ক্লান্তিহীন যোদ্ধা, ভরসার সোপান

পৃথিবীতে এগজিস্ট করা প্রত্যেকটা প্রফেসনে তারকা থাকবে, গ্ল্যামার থাকবে, প্রিয় গ্রেটেস্টের জন্য কাট-আউট থাকবে। সৌরভ-শচীন-কুম্বলেদের ভীড়ে যেমন শান্ত লক্ষ্মণ করে যেতেন তাঁর বরাদ্দ কাজ। প্রকৃত টিমম্যানের মত রুনি সেই কাজটাই করতেন ম্যানচেস্টারে, ইংল্যান্ডে। তাঁর না ছিল প্রচারের ধুমধাম, না ছিলেন তিনি অনবদ্য স্কিলফুল প্লেয়ার। অথচ কত যে অবাক করা গোল রুনি মাঝমাঠ থেকে দূরপাল্লার শটে করেছেন, ভাবা যায় না! রুনি তাই ম্যানচেস্টারের ইতিহাসে সবচেয়ে কম আলোচিত অথচ অসামান্য এক লড়াকু সেনাপতি।

‘I’m just a normal young lad who plays football.’

সাল ২০০৩। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ধুরন্ধর ম্যানেজার অ্যালেক্স ফার্গুসন তখনও ‘স্যার’ হননি। স্পোর্টিং লিসবন থেকে সদ্য উঠতি ট্যালেন্ট ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে টেনে নিয়ে এসেছেন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। প্রিমিয়ার লিগ তাঁর রূপ পরিবর্তন করছে ধীরে ধীরে। আগুনে ফর্মে আর্সেনালে খেলছেন থিওরি অঁরি, ডেনিস বার্গক্যাম্প – ইংল্যান্ড ফুটবল আসর যখন ভরা সময়ে জমজমাট, ঠিক পরের মৌসুমে এভারটন থেকে ওয়েন রুনি জয়েন করলেন ম্যানচেস্টারে।

সেই সময় ইউনাইটেড টিমে তারকার সমাহার। বার্থেজের পরে এক নম্বর গোলরক্ষক ভান ডার সার, সঙ্গে পল স্কোলস্, গিগস্, ফার্দিনান্দ, ভিদিচ, রোনালদো। এই ভরা টিমের মাঝে জায়গা ক’রে নেওয়ার জন্য তুলনাহীন ট্যালেন্ট এবং হার্ডওয়ার্কের প্রয়োজন ছিল। রুনি জানতেন, টাফ হার্ডল পেরোতে হবে লাল জার্সিকে আপন করে নেওয়ার জন্য। রুনি সেটা পেরেছিলেন।

ঠিক তেরো বছর পর ২০১৭-১৮ সিজনে রুনি যগন শেষবার ম্যানচেস্টারের জার্সি ছেড়ে টানেল দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁর নামের পাশে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সেকেন্ড টপ গোল স্কোরারের তকমা সাঁটা!

আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এটাই তো একজন ফরোয়ার্ডের কাজ। রুনি তো আদতে ফরোয়ার্ডই ছিলেন। সের্জিও আগুয়েরোর পরেই তাঁর নাম থাকবে, এতে এত অবাক-বিস্ময়ের তেমন কোনও প্রয়োজন নেই। আসলে সব গল্প স্কোরবোর্ড বলে না, বলতে পারে না। স্কোরবোর্ড যদি গল্পদাদু হত, তাহলে নিশ্চয়ই বলত ম্যাচের পর ম্যাচে যখন ইউনাইটেডের ভরাডুবি অবস্থা, তখন এই দশ নম্বরি লোকটা কন্টিনিউ ওপর থেকে নিচে নেমে ডিফেন্স লাইনকে সাহায্য করেছে, পরক্ষণেই কাউন্টার অ্যাটাকে বল পেয়ে দৌড়ে থ্রু বাড়িয়েছে রুনিই।

