ভীম-তেজী এক লঙ্কান সিংহ

যেমন বিশাল তাঁর দেহ, তেমন বিশাল তাঁর হৃদয়। তার চেয়েও বেশি শক্ত তাঁর মনোবল। ১৯৯৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে যখন শ্রীলঙ্কা সবাইকে চমকে দিয়ে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ জিতে নেয়, তখন কিন্তু দলটা শক্তিমত্তার দিক থেকে মোটেও বাকিদের চেয়ে, কিংবা ফাইনালের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে এগিয়ে ছিল না।

এক বলে এক রান! ঠিক তখনই হয়তো বেঁজে উঠছে কারও ফোন। আন্ডারওয়ার্ল্ডের খবরদারিতে হারিয়েছে ‘গৌরব’; টিকে আছে কেবল ‘অনিশ্চয়তা’; শুদ্ধতার অনিশ্চয়তা।

নর্তন-কুর্দন থেকে শুরু করে টাকার ঝনঝনানি – এত কিছুর মাঝে হারিয়ে গেছে ক্রিকেট। মারমার কাটকাট টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বলি হচ্ছে সৌন্দর্য্য। এর মাঝেও যারা শুদ্ধ ক্রিকেটের জন্য কখনও কথায়, কখনও লেখায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের একজন হচ্ছেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা।

নিউজিল্যান্ডের কিংবদন্তি মার্টিন ক্রো ক্রিকেট মান্থলিতে লার্জ অ্যান্ড ইন চার্জ শিরোনামে এক আর্টিকেলে তাঁর ব্যাপারে লিখেছিলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, আমি অস্ট্রেলিয়ানদের অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি ঘৃণা করি। তাই, যে মানুষটা এদের নাকানিচুবানি খাওয়াতে পারে তাকেই আমি নিজের হিরো বলে মনে করি। একজন মানুষের বাহ্যিক রূপটা যে কখনও কখনও তাঁকে প্রকাশ করতে পারে না, সেটা আমি বুঝেছিলাম অর্জুনা রানাতুঙ্গাকে দেখে। দেখতে গোলাকার হলেও তিনি হলেন মাস্টারমাইন্ড। ওর তলপেটে নরম বলতে কিছু নেই। আমার দেখা সবচেয়ে শক্ত ক্রিকেটার হলেন অর্জুনা।’

যেমন বিশাল তাঁর দেহ, তেমন বিশাল তাঁর হৃদয়। তার চেয়েও বেশি শক্ত তাঁর মনোবল। ১৯৯৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে যখন শ্রীলঙ্কা সবাইকে চমকে দিয়ে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ জিতে নেয়, তখন কিন্তু দলটা শক্তিমত্তার দিক থেকে মোটেও বাকিদের চেয়ে, কিংবা ফাইনালের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে এগিয়ে ছিল না।

দলটাকে আসলে এগিয়ে দিয়েছিলেন এই অর্জুনা ও তাঁর দৃঢ় মনোবল। তিনি দলের মধ্যে এমন একটা ইতিবাচক মানসিকতা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন যে, বিশ্বকাপ জয় সম্ভব – তা সে প্রতিপক্ষ যেই হোক না কেন। অর্জুনা তাই শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট তো বটেই বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসেরও রূপকথার নায়ক।

ক্রিকেটার হিসেবে অর্জুনা কেমন ছিলেন? পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝার কোনো উপায় নেই। ৯৩ টি টেস্ট আর ২৬৯ টি ওয়ানডেতে ৩৫-এর আশেপাশে গড় নিয়ে ব্যাট করেছেন। সব মিলিয়ে রান ১২ কি ১৩ হাজার। ডান হাতি মিডিয়াম পেসে উইকেট পেয়েছেন ১০০’রও কম।

১৮ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেক হয়। সেটা শ্রীলঙ্কা দলেরও প্রথম টেস্ট ছিল। দেশের হয়ে প্রথম টেস্ট হাফ সেঞ্চুরির মালিক তিনি। সেই থেকে দীর্ঘ ১৮ বছরেরও বেশি সময় দলকে সার্ভিস দিয়েছেন। লঙ্কা দলটাকে একটু একটু করে বড় করেছেন। তাঁর হাত ধরেই সনাথ জয়াসুরিয়া, অরবিন্দ ডি সিলভা, চামিন্দা ভাস, মুত্তিয়া মুরালিধরণ, কুমার সাঙ্গাকারা কিংবা মাহেলা জয়াবর্ধনেদের চূড়ান্ত বিকাশ হয়।

