২৭ বলে ৪১ রান – এখনকার টি-টোয়েন্টির প্রেক্ষাপটে খুব অভিনব কিছু নয়। তবে, ম্যাচটা যদি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) নিজেরে অভিষেক ম্যাচ হয় তাহলে কিছুটা হলেও মানুষটার দিকে লাইমলাইট আসতে বাধ্য। মানুষটা হলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের নবাগত ওপেনার ভেঙ্কটেশ আইয়ার, প্রতিপক্ষ রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু।
কে এই ভেঙ্কটেশ আইয়ার? এর আগে যার নামও শোনা যায়নি আইপিএলের মঞ্চে, তিনি কিনা প্রথম ম্যাচে খেলতে নেমেই নজর কাঁড়লেন সবার! এক মৌসুম আগেও যিনি ছিলেন একজন মিডল অর্ডার ব্যাটার; তিনিই কিনা এখন ওপেনিংয়ে নিয়মিত মুখ! অবশ্য এর পেছনে মধ্যপ্রদেশের কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতের অবদানটাই বেশি।
মধ্যপ্রদেশের হয়েই ঘরোয়া ক্রিকেটে বিচরণ আইয়ারের। লোয়ার মিডল অর্ডারে বেশ দুর্দান্ত খেলছিলেন তিনি। এটি অবশ্য কোচেরও নজর এড়ায়নি। এরপর গেলো আসরের সৈয়দ মুশতাক আলিী ট্রফিতে কোচ চন্দ্রকান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন আইয়ারকে ওপেনিংয়ে জায়গা হবে।
আইয়ার অবশ্য এই সিদ্ধান্তে রাজি ছিলেন না। তিনি জানতেন ওপেনিংয়ে গেলে তাঁকে নতুন বল ফেস করতে হবে, আর সেখানে ব্যর্থ হলে জায়গা হারাতে হবে দলে! চন্দ্রকান্ত ভাবতেন লোয়ার অর্ডারে আইয়ারের প্রতিভা আর সামর্থ্যের পুরোটাই অপচয় হচ্ছে। তাঁর ব্যাট স্পিড, পাওয়ার স্ট্রোক সব মিলিয়ে কোচ চাচ্ছিলেন আইয়ার ওপেন করুক।
বীরেন্দ শেবাগকে ভারতের ওপেনার হিসেবে প্রোমোট করতে চেয়েছিলেন তৎকালীন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। শেবাগ তখন সৌরভকে বলেছিলেন আমি ওপেন করতে চাই না। দাদাও জবাব দেন, ‘মিডল অর্ডারে আমি (সৌরভ), শচীন, কাইফ, লক্ষ্মণরা আছে। তুই মিডল অর্ডারে সুযোগ পাবি না, বেঞ্চেই কাটাতে হবে।’
শেবাগ তখন বলেছিলেন, ‘আমি ওপেন করবো যদি আমি ওপেনিংয়ে ব্যর্থ হলেও আমাকে আবার সুযোগ দেন তাহলেই। এবং আমাকে এটা লিখিতো দেন।’ শেবাগ ছিলেন নাছোড়বান্দা। দাদার কাছ থেকে এই কথাটা কাগজে লিখিত নিয়েছিলেন তিনি! অবশ্য এরপর আর কখনো এমন পরিস্থিতি আসেনি যে শেবাগকে মিডল অর্ডারে ফেরত আসতে হবে! ওপেনিংয়ে তাঁর ব্যাটিং ক্যারিয়ারে এক ভিন্ন মোড় এনে দেয়।
ভেঙ্কটেশ আইয়ারের ক্ষেত্রেও ঘটেছিলো ঠিক এমনি কিছু। চন্দ্রকান্ত আইয়ারকে আশ্বস্ত করলেন ওপেনিংয়ে যদি পাঁচ ম্যাচে ডাকও মারেন তবুও তাঁকে দল থেকে বাদ দেওয়া হবে না! এই আশ্বাসের পরই ওপেনিং করেন আইয়ার। শেবাগের মতোই দ্বিতীয়বার আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আইয়ারকে। দুর্দান্ত মৌসুম কাটিয়ে ওপেনিংয়ে জায়গাটা পাঁকা করে ফেলেন তিনি। ৫ ম্যাচে প্রায় ১৫০ স্ট্রাইক রেটে ২২৭ রান করেন আইয়ার! বিজয় হাজারে ট্রফিতেও পাঞ্জাবের বিপক্ষে ১৪৬ বলে ১৯৮ রানের তাণ্ডবময় ইনিংস খেলেন আইয়ার!
