বাংলাদেশ বনাম সুনীল ছেত্রী!

ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ মানেই বিশেষ কিছু। সেটা হোক ক্রিকেট কিংবা ফুটবল। যদিও বেশিরভাগ ম্যাচেই বাংলাদেশ পরাজিত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। আজকে সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের অতি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দক্ষিন এশিয়ার ফুটবলের পরাশক্তি দলটির বিপক্ষে লড়াই নিয়ে তাই আলোচনাটা চলছে মাঠের বাইরে। তবে কেউ কেউ এই লড়াইটাকে সুনীল ছেত্রীর বিপক্ষে বাংলাদেশের লড়াই হিসেবেও দেখছেন।

তবে এই ম্যাচের আলোচনাটা শুরু করেছিলেন ভারতের কোচ ইগর স্টিমাচ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে একমাত্র পেলান্টি গোলে জয়ের পর, এই গোলকে হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ভারত কোচের জবাবটা সরাসরি না দিয়ে একটু কুটনৈতিকভাবে বলেছেন বাংলাদেশ কোচ অস্কার ব্রুজোন। তাঁর কাছে এটি কথার কথা হিসেবেই রাখা হয়েছে। যাতে করে আলোচানাট এখানেই থামিয়ে দিয়েছেন এই স্প্যানিশ। তবে তিনি আবার বাংলাদেশকে বিশ্বের সেরা দল বলে দাবি করে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন। ভারত-বাংলাদেশ মহারণকে ঘিরে দুই দেশের সমর্থকদের মাঝেও বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। ম্যাচটি মাঠে বসে উপভোগ করার জন্য প্রবাসী দর্শকরাও অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। অনেকে অফিস খোলা থাকায় ছুটির আবেদনও করে রেখেছেন।

প্রথম ম্যাচেই প্রবাসীদের সমর্থন মন জুড়িয়েছে বাংলাদেশের মানুষের। ভারতের বিপক্ষে ’মহা’ গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের আগে বাংলাদেশ কোচ আশার বাণী শুনিয়েছেন। মালে জাতীয় স্টেডিয়ামে আয়োজিত ম্যাচ পূববর্তী সংবাদ সম্মেলনে পুরো সময়ই জামাল ভূঁইয়াদের জন্য উজ্জীবনী বক্তব্য দিলেন এই স্প্যানিশ কোচ।

তিনি বলেন, ‘একাগ্রতা ও আত্মবিশ্বাসে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সেরা দল। বলতে দ্বিধা নেই ভারত এখানে ফেবারিট। উপমহাদেশ তাদেরই অন্যদের চেয়ে ভালো লিগ খেলা রয়েছে। বিভিন্ন পজিশনে তাদের একাধিক ভালো খেলোয়াড় আছে। তবে আমি মনে করি এই ম্যাচে ভালো লড়াই হবে। আমরা লড়াই করব এবং জয়ের জন্যই খেলব। জামাল ভুইয়াদের সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছি।’

ভারতের বিপক্ষে জয়ের জন্য হাফ চান্সকে ফুল চান্স বানিয়ে গোল করতে হবে। তবে বাংলাদেশ দলের ফিনিশিংয়ের যেই করুণ দশা তাতে জেতার জন্য প্রয়োজনীয় গোলটা কিভাবে আসবে এমন প্রশ্নের উত্তরে কোচ জানান, ‘ফুটবল গোলের খেলা বিধায় সমস্যা দূর করে আমরা প্রতি ম্যাচেই গোল করতে চাই এবং করব আশা করি। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশের কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে সুনীল ছেত্রীকে আটকাতে। ডিফেন্ডাররা সেই কাজটিই করবে বলে আমার বিশ্বাস।’

ইগর স্টিমাচের সঙ্গে ডাগ আউটের লড়াইটা তাই জমাজমাট হবে বলেই প্রত্যাশা। যেহেতু ম্যাচের আগে কথার লড়াইটা বেশ জমেছিল। সুনীল ছেত্রীকে আটকানোটা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ তার কোচ থাকার সময় ব্রুজোন কাছ থেকে দেখেছেন। বিশেষ করে ডি বক্সের ভেতরে ভয়ংকর এক খেলোয়াড়ের নাম এই নাম্বার নাইন। ভারতের বিপক্ষে কোচ চাইছেন বলের দখল রেখে ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে।

এছাড়া দ্রুত বল দেওয়া-নেওয়া করে আক্রমণ ওঠার প্রতিই জোর দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ কোচ। মাঠের লড়াইটা জামাল ভুইয়ার সঙ্গে যে সুনীল ছেত্রীর হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় তারকা জামাল বলছেন, আজকের ম্যাচে ভারতই বেশি চাপে থাকবে। তাইতো ম্যাচে ফোকাস না করে বাইরে বেশি কথা বলছে তারা।

অপরদিকে ভারত বাংলাদেশ ম্যাচে যুদ্ধের আবহ দেখছেন দেশটির অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। ৩৭ বছর বয়সী স্ট্রাইকার এখনো প্রতিপক্ষের কাছে মুর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। জাতীয় দলের জার্সিতে ১২০ ম্যাচে ৭৫ গোল করা ছেত্রী এবারের সাফেও ভারতের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে এ পর্যন্ত ১৩ গোল করে সুনীল নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাইছেন। বাংলাদেশের বিপক্ষেই তাঁর গোল সংখ্যা ৬টি।

