জাদু দিয়েই জাদুকরের ফেরা

সেই পুরোনো মেসি, সেই সিগনেচার দৌড়, বয়সের ভারে ঘোড়া কি আর দৌড়াতে ভুলে যায়! ক্ষিপ্রতার সাথে বল নিয়ে চলে গেলেন ডি বক্সের ঠিক সামনে।

ফুটবলের মহারাজা কে? অনেক তর্ক-বিতর্ক হবে, অনেক আলোচনা সমালোচনা হবে। সবকিছুকে একটা পাশে রেখে চলুন ধরে নেই লিওনেল মেসি ফুটবলের মহারাজা। মহারাজার গোল খড়া অবশেষে কেটেছে, তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর কাঙ্খিত গোলের দেখা।

কতশত জল্পনা পেড়িয়ে, লাখো-কোটি সমর্থকে কাঁদিয়ে ফুটবলের মহারাজা ছেড়েছিলেন তাঁর ঘর, তাঁর রাজত্ব। ফুটবলের তো আর যুদ্ধ করে কিছু টিকিয়ে রাখা যায় না, ফুটবলের তো আর স্বেচ্ছাচারিতা চলে না। তাই মহারাজাকে বের হতে হলো, খুঁজতে হলো নতুন ঘর।

কিন্তু সামাজ্র্য যে তাঁর নিজেকেই তৈরি করে নিতে হতো। নিজের পুরনো ঘর ছেড়ে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন মহারাজ লিওনেল মেসি। নিজেকে ঠিক প্রমাণ করতে পারছিলেন না। নিন্দুকদের সে কি নিন্দা! মেসির প্রতিদ্বন্দি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো করে ফেলেছেন তিন ম্যাচে চার গোল, কিন্তু মেসি পারছেন না। এ কেমন মেসি?

বাঘ যখন শিকার করে ঠিক তার খানিকআগে পিছিয়ে যায়। মেসির গোল খড়া হতে পারে তেমনই এক উদাহরণ। অবশেষে নিন্দুকের নিন্দার জবাব মেসি দিয়েছেন, তাঁর মতো করেই দিয়েছেন। তিনি গোলে ফিরেছেন তাও আবার হাই ভোল্টেজ ম্যাচে।

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে ‘গ্রুপ-এ’ এর ম্যাচে মুখোমুখি প্যারিস সেইন্ট জার্মেই ও ম্যানচেস্টার সিটি। উত্তেজনার পারদ আকাশচুম্বী। গেল আসরের রানার্সআপ ম্যান সিটি কিছুদিন আগেই প্রিমিয়ার লিগে হারিয়েছিল গতবারের চ্যাম্পিয়ন চেলসিকে। আত্মবিশ্বাসটায় বাড়তি হাওয়া দেয় তাদের ডাগআউটে থাকা পেপ গার্দিওয়ালা। জয়ের জন্যেই কাল মাঠে নেমেছিল ম্যান সিটি।

তবে ঘরের মাঠে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ত্রয়ী মেসি-নেইমার-এমবাপ্পেকে নিয়ে গড়া একাদশে মাউরিসিও পচেত্তিনোর মতো কোচের নির্দেশনায় পিএসজিও কম যায় না গ্রেলিশ-ডি ব্রুইনদের থেকে।

দুই কোচই এদিন মাঠে নামালেন তাঁদের সেরা একাদশ নামিয়েছিলেন ৪-৩-৩ ফরমেশনে। তবে পিএসজি মাঠের খেলায় ৪-৪-২ ডায়নামিক ফরমেশনের ছাপ কিছুটা পাওয়া যাচ্ছিলো। মেসি বেশ স্বাধীন ভাবেই তাঁর জায়গা ক্রমশ পরিবর্তন করে খেলেছেন পুরো ম্যাচ জুড়েই।

তবে ম্যাচের শুরতে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে থাকে মাহারেজ-স্ট্রার্লিংরা। তবে স্রোতের বিপরীতে ম্যাচের আট মিনিটের মাথায় পিএসজির মধ্যমাঠের খেলোয়াড় ইদ্রিসা গুই জোড়ালো শটে গোল পোস্টের উপরী কর্ণায় দিয়ে বল জালে জড়ালে ১-০ গোলে এগিয়ে পার্ক দে প্রিন্সেসে থাকা দর্শকরা আনন্দে ফেঁটে পরে। কিন্তু আনন্দের তখনও যে বাকি, মহারাজার গোল যে করা বাকি।

