খেতেই হবে, মান যাই হোক!

আমরা অনেকেই টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি এদেশের মানুষের বিমুখতা নিয়ে প্রশ্ন তুলি। খুবই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। এক্ষেত্রে নানা বিষয়ের পাশাপাশি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির তুলনায় টেস্ট ম্যাচ চলাকালীন স্টেডিয়ামে মানুষের কম উপস্থিতির প্রসঙ্গটা ওঠে আসে। এটাও খুব প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় বেশিরভাগ সময় কারো দৃষ্টিগোচর হয় না। বেশ কয়েকটা টেস্ট ম্যাচের পুরোটা মাঠে বসে দেখার অভিজ্ঞতায় সে বিষয়টা নিয়েই আজ লিখছি।

আপনি হয়তো জানেন না, সাধারণ দর্শক হিসেবে মিরপুর শেরে বাংলায় কোনো গোটা টেস্ট ম্যাচ দেখা দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিনতম কাজের একটা। গোটা একটা টেস্টের কথাই-বা কেন বলছি! শেরে বাংলায় অনুষ্ঠিত কোনো টেস্টের পুরো একটা দিনের খেলা দেখাও তো দুনিয়ার অন্যতম কঠিন কাজ। সেটা কেন? খোলাসা করছি।

যাঁরা একবার হলেও শেরে বাংলায় ম্যাচ দেখেছেন তাঁরা আমার সাথে এ ব্যাপারে নি:সন্দেহে একমত হবেন যে, সেখানে দর্শকদের জন্য বিক্রি করা খাবারের মান খুবই বাজে। এমনিতে স্টেডিয়ামে প্রাসঙ্গিকভাবেই খাবারের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। প্রাসঙ্গিক বলছি কারণ একটা সিরিজে খাবার বিক্রির জন্য অ্যাক্রেডিটেশন পেতে বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয় বিক্রেতাদের। ফলে বাইরের দামে এখানে খাবার বিক্রি করলে পোষাণোটা কঠিন। কিন্তু দাম বেশি নেওয়ার পর সেই দামের কাছাকাছি মানের খাবার সরবরাহ করলেও মানা যেত। দু:খজনকভাবে সেখানে কেবল চড়া দামই হাঁকানো হয়। আর খাবারের মান ও স্বাদ হয় অতি নিম্নমানের।

শেরে বাংলায় এক প্যাকেট তেহারি বিক্রি করা হয় সাধারণত ১২০ টাকা করে। সেই তেহারির ফ্লেভার পাওয়া যায় না বললেই চলে, মাংস থাকে একেবারে ছোটো-ছোটো ৪-৫ টুকরা এবং পরিমাণে যা পাওয়া যায় তা একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য যারপরনাই অপ্রতুল।

কেউ যদি সেখানে বার্গার খেতে চান তবে তাঁকে একটা বার্গারের পেছনে গুনতে হবে ১০০-১২০ টাকা। কোনোদিন মাঠে না গিয়ে থাকলে দামটা ঠিকই মনে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, খাবারের মান অনুযায়ী এই দামটাই বেশ চড়া।

এখানে বার্গারে এমন বান ব্যবহার করা হয় যা চিবিয়ে গিলতে আপনাকে বারবার পানির সাহায্য নিতে হবে। সাধারণত বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সময় আধার হিসেবে আমরা যে বনরুটিগুলা ব্যবহার করতাম অনেকটা সেরকম মানের।

বার্গার যদি চিকেনের হয় তবে ফ্রাইড চিকেন থাকবে এক টুকরা। ঠান্ডা, শক্ত ও পোতানো এক টুকরা ফ্রাইড চিকেন মাছের আধারের বনরুটির মধ্যে ঢুকিয়ে কোনো শসা, টম্যাটো, লেটুস, সস, ম্যায়োনিজ না দিয়ে ১২০ টাকা করে হাতিয়ে নেন বিক্রেতারা। বর্ণনা শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এই বার্গার ১২০ টাকা মূল্যের কতটা যোগ্য!

