অস্ট্রেলিয়া: ভিনটেজ-ব্রুটাল-ক্ল্যাসিক

ভিনটেজ অস্ট্রেলিয়া? পুরোপুরি না। ব্রুটাল অস্ট্রেলিয়া? নাহ, যথেষ্ট নির্মম-নিষ্ঠুর নয়। নক আউট স্টেজের চেনা অস্ট্রেলিয়া? হ্যাঁ, অনেকটাই। ক্ল্যাসিক অস্ট্রেলিয়া? পুরোপুরি! হারার আগে হারে না, লড়াইয়ে হাল ছাড়ে না, ডরায় না, ভড়কায় না। সাহসের খেলায় পিছু হটে না। খেলা দেখে লাফালাফি করার দিন বেশ আগেই অতীত, মূলত পেশাগত চাপ আর ব্যস্ততায়। কত দিন পর যে আক্ষরিক অর্থেই লাফালাম!

ম্যাথু ওয়েডের টানা তিন ছক্কার প্রথমটি দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বিস্ময়ে এবং আনন্দে। বুঝে উঠতে পারছিলাম না, ওয়েড এটা কী করলেন.. আমি কি সত্যিই দেখলাম ! সেটির রেশ থাকতে থাকতেই পরের বলে স্লগ করে যে ছক্কা মারলেন, জয়টা নিশ্চিত হয়ে গেল, রুমে এক একাই গোটা তিন লাফ দিয়ে ফেললাম, অনেক অনেক দিন পর।

রাজপুত্তুর জানে আমি অস্ট্রেলিয়ান সাপোর্টার। সে একটু পরপর বলে, ‘পাপা, অস্ট্রেলিয়া তো হেরে যাচ্ছে।’ আমি বলি, ‘না, খেলা অনেক বাকি আছে।’ বলছি বটে, কিন্তু নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ওয়েড যখন উইকেটে গেলেন, ৪৬ বলে ৮০ রান লাগে। বাইরে আর ব্যটসম্যান নেই। মার্কাস স্টোয়িনিস আগের দুই ম্যাচে ব্যাটিং পাননি, তার আগের ম্যাচে করেছেন শূন্য। ওয়েডও ব্যাটিং সেভাবে পাননি আগের ম্যাচগুলোয়।

এই বছর টি-টোয়েন্টিতে তার ফর্ম ভালো না মোটেও। বরং জশ ইংলিসকে না খেলিয়ে তাকে কেন খেলাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, এটা নিয়ে মেজাজ খারাপ হচ্ছিল, এই দুজনই গড়ে দিলেন ম্যাচের ভাগ্য – দেখালেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ম্যাজিক কিংবা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের চরিত্র।

হাসান আলী ক্যাচটি নিতে পারলে অস্ট্রেলিয়া হয়তো পারত না। কামিন্স-স্টার্ক ব্যাটিং পারেন বটে, তবে ওই সময়ে গিয়ে পারা কঠিন। কিন্তু এটাও ভুলে গেলে চলবে না, ক্যাচটি ছাড়ার পরও ৯ বলে ১৮ লাগত। বেশ দু:সাধ্য তখনও! শাহীন শাহ আফ্রিদি নিজের মতো বল করতে পারলে আর ওয়েড তার সাম্প্রতিক সময়ের মতো ব্যাটিং করলে কিন্তু শেষ ওভারে ১৪-১৫ রানের সমীকরণ থাকত হয়তো।

জীবন পাওয়ার পরের বলেই ওয়েড যে শটটি খেললেন, ওই সময়ে এমন কিছু ভাবার সাহস, সেটিও আফ্রিদির মতো গতিময় বোলারকে, এরকম ফাস্ট বোলারকে এতটা শাফল করে স্কুপ করার যে বুকের পাটা, দ্রুত পজিশনে গিয়ে বলের নিচে যাওয়া ও বল থেকে চোখ না সরানোর যে টেকনিক এবং পুরোপুরি এক্সিকিউট করার যে স্কিল – সবকিছু মিলিয়ে এমন চাপের মধ্যে আমার দেখা সেরা শটগুলির একটি নিশ্চিতভাবেই।

ক্যাচ মিসের পর ওই ছক্কা হজম করে সম্ভবত ভেতরে দমে গিয়েছিলেন আফ্রিদি। পরের বলটায় গতি কম মনে হলো কিছুটা। কিংবা কাটার করার চেষ্টা করছিলেন হয়তো। সেটা ওয়েডের জন্য পিক করা কঠিন ছিল না। তার পরও, খুনে স্লগের ক্ষেত্রে টাইমিং আর ফোর্স দিয়ে এক্সিকিউট করার ব্যাপার আছে। এরপরের বলটি অনুমিতভাবেই আবার ফুলার লেংথ, আরেকটি স্কুপ। যথারীতি ওয়েডের এক্সিকিউশন আবার পারফেক্ট।