তারপর একের পর এক আক্রমণ- পাল্টা আক্রমণে ম্যাচের উত্তেজনা ক্রমশই বাড়তে থাকে। ম্যাচের ২৬ মিনিটে রাহিম স্টারলিং-এর হেড গোলবারে লেগে ফিরে আসলে সেই বলে ট্যাপ করে বার্নাডো সিলভা। কিন্তু তাও বারপোস্টে লেগে প্রতিহত হলে ম্যাচের সবচেয়ে বড় সুযোগ হাতছাড়া করে ম্যান সিটি। শেষমেষ ১-০ গোল ব্যবধান নিয়ে বিরতিতে যায় দুইদল।

দ্বিতীয়ার্ধে, আক্রমণের গতি বাড়িয়ে দেয় দুই দলই। কিন্তু গোলের দেখা পাচ্ছিলো না কোন দলই। মূলত ম্যাচটিতে প্রতি আক্রমণ কৌশলকে কাজে লাগিয়ে খেলেছিল পিএসজি। তাঁর প্রমাণ হতে পারে বল পজিশন কিংবা গোল মুখে করা শটের সংখ্যা। পিএসজির দখলে বল ছিল ৪৮ ভাগ অন্যদিকে ম্যান সিটি গোল মুখে শট চালিয়েছে মোট সাতবার।

ম্যাচের ৭৩ মিনিটের দিকে এমন এক প্রতি আক্রমণের সুযোগ পায় পিএসজি। মধ্যমাঠের ডান পার্শ্বে অপেক্ষায় থাকা মেসির পায়ে বল আসে। সেখান থেকে মেসি বল নিয়ে ছুটে চলেছেন সিটির ডি-বক্সের দিকে। সেই পুরোনো মেসি, সেই সিগনেচার দৌড়, বয়সের ভারে ঘোড়া কি আর দৌড়াতে ভুলে যায়! ক্ষিপ্রতার সাথে বল নিয়ে চলে গেলেন ডি বক্সের ঠিক সামনে।

ততক্ষণে তাঁর সাহায্যে হাজির এমবাপ্পে। ডি-বক্সের বাইরে থেকে এমবাপ্পের সাথে ওয়ান-টু ওয়ানে বল একবারের জন্যে আদান-প্রদান করে পূর্ণ শক্তিতে বাঁ-পায়ে শট চালান মহারাজা মেসি। আর তাতেই বোকা বনে গেলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক, এডারসন। তাকিয়ে থেকে বল জালে জড়িয়ে যাওয়া দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না এডারসনের।

গোল দিয়েই আবার ছুটলেন মেসি, তাঁর কোলে উঠে উদযাপন করলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ নেইমার। দলের সেরা খেলোয়াড়ের গোলে আনন্দের বাঁধ যেন ভেঙে যায় পিএসজি সমর্থকদের। ফিরেছেন মেসি, গোলের দেখা পেয়েছেন। ঘরের মাঠে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে গোল পেয়েছেন লিওনেল মেসি তাও আবার ম্যানসিটির বিপক্ষে। জিতেছে দল, পেয়েছে পূর্ণ তিন পয়েন্ট। এর থেকে একটা ম্যাচে আর কিছু প্রত্যাশা করাও নেহাত বোকামি।

এদিন পিএসজি খেলেছেন পুরোদমে, প্রত্যকটা খেলোয়াড় খেলেছেন নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে। খেটে খেলেছেন মেসি-নেইমার। তাছাড়া এ জয়ের একটা বিশাল বড় জায়গা জুড়ে যেমন থাকবেন মেসি ও গুই তেমনি বাকি অর্ধেকটা ক্রেডিটের হক পিএসজি গোলরক্ষক জিয়ানলুজি ডোন্নারুমার। অসাধরণ রিফ্লেক্স আর দক্ষতায় গোলবারকে আগলে রেখেছিলেন তিনি রুখে দিয়েছিলেন ম্যান সিটির সাতটি শট। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের অভিষেক ম্যাচ হয়ত এভাবেই স্মরণীয় করে রাখতে হয়।

কিন্তু এদিনের সব আলো নিজের দিকেই কেড়ে নিয়েছেন ফুটবলের মহাতারকা লিওনেল মেসি। তাঁর পিএসজি যাত্রা বর্ণিল হবে। তাঁর হাত ধরেই পিএসজির ঘরে আসবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। এমন প্রত্যাশায় এখন পিএসজি সমর্থকেরা। সময়ের পরিক্রমায় নিজের আরেক রাজত্য তৈরি করে নেবেন মহান মহারাজ মেসি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...