অ্যাগুয়েরোওওওওও! বলে ইংলিশ ধারাভাষ্যকারের করা গগনবিদারী চিৎকারের কথা মনে আছে? এই অভূতপূর্ব মুহূর্ত ভুলে যাবার কথা নয় অন্তত একজন সাদামাটা ফুটবল সমর্থক হলেও ভুলে যাবার কথা নয়। আচ্ছা যদি ভুলে গিয়েই থাকেন তবে মনে করিয়ে দেই।
সালটা ২০১২, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে দুই শহর প্রতিদ্বন্দী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও সিটির মধ্যে। প্রত্যক্ষ নয় লড়াইটা পরোক্ষ। তবে শিরোপার। একদিকে সান্ডারল্যান্ডের মাঠে ১-০ গোলে এগিয়ে থেকে শিরোপা প্রায় ছুঁয়েই রেখেছিল রেড ডেভিলরা। ম্যান সিটির শুধু চাই হয় কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের বিপক্ষে। বাড়তি সুবিধা ঘরের মাঠ।
১৯৬৮ এর পর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জেতার হাতছানি। বুকভরা আশা নিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ সিটি অফ ম্যানচেস্টার স্টেডিয়াম। কিন্তু ৬৬ মিনিটেই পিছিয়ে যায় স্বাগতিকরা ২-১ গোলে। শিরোপা জয়ের আশা ক্ষীণ হতে থাকে। সময় গড়ায় ইনজুরি সময়ে। ইনজুরি সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে সমতা ফেরান সিটি স্ট্রাইকার ইডেন ডেকো।
কিন্তু, তাতে তো আর শিরোপা জেতা হয় না। জয় চাই জয়! অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিট। মারিও বালোতেল্লির ডি-বক্সের বাইরে থেকে আলতো করে বাড়ানো বল জালে জড়ান সার্জিও আগুয়েরো এবং টিভি সেটের পর্দা থেকে ভেসে সেই আকাশচুম্বি চিৎকার আগুয়েরোওওওওওও! বুনো উল্লাসে ফেটে পড়ে ম্যানচেস্টার সিটির সমর্থকেরা। সেদিন নাকি কেঁদেছিলেন অ্যাগুয়েরো। জয়ের উল্লাসে!
ম্যানচেস্টার সিটির সেই তারকারই অবসরের নিশ্চিত খবর এলো এবার । তাঁর তৎকালীন ক্লাব বার্সেলোনা আয়োজিত এক বিদায় অনুষ্ঠানে ইতি টেনে নিলেন ফুটবল ক্যারিয়ারের। তুলে রাখছেন নিজের বুটজোড়া। বয়স ৩৩ এর কোটায়। বয়সের ভারে নয়। নিয়তির অদ্ভুত পরিহাসে তাঁকে কিছুটা বাধ্য হয়েই নিতে হচ্ছে বিদায়। ফুটবলের সবুজ ঘাস থেকে, বিস্তৃর্ণ এক পরিযাত্রা থেকে। হৃদপিণ্ডটা বোধহয় একটু বেইমানী করে ফেললো, কিংবা অভিমানি হয়ে থামিয়ে দিলো আগুয়েরোর ফুটবলীয় পদযাত্রা।
অথচ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দাপিয়ে বেড়িয়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন স্পেনে। গায়ে জড়িয়েছিলেন ইউরোপিয় ক্লাব ফুটবলের অন্যতম সেরা দল বার্সেলোনার জার্সি। তাঁদের হয়ে ক্যারিয়ারের শেষ সময়টুকু নিঙড়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। হতে চেয়েছিলেন ক্লাব কিংবদন্তিদের একজন।
সেই পথেই ছিলেন তিনি। ক্লাবের হয়ে নিজের প্রথম গোলটা আদায় করেছিলেন এল ক্ল্যাসিকোতে চির প্রতিদ্বন্দী রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে। এক নতুন আশার আলোয় বুক বেঁধেছিলেন আগুয়েরো। কিন্তু তিনি হয়ত ঘুনাক্ষরেও টের পাননি সেই বুকের মালিক হৃদপিণ্ড তাঁর বিরুদ্ধে ঘোষণা করতে চলেছে বিদ্রোহ।
এল ক্ল্যাসিকোতে করা গোল তাঁকে জায়গা করে দেয় শুরুর একাদশে। রায়ো ভায়োকানোর বিপক্ষে খেলেছেনও পুরো ৯০ মিনিট। যদিও প্রতিপক্ষ স্ট্রাইকার রাদামেল ফালকাও এর একমাত্র গোলে হারতে হয় বার্সেলোনাকে। পরে লিগ ম্যাচে আলভেসের বিপক্ষেও শুরুর একাদশে ছিলেন আগুয়েরো। দিনটা বোধহয় খুবই অলুক্ষণে!
ম্যাচের ৪২ মিনিটে বুকের অস্বস্তি নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় অ্যাগুয়েরোর। তারপর চলে একের পর এক ডায়াগোনিসিস পরীক্ষা। ভিন্ন ভিন্ন তথ্যে ভেসে বেড়ায় ফুটবলের আকাশে। হয়ত দশ দিন কিংবা এক মাস, বড়জোর তিন মাস মাঠের বাইর থাকতে হতে পারে আগুয়েরোকে। সব গুঞ্জন কিংবা গুজব উড়িয়ে নিশ্চিত খবর এল – তিনি একেবারেই ছেড়ে দিচ্ছেন ফুটবল।
অ্যারিথমিয়ায় আক্রান্ত অ্যাগুয়েরো। এই রোগে হৃদপিণ্ড হারিয়ে ফেলে তাঁর স্বাভাবিক স্পন্দন ছন্দ। এ নিয়ে হয়ত বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে কিন্তু ফুটবলের মাঠের দাপিয়ে বেড়ানো যায় না। অগত্যা অবসর। নিজ দেশ আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপটাও আর জেতা হলো না। জেতা হলো না ক্লাবের হয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ।
ক্লাবের হয়ে করা ৩৮৬ ও আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের হয়ে করা ৪১ গোলেই থেমে গেলেন গত এক দশকের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার সার্জিও কুন অ্যাগুয়েরোর ক্যারিয়ার যাত্রা। আর দেখা যাবেনা তাঁকে ফুটবলের মাঠে। আর অ্যাগুয়েরো বলে গলা ফাটাবেন না ধারাভাষ্যকাররা। এভাবে প্রদীপ নিভে যায়! এভাবেও নিভে যায়!
বিদায় সার্জিও কুন অ্যাগুয়েরো!