সমুদ্রের বিশলতায় মুগ্ধ হয় না এমন মানুষ কোথায়ই বা পাওয়া যায়। কক্সবাজারের যেই সমুদ্র সৈকতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন নিজেদের দুঃখ কিংবা সুখ ঢেউ এর সাথে বাসিয়ে দিতে সেখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তবে সমুদ্র তাঁকে আঁটকে রাখতে পারেনি। ক্রিকেট খেলবেন বলে চলে এসেছিলেন বিকেএসপিতে। সাগরিকার সেই সন্তান আজ একটা টেস্ট দলের অধিনায়ক।
এখন নাকি যুগটাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের। প্রতিটা ব্যাটসম্যান ব্যাট হাতে নিয়েই আগে ছয় মারাটা শিখতে চায়। তবে এই সময়ে এসেও ক্রিকেটের আদি সংস্করণের প্রেমে মজে আছেন মুমিনুল হক সৌরভ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুমিনুল ও টেস্ট ক্রিকেটের সম্পর্ক অনেকটা এক তরফা প্রেমের মতন। প্রায় এক দশক ধরে ক্রিকেটকে নিঃসার্থ ভাবে ভালোবেসে যাচ্ছেন তিনি। কখনো একটিবারের জন্যেও মিলাতে যাননি চাওয়া-পাওয়ার হিসাব।
টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি সবচেয়ে শুদ্ধতম ভালবাসার নিদর্শনই বুঝি রেখে যাচ্ছেন মুমিনুল হক। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম ব্যাটসম্যান তিনি। সাদা পোশাকের ক্রিকেটটাকে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই দুহাত ভরে দিয়েছেন। এতটা ধারাবাহিক ভাবে টেস্ট ক্রিকেটে রান করতে দেখা যায়নি আর কোন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানকে।
বিশ্বক্রিকেটের প্রেক্ষাপটেই অনেকের মতে এখন টেস্ট ক্রিকেটের মূল্য কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা এক অপ্রিয় সত্য। আমাদের দেশে টেস্ট ক্রিকেটের সংস্কৃতিটাই এখনো সেভাবে তৈরি হয়নি। এরজন্য ক্রিকেট বোর্ড, টিম ম্যানেজম্যান্ট, দর্শক কিংবা ক্রিকেটাররাও হয়তো খানিক দায়ী। তবে এই দায় মেটানোর দায়িত্বটা একা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন মুমিনুল।
বছরে বাংলাদেশ যে দু একটা টেস্ট ম্যাচ খেলে সেটার জন্যই অপেক্ষা করেছেন। এত লম্বা বিরতিতে ম্যাচ খেলায় মনঃসংযোগে চির ধরতো নিশ্চই। তবুও বাইশ গজে নামলে পরীক্ষাটা ঠিকঠাকই দিতেন মুমিনুল। সেই ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই কী ভীষণ ভালবাসা নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটটা খেলেন। দারুণ পায়ের কাজ, কব্জির মোচর কিংবা অসীম ধৈর্য্য দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটটাকে জয় করে ফেললেন।
আমরা মুমিনুলকে তাই উপহার হিসেবে টেস্ট ব্যাটসম্যানের খেতাব দিলাম। আপনি বলতে পারেন টেস্ট ক্রিকেটার হওয়াটা তো সম্মানেরই। অবশ্যই সম্মানের, তবে আমাদের দেশে একজন টেস্ট ক্রিকেটার হওয়াটা অভিষাপেরও। একজন টেস্ট ক্রিকেটারকে যেই সম্মানটা দেয়ার কথা তা কী আমরা কখনো দিতে পেরেছি? বছরে দুইটা, তিনটা কিংবা চারটা টেস্ট খেলে কী আর ক্রিকেট ক্ষুধা মেটে? আবার আমরাই কতখানি সম্মনা জানাতে পেরেছি মুমিনুলদের? কিংবা পেশাদার ক্রিকেটারের জন্য টাকা-পয়সার হিসাবটাও তো মিলা জরুরি।
টেস্ট ব্যাটসম্যান বলে আমরা মুমিনুলকে আর রঙিন পোশাকের বিবেচনাতেই রাখলাম না। অথচ ওয়ানডে ক্রিকেটেও মুমিনুল বড় কিছু করে দেখাতে হয়তো পারতেন। মুমিনুল অবশ্য তা নিয়ে কখনো অভিযোগ করেননি। তিনি তাঁর ভালবাসার টেস্ট ক্রিকেট নিয়েই তাঁর জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারেন। তবুও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আক্ষেপটা বোঝা যায় যখন মুমিনুল বলেন,’ টেস্ট ক্রিকেটারদের নিয়ে কয়জন ভাবে।‘
সত্যিই তো, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারদের নিয়ে আমাদের যত আলোচনা তাঁর শিকেভাগও কী টেস্ট ক্রিকেটারদের নিয়ে হয়? সেই দায়িত্বটাও মুমিনুল নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন। বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক হলেন তিনি।
একটা ক্রিকেট দলের অধিনায়কের দায়িত্ব ঠিক কী? মাঠ ও মাঠের বাইরে দলকে নেতৃত্ব দেয়া কিংবা পরিকল্পনা সাজানো? তবে মুমিনুলের দায়িত্বটা আরো বেশি । দেশের একটা প্রজন্মের সাথে টেস্ট ক্রিকেটটাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে মুমিনুলদের। লাল বলের ক্রিকেটের সৌরভটা ছড়িয়ে দিতে হবে গোটা দেশে। টেস্টে সংস্কৃতির একটা জোয়ারও আসা চাই তাঁর হাত ধরেই।
মুমিনুল হয়তো একটা পথ বাতলে দিয়ে যাচ্ছেন। যেই পথটা ধরে হাটবে পরবর্তী প্রজন্ম। দিনশেষে একটা ক্রিকেটীয় জাতি হয়ে উঠতে হলে টেস্ট ক্রিকেটটাই যে সবচেয়ে বড় সম্পদ। মুমিনুল অন্য কোন দেশের হয়ে খেললে হয়তো নামের পাশে হাজার দশেক রান থাকতো। নিজেকে হয়তো কিংবদন্তিদের কাতারে নিয়ে যেতে পারতেন। সেসব কিছুই তাঁর হয়নি। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে টেস্ট জোয়ার যদি কখনো আসে একটা গোটা জাতি আপনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে সৌরভ।