গোললাইন সেভ করে পরমুহূর্তেই একটা অ্যাটাকে অপনেন্টের জালে বল জড়ানোর রূপকথা তো আর নীরস স্কোরবোর্ড জানায় না – সেটা জানে হাজার হাজার রেড ডেভিলস সমর্থকের হৃদয় – যারা রুনিকে আপন করেছে, চোখের মণি ক’রে তুলেছে। কোনওদিন যদি ইউনাইটেড ট্রিনিটিতে জর্জ বেস্ট, ববি চার্লটন এবং ডেনিস ল’র পাশে রুনির মূর্তি বসে, জানবেন, ‘রজনীগন্ধার গন্ধ ফুটেছে মন্দিরে।’

রুনি সেই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার যে বক্স-টু-বক্স গেম প্লে তৈরি করেছে, আবার সেই রুনিই ম্যান সিটির বিরুদ্ধে ব্যাকভলিতে গোল করেছে। গোলটা হওয়ার পর ফার্গুসনের বাচ্চাসুলভ উল্লাস সারাজীবন আঁকা থাকবে বুকের মাঝে। কত ম্যাচে যে রুনি সোজা ডিফেন্সে নেমে এসে বল ক্লিয়ার করেছে তার ইয়ত্তা নেই। অথচ রুনি সেই লোকটা যাকে নিয়ে রোনাল্ডোর মত উচ্ছ্বাস হয় না। কখনও হয়নি। রুনি ম্যাঞ্চেস্টারের দ্রাবিড়, যার কাজ শুধু খেলে যাওয়া।

তাকে নিয়ে উন্মাদনা হবে না, উচ্ছ্বাস হবে না, হাজারও তরুণ শুধু তারই জন্য হয়তো রাত জাগবে না – তবু যখন ক্রাইসিস ধাওয়া করবে টিমকে, তখন রুনি আগলাবে। যেমন ২০০৪-১৭ আগলে রেখেছিলেন ম্যানচেস্টারকে। ইংল্যান্ডকেও। পিটার শিল্টনের পরে সবচেয়ে বেশিবার ক্যাপ্টেন’স আর্মব্যাণ্ড পরা রুনি একসময় একাই টেনে গেছেন ইংল্যান্ড দলকে।

না ছিল বেকহ্যাম, না ছিল মাইকেল ওয়েন, পরের দিকে জেরার্ড, টেরি, ল্যাম্পার্ড অবসরে যাওয়ার পর আরও ভেঙে গেল ইংল্যান্ড দল – তখন ভাসানের পর মণ্ডপে জ্বলতে থাকা শেষ প্রদীপের মত রুনি ছিলেন ইংল্যান্ডের একমাত্র আশা-ভরসার আলো।

পৃথিবীতে এগজিস্ট করা প্রত্যেকটা প্রফেসনে তারকা থাকবে, গ্ল্যামার থাকবে, প্রিয় গ্রেটেস্টের জন্য কাট-আউট থাকবে। সৌরভ-শচীন-কুম্বলেদের ভীড়ে যেমন শান্ত লক্ষ্মণ করে যেতেন তাঁর বরাদ্দ কাজ। প্রকৃত টিমম্যানের মত রুনি সেই কাজটাই করতেন ম্যানচেস্টারে, ইংল্যান্ডে। তাঁর না ছিল প্রচারের ধুমধাম, না ছিলেন তিনি অনবদ্য স্কিলফুল প্লেয়ার। অথচ কত যে অবাক করা গোল রুনি মাঝমাঠ থেকে দূরপাল্লার শটে করেছেন, ভাবা যায় না! রুনি তাই ম্যানচেস্টারের ইতিহাসে সবচেয়ে কম আলোচিত অথচ অসামান্য এক লড়াকু সেনাপতি।

রুনি ক্লান্তিহীন যোদ্ধা, রুনি ম্যানচেস্টারের নাইট। ওয়েন রুনি আপামর ম্যানচেস্টার ভক্তের ভরসার সোপান।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...