প্রতিভার আলোহীন প্রদীপ

২০০০ এর পরবর্তী সময়ে ওপেনিংয়ে বাংলাদেশের হয়ে বেশ সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন হান্নান সরকার। বলা হত, সে সময় বাংলাদেশের টেকনিক্যালি সবচেয়ে সলিড ওপেনার ছিলেন তিনি। মাত্র ২০ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের প্রারম্ভেই দেখিয়েছিলেন প্রতিভার ঝলক। তবে সেটি খুব বেশি সময় ধরে রাখতে পারেননি। অল্প সময়েই ঝরে পড়েন জাতীয় দল থেকে।

ছোট্ট ক্যারিয়ারে অর্জনের খাতাটা এক কথায় বলতে গেলে প্রাপ্তির চেয়ে কষ্টটাই বেশি। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল, ব্রেট লি, গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেস্পিদের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করে টেস্টের দুই ইনিংসেই হাফ সেঞ্চুরিটা নি:সন্দেহে সাদা পোশাকের সেরা সুখস্মৃতি। এই সাদা পোশাকেই এক বিষাদের স্মৃতি আঁকড়ে আছে হান্নানের পুরো ক্যারিয়ারে।

সুনীল গাভাস্কারের পাশে নাম লেখাতে কেই বা না চাইবে?

সুনীল গাভাস্কার! ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তি! এত সেঞ্চুরি আর পাহাড়সম রান যার ঝুলিতে তাঁর সাথে রেকর্ডে নাম থাকাটা নিশ্চয়ই কম কিছু নয়! কিন্তু সেটি সুখকর কোনো স্মৃতি নয়! এক বিষাদময় রেকর্ডে গাভাস্কারের পাশে নাম তুলেছিলেন হান্নান সরকার।

ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম বলে আউট হবার ঘটনা নেহায়েৎ কম নয়। কিন্তু টেস্টে ইনিংসের প্রথম বলেই তিনবার আউট হওয়ার ঘটনা আছে মাত্র দুই বার! এই লজ্জাজনক ঘটনার একটিতে নাম আছে সুনিল গাভাস্কারের। অপর নামটি হান্নান সরকার। সুনিল অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন বোলারের কাছে তিনবার ইনিংসের প্রথম বলে আউট হন। কিন্তু হান্নান বিস্ময়কর ভাবে তিনবারই ক্যারিবিয়ান পেসার পেড্রো কলিন্সের কাছেই তিনবার শূন্য রানে ধরাশায়ী হয়েছেন।

হান্নান-কলিন্স জুটিটা তাই ইতিহাসের পাতায় ভিন্ন ভাবেই লেখা। আর কলিন্সের স্মৃতি থেকে এটি কিছু সময়ের জন্য মুছে গেলেও হান্নানের স্মৃতিতে এই বিষাদময় ঘটনা আজও তাজা। বলতে পারেন একটা মিরাকলই! যার রহস্যটা অবশ্য হান্নান নিজেও কখনও বুঝে উঠতে পারেনি।

সাল ২০০৮। ইংল্যান্ডে ন্যটিংহামশায়ারের এক লিগে খেলছিলেন ক্যারিবিয়ান বাঁ-হাতি পেসার পেড্রো কলিন্স। ঠিক তখন তাঁর সাথে দেখা হল হান্নানের। চেহারা দেখে কলিন্স যেন কোনোভাবেই তাঁকে মনে করতে পারছে না। এরপর নিজের পরিচয় দিতেই কলিন্সের মনে পড়লো পুরোনো সেই স্মৃতি।

কলিন্স সাময়িক সময়ের জন্য তাঁকে ভুলে গেলেও হান্নান যে তাঁকে কোনোদিনই ভুলবেন না। কলিন্সের কারণেই সুনিল গাভাস্কারের পাশে লজ্জাজনক এক রেকর্ডে তাঁর নাম!

হান্নানের ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল স্বপ্নের মত। মাত্র ২০ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। ২০০২ সালের জুলাইয়ে পি সারা ওভালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে প্রথম ইনিংসেই ফিফটির দেখা পান হান্নান। প্রথম ম্যাচেই নিজের প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছিলেন এই ওপেনার।

সে সময়ে বাংলাদেশের জন্য কোনো ম্যাচ জয় ছিল বিশাল ব্যাপার। কালে-ভদ্রে জয়ের দেখা পাওয়া বাংলাদেশের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই বিষয়গুলো ছিল বড় প্রাপ্তি। ওই সিরিজেই রঙিন পোশাকেও অভিষেক হয় তাঁর। তবে রঙিন জার্সিতে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি এই ওপেনার।

পরের সিরিজেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে আরেকটি ফিফটি জুড়ে দেন হান্নান। তবে ওয়ানডেতে ছিলেন চরম ব্যর্থ। ওই বছর ৪ ওয়ানডেতে করেন মোটে ২৮ রান! সাদা পোশাকে বেশ উজ্জ্বল পারফর্ম করলেও রঙিন পোশাকে ছিলেন সাদামাটা। ওয়ানডেতে এই ব্যর্থতা চলতে থাকে পরের বছর ২০০৩ এর অনেকটা সময় ধরেই। তবে টেস্টে অনেকটাই ভাল খেলছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক টেস্টের দুই ইনিংসেই দেখা পেয়েছিলেন ফিফটির।

ওয়ানডেতে মেইডেন ফিফটির দেখা পেয়েছিলেন সময়ের হিসেবে এক বছরের বেশি আর ম্যাচের হিসেবে দশ ম্যাচ পর! প্রথম ১০ ওয়ানডেতে মাত্র ৮২ রান করার পর পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচে ওয়ানডের দু’টিতেই ফিফটির দেখা পান হান্নান। রঙিন পোশাকে ক্যারিয়ারের সেরা সিরিজটিও ছিল সেটিই।

একটা বছর ভালোই চলছিল। ১২ টেস্টে দেখা পান পাঁচ ফিফটির। এরপরই হঠাৎ সাদা পোশাকে খেই হারিয়ে ফেললেন। ২০০৪ সালে ৫ টেস্টে করেছেন ৬ গড়ে মাত্র ৫৯ রান! উল্টো চিত্রটা ছিল ওয়ানডেতে। ক্যারিয়ারের শুরুটা হতাশাজনক হলেও ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেন হান্নান। ২০০৪ সালে ৪ ম্যাচে এক ফিফটিতে ২৮ গড়ে করেছিলেন ১১৩ রান। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫৯ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩৬ করার পরেও কোনো এক অজানা কারণে টেস্টের সাথে সাথে ওয়ানডে দল থেকেও বাদ পড়েন হান্নান।

১৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে ২০ গড়ে ৬৬২ রান। আছে ৫ ফিফটি। ২০ ওয়ানডেতে ১৯ গড়ে ৩ ফিফটিতে করেছেন ৩৮৩ রান। ঘরোয়া ক্রিকেটে ১৮০ ম্যাচে ৩ সেঞ্চুরি আর ৪১ ফিফটিতে গড়েছেন প্রায় ৬ হাজার রান।

ক্যারিয়ারের শুরুতেই প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে ক্রিকেটভক্তদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন হান্নান। ২০ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের মাত্র ২ বছরের মাথায় ২২ বছর বয়সে দল থেকে বাদ পড়েন তিনি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের তখনকার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পাইপলাইনে খুব বেশি অপশনও ছিল না। তাই ঘরোয়া ক্রিকেটে একটু ভাল খেললেই জাতীয় দলের রাস্তাটা ছিল বড্ড সহজ। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আর কখনোই জাতীয় দলে সুযোগ পাননি হান্নান সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link