এরপরই আইয়ারের সামনে এল আইপিএলে খেলার সুযোগ! মুম্বাইয়ে কলকাতা নাইট রাইডার্সের পক্ষ থেকে তাঁকে ডাকা হলো ট্রায়ালের জন্য। আর সেখানেই ভাগ্য খুলে যায় আইয়ারের। প্রথমবারের মতো আইপিএলে চুক্তিবদ্ধ হলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে। তবে, এর আগে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি পাড়ি দিয়েছেন লম্বা পথ।
আইপিএলে দল পাবার বছর তিনেক আগে ২০১৮ সালে ভারতের টপ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি থেকে চাকরির অফার পান আইয়ার। বেশ উচ্চ বেতনের চাকরিই ছিলো। ফাইন্যান্স নিয়ে তখন এমবিএ করছিলেন তিনি। কিন্তু আইয়ারের ফোকাস সম্পূর্ণটাই ছিলো ক্রিকেটের উপর। ক্রিকেটেই গড়তে চেয়েছিলেন ক্যারিয়ার!
জানতেন চাকরিতে গেলে ক্রিকেট ক্যারিয়ার সেখানেই থমকে যাবে। তাই চটজলদি সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধা করেননি তিনি। উচ্চ বেতনের চাকুরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে পড়ে রইলেন মাঠেই। তবে, ডিগ্রি নিতে এমবিএ শেষ করতে চেয়েছিলেন আইয়ার। অবশ্য এর কিছু সময় পরই রঞ্জি ট্রফিতে মধ্যপ্রদেশের হয়ে অভিষিক্ত হন তিনি।
রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেকের আগে একবার কঠিন সময় পার করছিলেন আইয়ার! পরীক্ষা ও ম্যাচ দুটোই একসাথে! ছত্রিশগড়ের সাথে তখন প্রস্তুতি ম্যাচ খেলছিলো মধ্যপ্রদেশ। সেসময় আইয়ারের এমবিএ ইন্টারন্যাল পরীক্ষাও চলছিলো। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন একসাথে পরীক্ষাও দিবেন আবার ম্যাচও খেলবেন! একসাথে দুই কাজ হয় না ছোটবেলা থেকেই আমরা বাবা-মা’র মুখে শুনে এসেছি। আইয়ার হয়তো এমন কিছু শুনেননি! তাই, একসাথে দুই কাজই তিনি করে দেখালেন!
তিনদিনের প্রস্তুতি ম্যাচের প্রথমটটায় বেশ অল্প রানেই আউট হন আইয়ার। দ্বিতীয় ম্যাচের সময় ইন্টারন্যাল পরীক্ষা চলছিলো। প্রথমে কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দেন তিনি, এরপর সেখান থেকে ট্রাফিক জ্যাম পেরিয়ে মাঠে পৌঁছে দেখেন ৬০ রানে দলের তখন ৬ উইকেট! বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর আরো ভালো লিখতে পারতেন এমন ভাবনায় মগ্ন যখন আইয়ার, দলের অবস্থা তখন বেগতিক।
ওইদিন ব্যাট করতে নেমে খেললেন অপরাজিত ৯৬ রানের ইনিংস! পরের দিন ব্যাট করতে নেমে ১৩২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে আউট হন আইয়ার। আর দুপুরের শেষ ভাগে কলেজে গিয়ে পরের দিনের পরীক্ষায় অংশও নেন তিনি! ওই ম্যাচের পরই রঞ্জি ট্রফিতে অভিষিক্ত হন আইয়ার।
আইয়ারের বাবা ছিলেন একজন সিনিয়র এইচআর কনসাল্টেন্ট ও মা হসপিটাল ম্যানেজমেন্টের কাজ করতেন। আইয়ার নিজেও পড়ালেখায় ছিলেন বেশ মেধাবি। তাই পড়াশোনার বাইরে ক্রিকেট নিয়ে মোটেও পড়ে থাকার সুযোগ ছিলো না তাঁর। অবশ্য এই ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন পান মায়ের কাছ থেকে। মায়ের পূর্ণ সমর্থনেই ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখেন আইয়ার।
বি.কম ডিগ্রির পাশাপাশি করছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট (সি.এ) ডিগ্রিটাও। ২০১৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন আইয়ার। সি.এ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলে তখন ক্রিকেটটা কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে হতো। সেসময় মধ্যপ্রদেশের হয়ে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে খেলছিলেন তিনি। এমনকি ওই রাজ্যের অনূর্ধ্ব ২৩ দলের অধিনায়কও ছিলেন তিনি!
সিদ্ধান্ত নিলেন সি.এ ছেড়ে দিবেন! আর ফাইন্যান্সের উপর এমবিএ ডিগ্রি করবেন। বেশ কয়েক দফা চেষ্টায় একটি ভালো কলেজে সুযোগও পেয়ে গেলেন। সৌভাগ্যক্রমে ওই ফ্যাকাল্টি ক্রিকেট বেশ পছন্দও করতো! যার কারণে পরীক্ষা কিংবা ক্লাস না করেও খেলার জন্য ছুটি পেতেন তিনি। এমনকি তাঁর জন্য পুন:পরীক্ষাও নেওয়া হতো!
