মঞ্জু বনাম লারা ও সেসময়ের ক্রিকেটানন্দ

মঞ্জু বনাম লারা। এরপর লারার টর্নেডো ইনিংস। পার্ট টাইমার হাবিবুল বাশারের বলে বোল্ড। রংপুর ক্যাডেট কলেজের ওমর ফারুক হাউজের টিভি রুমে বসে দেখা সেই ইনিংসটা চোখেভাসে আজো।

লারার ৪৫ বলে সেঞ্চুরি ও সুমন ভাইয়ের (সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন) বলে বোল্ড হওয়ার ঘটনা অনেকেরই জানা, অনেকেরই মনে আছে। আমি ওই ইনিংসের আগের প্রেক্ষাপট একটু মনে করার চেষ্টা করছি।

লারার নেতৃত্বে ছোট্ট ওই সফরে শুরুতে একটি তিন দিনের ম্যাচ খেলেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ। সেই ম্যাচে লারাকে বোল্ড করেছিলেন বাঁহাতি পেসার মঞ্জুরুল ইসলাম। লারার অবশ্য ততক্ষণে ৭৬ বলে ৮৭ রানের ইনিংস খেলে ফেলেছেন।

এরপর দুটি ওয়ানডে ম্যাচ। দুটিতেই লারা ওপেন করেছিলেন। প্রথম ওয়ানডেতে আবার মঞ্জুর শিকার লারা। এবার ম্যাচের দ্বিতীয় আর মঞ্জুর প্রথম ওভারের প্রথম বলেই, মাত্র ২ রানে।

টানা দুই ইনিংসে একই বোলারের বলে আউট হওয়া এমনিতে এমন কিছু নয় অবশ্যই। কিন্তু এখানে বলছি ২১ বছর আগের কথা। বাংলাদেশের তরুণ এক বোলার লারার মতো মহাতারকাকে টানা দুই ইনিংসে আউট করেছেন, এই সময় এটা বিরাট ব্যাপার ছিল। পত্রপত্রিকায় তুমুল হইচই।

তখন আমার কাছে একটা ছোট্ট রেডিও ছিল, ক্যাডেট কলেজে লুকিয়ে কাছে রাখতাম। স্রেফ খেলা শোনার জন্য। নানা সময়ে খেলার ধারাভাষ্য শুনতাম আর প্রতিদিন রাত ৮টা ৫ মিনিটে বাংলাদেশ বেতারের খেলার খবর। রেডিওর ধারাভাষ্যকাররা মঞ্জুকে প্রায় ওয়াসিম আকরাম বানিয়ে দিচ্ছিলেন, আমাদের কল্পনার চোখেও সেরকম কিছুই ভাসছিল।

আমরা রোমাঞ্চে হাবুডুবু খাচ্ছি, দর্শকরাও ছিলেন প্রবল উত্তেজিত। দ্বিতীয় ওয়ানডে লারা টস জিতে আবার ব্যাটিংয়ে নামলেন। বল হাতে প্রথম ওভারে মঞ্জু। টিভি ক্যামেরায় তখন ধরা পড়লেন গ্যালারির কয়েকজন দর্শক। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড ‘Lara VS Monju’ পাশাপাশি লারা-মঞ্জুর লড়াই নিয়ে আরও অনেক কিছু লেখা অনেকের হাতে।

এরপর তো, লারা যাকে বলে নাড়া দিয়ে ছেড়ে দিলেন। প্রথম ওভার থেকে শুরু হলো ধুন্ধুমার ব্যাটিং। বেচারা মঞ্জু ভাই কিংবা বোলারদের কেউই বল ফেলার জায়গা পাচ্ছিলেন না। তিনি ৪ ওভারে গুনেছিলেন ৩৮, খালেদ মাহমুদ সুজন ভাই প্রথম ২ ওভারেই ৪০!

২৬ বলে এলো লারার ফিফটি, তাতে চার ১২টি! হ্যাঁ, ৪৮ রানই বাউন্ডারিতে। ফিফটির পর আরও বিধ্বংসী। পরের ফিফটি ১৯ বলেই। ৪৫ বলে সেঞ্চুরি, সেই সময়ের দ্বিতীয় দ্রুততম। সেঞ্চুরি ছোঁয়ার সময় বাউন্ডারি থেকেই ছিল ৯২ রান। হ্যাঁ, ভুল পড়ছেন না, ১৭ চার, ৪ ছক্কা।

সেঞ্চুরির পর লারার হয়তো মনে হলো, যথেষ্ট হয়েছে, এবার একটু ধীরে চলা যাক। পরের ১৬ বলে করলেন মাত্র ১৭ রান, বাউন্ডারি কেবল একটি।

তাতে আমরা যারা খেলা দেখছিলাম, মোটামুটি প্রমাদ গুনলাম। ঠাণ্ডা মাথায় খেলতে শুরু করেছেন, মানে হয়তো বড় কিছু টার্গেট করেছেন লারা! তখনও ২০ ওভারই হয়নি। আমরা বলাবলি করছিলাম, সাঈদ আনোয়ারের ১৯৪ রানের রেকর্ড আজকে খতম।

এরপরই সুমন ভাইয়ের সেই ম্যাজিক! অধিনায়ক বুলবুল ভাই যখন সুমন ভাইকে বোলিংয়ে আনলেন, আমরা ভাবলাম, খবর আছে। ওভারে ৩০-৩২ না হয়ে যায়! হলো উল্টো। খুবই নিরীহ একটি ডেলিভারি, অফ স্টাএম্পর একটু বাইরে। সামান্য একটু টার্ন করেছিল কিনা, মনে করতে পারি না এখন। তবে এটুকু মনে আছে, পিচ করার পর বলটি একটু মন্থর ও নিচু হয়ে গিয়েছিল, লারার ড্রাইভে টাইমিংয়ে গড়বড়। ব্যাটের কানায় লেগে বল স্টাম্পে, ৬২ বলে ১১৭ রানে শেষ।

সুমন ভাইয়ের হাসিটা এখনও চোখে ভাসে।

পুরো ১০ ওভার করে সুমন ভাই সেদিন মাত্র ৩১ রান দিয়েছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছিল ৩১৪। রান তাড়ায় বুলবুল ভাইয়ের ৬৬ ও বিদ্যুৎ ভাইয়ের ৪৭ রানের ইনিংসে বাংলাদেশ করেছিল ২০৫। দল দুইশ পেরিয়েছে, তাতেই আমরা খুব খুশি ছিলাম।

মজার ব্যাপার হলো, লারার ভূমিকা সেদিন ব্যাটিংয়েই শেষ ছিল না। বল হাতেও নিয়েছিলেন ১২ রানে ২ উইকেট! আরও মজার ব্যাপার, সেটিও লারার সেরা বোলিং ছিল না! ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ওয়ানডেতে ৫ রানে নিয়েছিলেন ২ উইকেট।

২১ বছর। জয় তো তখন আমাদের সুদূরতম কল্পনায়ও থাকত না। এরকম একটি-দুটি উইকেট, কারও দু-একটি চোখধাঁধানো শট বা কারও লড়িয়ে কোনো ইনিংস, এসব ছোটখাটো ব্যাপারেই তখন আমরা রোমাঞ্চ খুঁজে নিতাম, দিনের পর দিন চর্চা করতাম আর স্বপ্ন দেখতাম দেশের ক্রিকেট নিয়ে। ওসবই ছিল আমাদের ক্রিকেটানন্দ।

– ফেসবুক থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link