মহালয়ায় এই একটা ফ্রেম মাথার মধ্যে ঘুরছে সারাদিন। মহালয়া তবু একটা দরজা। যেখান থেকে কাকভোরে রেডিওর নব ঘোরালে নেমে যাওয়া যায় এক কুয়াশা নগরীতে। কিংবা কোনো এক ইউটোপিয়ায় যেখানে সাদামাটা গলিতে ক’দিন আলো জ্বালিয়ে দেয় কেউ। ‘দেওয়াল তুললেই ঘর। ভেঙে ফেললেই পৃথিবী’ – কত কাল আগে থেকে আমরা শুধু দেওয়ালের পর দেওয়াল তুলে গড়তে চেয়েছি বোবা ইমারত। অথচ কত রাজপ্রাসাদের ভেতর মাথাকুটেও একটা বাড়ি খুঁজে পেল না কেউ!
মাথার ভেতর ফ্রেমটা ঘুরছে সারাদিন। পিছনে ঝাপসা দর্শকের ভেতর সেলিমপুরের কোনো এক গলির আধপাগলা লোক, যে প্রাণপনে সপ্তমীর রাতে একটা ল্যাম্পপোস্টকে আঁকড়ে কাঁদছে। যেন ঘরে ফিরে নিজেকেই নিজে পুড়িয়ে ফেলতে চাইছে। ফুটপাথে শুয়ে বিলাপ করতে করতে নেশায় বুজে আসছে চোখ। পৃথিবী আসলে পাখিদের বাড়ি। মানুষ ঠিক ফিট করে না, তার শরীরে আরেকটু বেশি আলো-হাওয়া যাতে না লাগে তাই সে বাড়ি খোঁজে রোজ।
মাথার ভেতর ফ্রেমটা ঘুরছে সারাদিন। লিভারপুলের বিরুদ্ধে গোল করে ফেন্স ডিঙিয়ে দুহাত মেলে যে লোকটা ছুটে যাচ্ছিল তার চেয়ে অকৃতজ্ঞ কে-ই বা হতে পারে? ঠিক তিন বছর পর একটা লম্পট-বেইমান লোক গোল ক’রে আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে যায়। দুহাত জড়ো ক’রে কিছু বিড়বিড় করে। মহালয়ার ভোরে ফ্লাইট ধরার জন্য যখন বিলিতি এয়ারপোর্টে ভিড় উপচে পড়ছে, রঙচটা ঠাকুর দালানে যখন একটু একটু ক’রে ফুটে উঠছে খড়ির আলপনা, তখন প্রদীপ নিভে যায় গলির শেষ প্রান্তে।
রোদ্দুরে পাওয়া বিকেল বেচে উঠে যায় রিয়েল এস্টেট। পাকাপাকি ছাদ বেচে চলে গেছে কেউ। তার বাড়ি, খেলার মাঠ, আসটেরিক্স-টিনটিন কিংবা পাঁচশিকের গল্পে সে দূর থেকে নিজেকে খুঁজে চলে রোজ।
মাথার ভেতর ফ্রেমটা ঘুরছে সারাদিন। যাদের বাড়ি ফেরার কথা ছিল, তাদের অনেকেরই ফেরা হবে না এই পুজোয়। কাল্পনিক ডানহাতে সে প্রণাম সেরে নেবে স্মৃতিদের, ছেলেবেলার উচ্ছ্বল অষ্টমীর সকালকে। এক আধবুড়ো উরুগুয়ান বাউন্ডুলে চোখ মুছে ফেলবে আলগোছে। মনে মনে আমাদের মতোই বিশ্বাস করবে সে, সন্ধে নামার আগে একবার ঘরে ফেরে সব, সবকিছু। ফিরতেই হয়। হোক না সে বাতিল পুজোসংখ্যা কিংবা ঘর পালানো পাখির ছদ্মবেশ!
মাথার ভেতর ফ্রেমটা ঘুরছে সারাদিন, সারারাত।