তিনি বরাবরই বেশ ভালো ছাত্র ছিলেন। পড়ার জন্য অল্প সময় পেলেও নিজের পাঠ্যবই শেষ করে ফেলতেন! ক্রিকেটে ক্যারিয়ার না গড়লে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) কিংবা ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে(আইআইএম) পড়ার ইচ্ছে ছিলো তাঁর! ক্রিকেট মাঠে প্রায়শই অনুশীলনে ব্যস্ত থাকতেন তিনি। মাত্র দু’ঘন্টা কলেজে গেলেও নিজের পড়াটা অনায়াসেই শেষ করে ফেলতেন তিনি! ইন্দোরে বৃষ্টির মৌসুমে তিনি চেন্নাইতে যেয়ে লিগ ক্রিকেটে খেলতেন। আর অবসর সময়ে পড়ালেখাটাও বেশ জোরেশোরে চালিয়ে যেতেন আইয়ার।
পরিকল্পনার ‘সাবস্টিটিউট’বা বিকল্প পরিকল্পনা যদি বলি সেটাই ছিলো আইয়ারের কাছে। এমবিএ ডিগ্রিটা স্রেফ ক্রিকেটের বিকল্প হিসেবেই করা। যাতে প্ল্যান ‘এ’ (ক্রিকেটে) ব্যর্থ হলেও ক্যারিয়ারে যাতে কখনো থমকে না যান। তাই প্ল্যান ‘বি’ টাও রেডি ছিলো আইয়ারের। শিক্ষক, পরিবার সবার সহযোগিতায় ক্রিকেটের পাশাপাশি পড়ালেখাটাও চালিয়ে যেতে পেরেছেন সহজেই।
আইপিএলের প্রথম লেগে কলকাতার একাদশে সুযোগ না পেয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন আইয়ার। ঘরোয়া ক্রিকেটে এমন পারফরম্যান্সের পরও প্রথম লেগের পুরোটাই কাটিয়েছিলেন বেঞ্চে! কোচ চন্দ্রকান্তকে ফোন করে বললেন, ‘পুরো লেগেই তো আমাকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছে।’ চন্দ্রকান্ত তাঁকে বলেছিলো, ‘তুমি বাইরে থেকেও অনেক কিছুই শিখছো, তাই অপেক্ষা করো তোমার সুযোগের জন্য।’
২০১৫ সাল থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলছেন ভেঙ্কটেশ আইয়ার। তবে, ২০২০-২১ মৌসুমে সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফিতে প্রায় ৭৬ গড়ে ২২৭ রান করে কলকাতার নজরে আসেন তিনি। বিজয় হাজারে ট্রফিতেও খেলেন দুর্দান্ত এক ইনিংস। এরপরই দ্বিতীয় লেগে পেলেন সেই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ। নেটে প্যাট কামিন্স, সুনীল নারাইনদের বেশ ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছিলেন তিনি। আর তাই দ্বিতীয় লেগে সুযোগও পেয়ে যান প্রথম ম্যাচেই।
আর সুযোগ পাওয়ার পর প্রথম ম্যাচেই ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে করেন ২৭ বলে ৪১ রান! কলকাতাও জয় পায় ৯ উইকেটের বড় ব্যবধানে। পরের ম্যাচেই মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে খেললেন ৩০ বলে ৫৩ রানের ঝড়ো ইনিংস! ৮ চার ও ৩ ছয়ে আইয়ারের ঝড়ো ইনিংসে মুম্বাইয়ের বিপক্ষেও সাত উইকেটের বড় জয় পায় কলকাতা। প্রথম সাত ম্যাচে মাত্র ২ জয় নিয়ে কলকাতা ছিলো পয়েন্টস টেবিলের নিচে! সেখান থেকে টানা ২ জয়ে বর্তমানে অবস্থান করছে চারে!
ভারতীয় চলচ্চিত্রের বড় তারকা রজনীকান্তের বড় ভক্ত আইয়ার। রজনিকান্তের ‘পেরিয়াপ্পা’ ছবিতে তাঁর জনপ্রিয় সংলাপ ছিল, ‘ইয়েন ভাসি, তানি ভাসি!’ অর্থ হল, ‘আমার ধরণ, আলাদা ধরণ’ লাইনটিকেই ক্যারিয়ারে নিজের পাঞ্চ লাইন মনে করেন আইয়ার।
আপাতত, ক্রিকেটেই ধ্যান-জ্ঞান সবটা দিয়ে রেখেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই নজরকেঁড়েছেন সাবেক ক্রিকেটারদের। আপাতত লক্ষ্যটা শুধু আইপিএলের বাকি সময় নিজের সেরাটা দেওয়ার। মনে মনে হয়তো এখনি স্বপ্নটা দেখে ফেলেছেন জাতীয় দলের!