সাধারণ দর্শক হিসেবে শেরে বাংলায় বসে একটা সম্পূর্ণ টেস্ট বা একটা টেস্টের গোটা একটা দিন দেখা যে পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলার মধ্যে অন্যতম সেটা মূলত এই নিম্নমানের খাবারের কারণেই।

এমনিতে আমাদের দেশে এখন ওয়ানডে ম্যাচগুলা দিবারাত্রির হয়ে থাকে। ম্যাচ শুরু হয় দুপুরে, শেষ হয় রাত সাড়ে নয়টা-দশটার দিকে। এক্ষেত্রে চাইলেই মাঠের এসব মানহীন খাবারকে এড়িয়ে চলা যায়। দুপুরে ম্যাচ শুরু হওয়ায় মধ্যাহ্নভোজটা বাইরে থেকেই সেরে ফেলা যায়। আর খেলা শেষে বাইরে কোনো রেস্তোরাঁ কিংবা বাসায় গিয়ে নৈশভোজ করা যায়। ওয়ানডে খেলা সম্পন্ন করতে যেহেতু সাড়ে সাত ঘণ্টা সময় লাগে তাই মাঠে বসে থাকা অবস্থায় হালকা খিদে লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে গ্যালারিতে বিক্রি করা স্ন্যাকস, আইসক্রিম, কোক খেয়েই তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

এবার আসি টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ক্ষেত্রে৷ বাংলাদেশে টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলা বেশিরভাগ সময়ই সন্ধ্যায় শুরু হয়৷ ফলে এখানে মধ্যাহ্নভোজের কোনো ঝামেলা নেই। আর ম্যাচ যেহেতু সাড়ে তিন ঘণ্টায় শেষ হয়ে যায় সেক্ষেত্রে মাঠেই নৈশভোজ সারার কোনো তাড়াও থাকে না। তাছাড়া খুব কম সময়ের ম্যাচ বিধায় খেলা দেখতে দেখতে খুব বড়ো ধরনের খিদে লাগারও কথা না।

যদিও পাকিস্তানের বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি সিরিজিটা দুপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ সেক্ষেত্রে সহজেই বাইরে থেকে দুপুরের খাবার সেরে মাঠে খেলা দেখা গেছে।

কিন্তু আসল বিপত্তিটা বাধে টেস্ট ম্যাচের সময়। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই স্টেডিয়ামের খাবারকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। বাংলাদেশে টেস্ট খেলা শুরু হয় সকাল দশটায়। শেষ হয় পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায়। এ সময়টাতে শত চেষ্টা করেও গ্যালারিতে বিক্রি করা খাবার না খেয়ে থাকা সম্ভব না।

টেস্ট ম্যাচ সকালে শুরু হওয়ায় বাইরে থেকে নাশতা সেরেই মাঠে যাওয়া যায়। আবার সন্ধ্যায় দিনের খেলা শেষ হওয়ায় নৈশভোজেরও কোনো দরকার পড়ে না। কিন্তু মধ্যাহ্নভোজের সময় তো না খেয়ে থাকা যায় না। তাই দুপুরে কেউ না চাইলেও স্টেডিয়ামের মানহীন খাবার খেতে বাধ্য।

এবার তাহলে বলুন, ঢাকার যানজট ঠেলে খাবারের এমন সমস্যা মাথায় নিয়ে মানুষ কেন মাঠে বসে টেস্ট খেলা দেখতে যাবে? টেস্ট ক্রিকেটের খুব বড়ো ধরনের ভক্ত না হলে এরকম ‘যন্ত্রণাদায়ক বিলাসিতা’ কেউ করবে না বলেই দৃঢ় বিশ্বাস। খেলায় তখন মধ্যাহ্নভোজের বিরতি, ফাঁকা সময়টা তাই দুকলম লিখেই পার করলাম। এখন আমি এক টুকরা শক্ত চিকেন ফ্রাই সম্বলিত একটা বনরুটি খাব। কী আর করার! সন্ধ্যা অবধি টিকে থাকতে হবে যে!

উল্লেখ্য, স্থিরচিত্রের খাবার তালিকাটা আদতে প্রতীকী। প্রতি সিরিজে এই একই তালিকা প্রত্যেক গ্যালারিতে সেঁটে মূলত দায় সারা হয়। বাস্তবে এই তালিকায় উল্লেখিত কেবল ২-৩টা খাবার পাওয়া যায় গ্যালারির ফুড কোর্টে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link