আধুনিক ওয়ানডে ক্রিকেটের কথা বলতে গেলে অর্জুনার কথা বলতেই হয়। বড় শট না খেলেও স্কোরবোর্ডটাকে কি করে এগিয়ে নেওয়া যায়, সেই কৌশলটা জানা ছিল তাঁর। ঠাণ্ডা মাথায় উইকেটের দু’পাশে খেলে রান আদায় করে নিতে পারতেন তিনি। ওই সময় তাঁর ফিটনেস নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা ছিল। তাঁর হেঁটে হেঁটে রান নেওয়ার দৃশ্যটা উঠে গেছে ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু, এসব নিয়ে কখনোই খুব বেশি চিন্তা করেননি রানাতুঙ্গা।

বিশ্বকাপ জয়ের পরের আসরেও, ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে অধিনায়ক হয়ে গিয়েছিলেন। দলের বাজে পারফরম্যান্সের জের ধরে সেবার হারান অধিনায়কত্ব। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা থেমে যায় এর এক বছর পরেই।

এরপর ক্রিকেট প্রশাসনের সাথে জড়ান নিজেকে। ২০০৮ সালে নির্বাচিত হন শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের (এসএলসি) চেয়ারম্যান। জানুয়ারিতে তিনি নিয়োগ পান, ডিসেম্বরেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিতর্কিত সেই সময় এমন কিছু সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন যা ফলপ্রসু হয়নি।

এর মধ্যেই ফিক্সিং বা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট – সব কিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদী মুখ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন অর্জুনা। তিনিই সেই গুটিকয়েক মানুষদের একজন যিনি মনে করেন, ক্রিকেটের বিশুদ্ধতা নষ্টের মূলে আছে এই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট।

বর্তমান সময় তিনি লঙ্কান রাজনীতির বড় মুখ। শ্রীলঙ্কার ট্রান্সপোর্ট ও সিভিল অ্যাভিয়েশন মন্ত্রী তিনি। আসলে অর্জুনা রাজনৈতিক পরিবারেরই সদস্য। পাঁচ ভাই যেমন ক্রিকেট খেলেছেন, খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করে নিজেদের জড়িয়েছেন রাজনীতিতে। নিশান্ত রানাতুঙ্গা বোর্ডের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন।

রাজনৈতিক জীবনটাও অনেক কাঁটায় ভরা রানাতুঙ্গার। সত্য-মিথ্যা নানারকম অভিযোগও উঠেছিল। যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতারও হয়েছেন।

কিন্তু, সব সামাল দিয়ে দিব্যি মহীরূপ হয়ে টিকে আছেন অর্জুনা। এখানেও তিনি অটল, অবিচল। ঠিক যেন ১৯৯৫ সালের সেই রানাতুঙ্গা, যিনি মেলবোর্ন টেস্টে স্বয়ং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আম্পায়ার ড্যারিল হেয়ারের বারবার মুরালিধরণের ডেলিভারিকে ‘নো’ ডাকার প্রতিবাদে বের হয়ে গিয়েছিলেন মাঠ থেকে।

তখনও লঙ্কার বিশ্বজয় হয়নি, বুকে কতটা সাহস থাকলে নাক উঁচু অজিদের বিপক্ষে মাঠ ছেড়ে দলবল নিয়ে বেরিয়ে আসা যায়। বছর চারেক বাদে আবারো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এবার ইংল্যান্ডের মাটিতে, ওয়ানডেতে। মুরালিধরনকে ‘নো’ ডেকেছিলেন আম্পায়ার রস এমারসন।

শেন ওয়ার্নের সাথে কখনো ঠিক বনিবনা হত না। দু’জনের বৈরিতা নিয়ে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ খরচ করা যাবে। সেই ওয়ার্ন ক্যারিয়ার শেষ করে ২০০৮ সালে একটা বই লিখেছিলেন। ‘শেন ওয়ার্নস সেঞ্চুরি’ নামের সেই বইয়ে তার ক্যারিয়ারে প্রভাব রাখা ১০০ ক্রিকেটারের প্রসঙ্গ এনেছিলেন ওয়ার্ন।

ঠাঁই পাননি অর্জুনা। ওয়ার্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ‘মাঠের সবাইকে আপনি বন্ধু বানাতে পারবেন না। তবে, যদি পারতাম তবে অবশ্যই অর্জুন ১০১ তম ব্যক্তি হিসেবে জায়গা পেত। ও ক্রিকেটের মানচিত্রে শ্রীলঙ্কার নাম লিখে দিয়েছে। আর আপনি কি জানেন? আমি মনে মনে ওকে দারুণ এক ক্রিকেটারই মনে করি!’

চরম শত্রুর কাছ থেকে এমন প্রশংসা বানী পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...