সেরা সময় বলা হয়। একই বছর মাহেলা জয়বর্ধনের সাথে চতুর্থ উইকেটে ৪৩৭ রানের জুটি গড়েন তিনি! যা এখনো পর্যন্ত বিশ্বরেকর্ড!
সামারাবিরাকে বলা হতো এশিয়ান ট্র্যাক বুলি! পরিসংখ্যান ঘাটলে মনে হবে এই মিথটা পুরোপুরি সত্যি! এশিয়ার মাটিতে ৬০ টেস্টে ৫৪ গড়ে ১১ সেঞ্চুরিতে ৪২৭৫ রান করেন তিনি! অপরদিকে, এশিয়ার বাইরে ২১ টেস্টে ৩৬ গড়ে প্রায় ১২০০ এর কাছাকাছি রান করেন। এশিয়ার বাইরে করেছেন মোটে ৩ সেঞ্চুরি!
২০১২ সালে বাজে পারফরম্যান্সের পর বাদ পড়েন তিনি! পরের বাংলাদেশ সফরে আশায় থাকলেও ডাক পাননি তিনি। আক্ষেপও করেছিলেন অবশ্য! এরপর ২০১৩ সালের মার্চে ঘোষণা দেন ক্রিকেট ক্যারিয়ার থেকে বিদায়ের।
২০০৯ সালে লাহোরে হামলার পর আবারো ক্যারিয়ারে ঘুরে দাঁড়ানোটা মোটেও সহজ ছিলোনা সামারাবিরার। মিডল অর্ডারে বহু ম্যাচে লঙ্কানদের বিপদে একাই লড়াই করেছেন তিনি। টেস্ট ক্যারিয়ারটা করতে পারতেন আরো লম্বা। ছিলেন বেশ ধারাবাহিকও। লঙ্কান ক্রিকেটের এই ‘ক্রাইসিস ম্যান’ সার্ভিসটা মিডল অর্ডারে এখনো বেশ ভোগাচ্ছে লঙ্কানদের!