পরিসংখ্যান আর নিজের সামর্থ্য এসব নিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে নির্ভার হয়েই মাঠে নামার কথা সুনীল ছেত্রীর। কিন্তু তিনি তা পুরোপুরি করতে পারছেন না। বাংলাদেশকে সবশেষ দেখায় গত জুনেই তার জোড়া গোলে হারানোর স্মৃতিটাও ঠিকঠাক শান্তি দিচ্ছে না।

গঙ্গা-পদ্মা লড়াইয়ের আগে সংবাদমাধ্যমকে ছেত্রী বলেছেন, ‘চেনা প্রতিপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশের বিপক্ষে কিছুদিন আগেই খেলেছি। এর আগেও অনেক ম্যাচ খেলেছি। সব সময়ই লড়াইটা কঠিন হয়ে থাকে। তা ছাড়া বাংলাদেশ সম্প্রতি কোচ পরিবর্তন করে নতুনভাবে শুরু করেছে। প্রতিপক্ষ হিসেবে যে ওরা বেশ শক্তিশালী। আমার কাছে তাই প্রতিটি ম্যাচই যুদ্ধের মতো। তাই লড়াইটা শেষ অবধি চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। শতভাগ উজাড় করে দিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে জিততে হবে।’

ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে বরাবরই ছেত্রী হয়ে ওঠেন প্রবল প্রতিপক্ষ। গত জুনে কাতারের দোহায় বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ফিরতি ম্যাচে এই ষ্ট্রাইকারের জোড়া গোলেই বাংলাদেশ হেরেছিল ভারতের কাছে। এর আগেও বেশ কয়েকটি ম্যাচে ছেত্রীর গোলেই হয় পরাজিত হয়েছে, নয়তো জয়বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ। তাই অঅজকের ম্যাচে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার নাম ছেত্রী। সাম্প্রতিক সময়ে যা দেখা গেছে, ব্রুজোনের দলের কোথায় কোন দূর্বলতা রয়েছে সেটি বেশ ভাল করেই জানা রয়েছে ভারত অধিনায়কের। যা আজকের ম্যাচে নিশ্চিতভাবেই কাজে লাগাতে চাইবেন তিনি।

২০০৭ সালের নেহেরু কাপে প্রথমবার বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলতে নেমে গোলের দেখা পাননি ছেত্রী। এরপর ২০১৩ সালে কাঠমান্ডু সাফে ভারতকে নিশ্চিত হারের লজ্জা থেকে বাঁচান যোগ করা সময়ে অসাধারণ এক ফ্রি-কিকে গোলের মাধ্যমে। পরের বছর দু’দল গোয়ায় প্রীতি ম্যাচে ১৪ মিনিটে ছেত্রীর গোলে লিড নেয় স্বাগতিকরা। মিথুন চৌধুরীর ৫১ মিনিটে করা গোলে সমতায় ফিরেছিল বাংলাদেশ।

১৩ মিনিট পর আত্মঘাতী গোলে আবারো বাংলাদেশ বসে চালকের আসনে বসে। কিন্তু আবারও যোগ করা সময়ে ছেত্রীর গোলে কোনরকমে হার এড়ায় ভারত। এরপর ২০১৯ সালে সল্টলেকে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও আবার গোলের দেখা পাননি ছেত্রী। তবে জুনে দোহায় বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ফিরতি ম্যাচে বাংলাদেশকে দেখিয়েছেন বুড়ো হারের ভেল্কি। দুই গোল করে ম্যাচটা একরকম ছিনিয়েই নিয়ে গেছেন তিনি। তাই আজকেও এই লড়াই অব্যহত থাকবে।

ভারতের বিপক্ষে ২০০৩ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে সেমিফাইনালে ২-১ গোলে জিতেছিল বাংলাদেশ। সেই ১৯৭৮ থেকে ২০২১, গত ৪৩ বছরে দুই দল জাতীয় দলের পর্যায়ে মুখোমুখি হয়েছে ২৮ বার। এর মধ্যে মাত্র চারটি জয় পেয়েছে বাংলাদেশ, ড্র ১০টি, হার ১৪টি। বাংলাদেশের শেষ জয় ২০০৫ সালে মায়ানমারে গ্র্যান্ড রয়েল চ্যালেঞ্জ কাপে, সেখানে ভারতের জয় তো সর্বশেষ দেখাতেই। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ২-০ গোলে জয়টা আজকের ম্যাচের জন্য বাড়তি আত্ববিশ্বাস যোগাবে নিশ্চিত করে বলা যায়। বাংলাদেশ যেখানে চাইছে জয়ের খরা ঘুচাতে আর ভারত চাইছে জয় দিয়ে সাফের আসর শুরু করতে। পাশাপাশি এশিয়া কাপের জন্য প্রস্তুতির বড় মঞ্চ হিসেবেও দেখছেন ইগর স্টিমাচ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link