হাজার হাজার রান করেও অনেক সময় অনেকের ক্যারিয়ারে একটা আজীবন গল্প করার ইনিংস থাকে না। ক্যারিয়ারের পরিচায়ক হয়ে থাকা ইনিংস থাকে না। ওয়েড পেয়ে গেলেন।স্টোয়িনিসের কথাও বলতে হবে জোর দিয়ে। দলকে ম্যাচে রেখেছিলেন তো তিনিই! ম্যাক্সি আউট হওয়ার পরের বলেই ছক্কা, আস্কিং রান রেট নাগালের বাইরে না যাওয়া, এসব তার সৌজন্যেই হয়েছে।

আগের দিন, প্রথম সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের লাগত ২ ওভারে ২০। ক্রিস ওকসকে শেষের জন্য না রেখে আগের ওভারে বোলিংয়ে আনলেন ইয়ন মরগ্যান। সঠিক সিদ্ধান্তই, ম্যাচের ভাগ্য বেশির ভাগ সময় এই ওভারেই গড়া হয়। কিন্তু ওকসের এক ওভারেই খেলা শেষ। আজকে ২ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ২২। বাবর আজমও বোলিংয়ে আনলেন আফ্রিদিকে। অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত। আজকেও ওই ওভারেই খেলা শেষ।

টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ বোলিং করা ওকস-আফ্রিদির এক ওভারেই দলের বিদায় লেখা হয়ে যায়। এটাই ক্রিকেট।

ডেভিড ওয়ার্নার কেন রিভিউ নিলেন না? ব্যাখ্যা পাবেন না। ইয়ান বিশপ ধারাভাষ্যে বলছিলেন, ‘অনেকেই এটা বুঝতে চায় না, ব্যাটসম্যানরাও সবসময় বোঝে না যে ব্যাটে লেগেছে কী লাগেনি।’ একটাই ব্যাখ্যা, এটা ক্রিকেট।

ফখর জামান আজকে ব্যাটিংয়ের সময় শেষ দিকে ক্রিজের অনেক গভীরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সহজ কারণ, স্টার্কদের ইয়র্কগুলো যেন হাফভলির মতো বানাতে পারেন, বলের নিচে যেন চড়ে বসতে পারেন। স্টার্করা বোঝেন নি? বুঝেছেন। তবু থামাতে পারেননি, ওই কাজই করে গেছেন এবং ছক্কা হজম করেছেন। এটাই ক্রিকেট।

এখানে স্টিভেন স্মিথের মতো নিরাপদ ফিল্ডার সহজ ক্যাচ ছাড়েন। পাকিস্তান কয়েকটি রান আউটের সুযোগ পেয়ে কাজে লাগাতে পারে না। সবশেষ চারটি সিরিজ হেরে বিশ্বকাপে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব আসরের ফাইনালে উঠে যায়। দারুণ স্কিলফুল ও দুর্দান্ত স্পিরিটেড ক্রিকেট খেলে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটতে থাকা পাকিস্তান নক আউটে হেরে যায় ছোট ছোট দুয়েকটি ভুলেই।

বোলিংয়ের কারণে এমনিতেই সমালোচনার মুখে থাকা হাসান আলী শেষ সময়ে ক্যাচ ছেড়ে অনুভব করেন, খেলাটা কত নিষ্ঠুর হতে পারে। দু:সময়ের মধ্যে থাকা ওয়েড ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান এবং পরের তিন বলেই স্বাদ পেয়ে যান, খেলাটা কতটা আনন্দময় হতে পারে। এসবই ক্রিকেট। এখানে মেথড আছে, প্রসেস আছে, সায়েন্স আছে, স্কিল-টেকনিক-টেম্পারমেন্ট-নার্ভ, সব আছে। এখানে ব্যাখ্যাতীত ব্যাপারও আছে। সবকিছু আছে বলেই ক্রিকেট সুন্দর। এরকম দিনে মনে হয়, অবিশ্বাস্য সুন্দর।

আবার আজকের ম্যাথু ওয়েড, ২০১০ সালের মাইক হাসি। সেটিও ছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। দ্বিতীয় সেমি-ফাইনাল। শেষ ওভারে লাগত ১৮ রান। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সাঈদ আজমলকে দুই ছক্কা, চার, আরেক ছক্কায় খেলা শেষ করে দিয়েছিলেন হাসি এক বল বাকি থাকতেই।

ক্রিকেট এভাবেই ফিরে আসে। আবার দূরে সরে। কেড়ে নেয়। আবার ফিরিয়ে দেয়। আবারও বলেই ফেলি – ক্রিকেট ইউ ব্লাডি বিউটি।

– ফেসবুক থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link