এহসানুল হক সেজান, বিতর্কিত এক আক্ষেপ

তখন জাতীয় দলে চট্টগ্রামের দাপট ছিল খুব। এক সাথে চাঁটগার একগাদা ক্রিকেটারকে বাংলাদেশ দলের জার্সি পরতে দেখাটা ছিল খুব নিয়মিত ঘটনা। আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, নুরুল আবেদীন নোবেলদের এই লিগ্যাসিটা পরবর্তীতে ধরে রাখেন নাফিস ইকবাল, নাজিমউদ্দিন, আফতাব আহমেদ কিংবা আজকের তামিম ইকবালরা।

সেই মিছিলে ছিলেন আরো একজন। হয়তো যথাযথ পরিচর্যা, সুযোগ আর নিজের প্রতি যত্নশীল হলে হয়তো তিনিও হতেন পারতেন চট্টগ্রামের পতাকাবাহীদের একজন। কিন্তু পারেননি বলেই আজকাল তাঁর পরিচয়টা কেউ খুব একটা জানে না, আলোচনার বাইরে তিনি।

বলছি, এহসানুল হক সেজানের কথা। ঘরোয়া ক্রিকেটে যত বড় ব্যাটসম্যান তিনি ছিলেন, আজকাল অবশ্য ততটা ঠিক আলোচিত নন – বরং তাঁকে ঘিরে বিতর্কও হয়েছে বিস্তর। যদিও, সব ছাপিয়ে তিনি ক্রিকেটের সাথেই আছেন। আসলে কতটা বড় ক্রিকেটার ছিলেন সেজান? কিংবা কত বড় ক্রিকেটার হতে পারতেন?

১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মত অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ খেলতে যায় বাংলাদেশ দল। অধিনায়ক সাব্বির খানের নেৃতৃত্বে সেই দলে আল শাহরিয়ার রোকন, মুশফিকুর রহমান বাবু, মেহরাব হোসেন অপি, হান্নান সরকার কিংবা মঞ্জুরুল ইসলামরা খেলেন। ছিলেন আজকের গল্পের প্রধান চরিত্র এহসানুল হক সেজানও। সেবার প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ, ফাইনালে হারায় ক্রিস গেইল রামনরেশ সারওয়ানদের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।

২০০০ সালে সেজানের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। সেবছরই জাতীয় ক্রিকেট লিগ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের মর্যাদা পায়। প্রথম আসরেই ৩ গড় নিয়ে ৫৪০ রান করেন সেজান। পরের মৌসুমটা সাদামাটা গেলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচকরা তাড়াহুড়া করে সদ্য কৈশোর পেড়োনো সেজানকে টেস্ট দলে নেন।

কিন্তু, টেস্ট আর ঘরোয়া ক্রিকেটের পার্থক্যটা যে আকাশ আর পাতালের সেটা প্রথম ম্যাচেই বুঝে ফেলেন সেজান। সেটা ২০০২ সালের জুলাইয়ের শ্রীলঙ্কা সফর। প্রথম টেস্ট। এক সাথে চারজনকে টেস্ট ক্যাপ দেয় বাংলাদেশ। সেজানের সাথে আরো তিনজন প্রথমবারের মত নামেন টেস্ট খেলতে – হান্নান সরকার, তালহা জুবায়ের ও আলমগির কবির।

ম্যাচের প্রথম তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে নিজের দ্বিতীয় বলেই অভিষিক্ত লঙ্কান ফাস্ট বোলার সুজিয়া ডি সিলভার এক বাউন্সার লাগে মাথায়। ১৪ তম বলে রানের খাতা খুলেন। ইনিংসে করেন দুই রান। ২১ তম বলে দিলহারা ফার্নান্দোর বলে বোল্ড হয়ে ফিরে আসেন। 

তৃতীয় দিনে আবারও ব্যাট করতে নামেন শ্রীলঙ্কার আকাশচুম্বি লিডের সামনে। এবার ১০ বলে পাঁচ রান করে ওই দিলহারা ফার্নান্দোরই শিকার হন। সেটা ছিল শ্রীলঙ্কার স্বর্ণযুগ। অরবিন্দ ডি সিলভা ডাবল সেঞ্চুরি (২০৬) করেন, সনাথ জয়াসুরিয়া সেঞ্চুরি (১৪৫), কুমার সাঙ্গাকারা হাফ সেঞ্চুরি (৭৫) করেন। মুত্তিয়া মুরারিধরণ ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হন। শ্রীলঙ্কা ইনিংস ও ১৯৬ রানে জিতে যায়।

পরের টেস্টেই ফেরানো হয় মোহাম্মদ আশরাফুুলকে। ফলাফল না পাল্টালেও আশরাফুল প্রিয় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ৭৫ রানের একটা ইনিংস খেলে ফেলেন। ফরে, এহসানুল হক সেজান লম্বা সময়ের নির্বাসনে যান টেস্ট থেকে। যদিও ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি টানা তিনটা স্মরণীয় মৌসুম কাটান। সাতটা সেঞ্চুরি করেন ৫২’র ওপর গড় নিয়ে। সর্বোচ্চ ইনিংসটা ছিল ১৮৬ রানের।

তবে, আর কখনোই টেস্ট দলে ফেরা হয়নি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই টেস্টটাই সেজানের ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট হয়ে গেছে। প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার শেষ করেন ৩৯ গড়ে চার হাজারের ওপর রান নিয়ে। ছিল ১০ টি সেঞ্চুরি ও ২৪ টি হাফ সেঞ্চুরি।

ওয়ানডেটাতে অবশ্য টেস্টের চেয়ে বেশি সুযোগ পেয়েছিলেন। ২০০২ সালে সালে ঘরের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেক। সেখান থেকে সোজা সুযোগ পান বিশ্বকাপে, ২০০৩ সালের সেই কলঙ্কিত বিশ্বকাপ। বাংলাদেশ হারে কানাডা ও কেনিয়ার মত দলের বিপক্ষে। চারটা ম্যাচে সুযোগ পেয়ে মোটে ২৮ রান করেন, নেন দুটি উইকেট।

এর মধ্যে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালবাসা দিবসের দিনে পিটারমরিজবার্গে ইনিংসের প্রথম তিন বলে ইতিহাসে প্রথমবারের মত হ্যাটট্রিক করেন লঙ্কান কিংবদন্তি পেসার চামিন্দা ভাস। এই সেজানকে স্লিপে দাঁড়ানো মাহেলা জয়াবর্ধনের ক্যাচ বানিয়েই হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন ভাস।

পরের ম্যাচেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম বলে একই কায়দায় আউট হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু, ভাসবার্ট ড্রেক্সের ডেলিভারিতে দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ ছাড়েন ক্রিস গেইল, সেজানদের যুব ক্রিকেটের প্রতিপক্ষ।

সেই বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচটাই সেজানের ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ছয় ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংস ২০ রানের। তবে, যতই প্রতিভা থাকুক বলে আগে পরে দাবি করা হোক না কেন যতদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেন সেই প্রতিভার ছিটেফোটাও দেখা যায়নি।

২০০৩ সালের বিশ্বকাপের পর খালেদ মাসুদ পাইলটের নেতৃত্বে সেই দলে অনেকরকম রদবদল হয়। মাঠের পারফরম্যান্সের সাথে সাথে বাইরেও পাইলট-সেজানদের আচরণ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। শৃঙ্খলা ভঙ্গের মত গুরুতর অভিযোগও আসে।

ফলে, জাতীয় দলের দুয়ার আর কখনোই খোলেনি সেজানের। যদিও, তিনি ক্রিকেটের সাথেই ছিলেন পরবর্তীতে। এখনও আছেন। পায়ে গলিয়েছেন অনেক রকম জুতো। কখনো কর্মকর্তা, কখনো ম্যাচ রেফারি কখনো বা বিসিবির বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক। যদিও, এসব পরিচয়েও তিনি বিতর্কের জন্মও কম দেননি।

সব ছাপিয়ে অবশ্য সেজানের ক্যারিয়ারের নি:সন্দেহে সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তটা এসেছে ভিন্ন এক পরিচয়ে। পার্ট টাইম এই অফস্পিনার ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে পেয়েছিলেন ব্রায়ান লারার উইকেট, স্বয়ং ক্রিকেটের বরপুত্র। যদিও, বাংলাদেশ ক্রিকেটে সেজানের নামটি নানা আক্ষেপ কিংবা বিতর্কের বারুদে ঠাসা!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link