বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে নির্লিপ্ত চরিত্র বোধহয় তিনি। অন্তত আজকে ভোর রাত পর্যন্তও একথা যে কেউ নির্দ্বিধায় মেনে নিত। তবে আজ বাংলাদেশে ঠিক করে সূর্য রোদ দেবার আগেই বদলে গেল প্রেক্ষাপট। টক অব দ্য টাউন এখন সিলেটের এবাদত হোসেন, যার কাধে চড়েই বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ের।
বাংলাদেশে শীতের সকালে সূর্য পুরোপুরি মাথা তুলতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে যায়। আর এবাদতের বাড়ি সিলেটে তো সেই শীতের তীব্রতা আরো বেশি। তবে নিউজিল্যান্ডের মাউন্ট মঙ্গানুইতে আজ উঁকি দিয়েছে বাংলাদেশ নামের এক সূর্য। যেই সূর্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল রোদটির নাম আমাদের এবাদত হোসেন।
নিউজিল্যান্ডে প্রথম তিনটি দিনই বাংলাদেশ ভালো কাটিয়েছে। আসলে বলা উচিৎ দারুন কাটিয়েছে। কেননা প্রেক্ষাপট একেবারেই বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না। টানা ব্যর্থতায় ঘুরতে থাকা একটা দল গিয়ে পড়লো নিউজিল্যান্ডের কঠিনতম কন্ডিশনে। ফলে হারটাই যেন সকলের কাম্য ছিল।
এমনকি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাথে জড়িত অনেকেও ম্যাচটা ঠিক পাত্তা দিতে চাচ্ছিলেন না। যেন শুধু খেলার জন্যই খেলা।
তবে ক্রিকেটাররা ভিন্ন ভাবে ভাবতে পেরেছিলেন। জয়-শান্তদের ব্যাটিং নিউজিল্যান্ডের মানুষদের মন জয় করতে পেরেছে। ওখানকার লোকজন বলছে এই ছেলে গুলো নতুন ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলে। এইতো চাই। দ্য বাংলাদেশ ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট।
লিটনের ইনিংস দেখে কমেন্ট্রি বক্সের জাদুকর হার্শা ভোগলে টুইট করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। যেনো তিনিই বাংলাদেশের ঘোরতর সমর্থক। আসলে এই ছেলে গুলোই তো আগামী দিনের ক্রিকেট সারথি। এরা জিতলে তো আসলে ক্রিকেটেরই জয় হয়।
তবে কিন্তু ছিল একটি। বাংলাদেশ এর আগেও নিউজিল্যান্ডে ভালো ক্রিকেট খেলেছে। কোন জয় পায়নি, তবে ভালো কিছু ব্যক্তিগত ইনিংস ছিল। তবে বাংলাদেশের বোলরার মূলত পেসাররা কখনোই ওই কন্ডিশনের ফায়দা তুলতে পারেননি। ফলে শঙ্কা এবারো ছিল। স্কোরবোর্ডে এত বড় রান নিয়েও ঠিক বড় গলায় কিছু বলা যাচ্ছিল না।
তবে এবার বাংলাদেশের পেস অ্যাটাককে নতুন করে পরিচয় করানো হলো নিউজিল্যান্ডের মাটিতে। প্রথম ইনিংসে শরিফুল ইসলাম, তাসকিন আহমেদরা লড়াইটা করে দেখিয়েছেন। বাংলাদেশেও যে পেস বোলার আছে সেই আগ্রাসন বলে, শরীরি ভাষায় দেখিয়েছেন। তবুও একটা ম্যাজিকাল কিছুর অপেক্ষা ছিল।
আজ সকালে বাংলাদেশের সামনে নিউজিল্যান্ডকে অল আউট করার চ্যালেঞ্জ ছিল। কঠিনতম চ্যালেঞ্জই বটে। তবে বাংলাদেশের পেসাররা এবার এক পা এগিয়ে আসলেন। কাজটা প্রথমে শুরু করলেন তাসকিনই। তরুণ এই পেস অ্যাটাকের বড় ভাই তো তিনিই।
নিউজিল্যান্ডের দুই ওপেনার তখন শুরুর লড়াইটা করে ফেলেছেন। ২৯ রানের ওপেনিং জুটি বাংলাদেশের মনে আবার সেই শঙ্কাটা জাগিয়ে তুলছিল। বোলারা দায়িত্বটা পালন করতে পারবে তো? তখনই টম লাথামকে ফিরিয়ে প্রান সঞ্চার করেন তাসকিন। এরপর পুরোটাই এবাদত শো!
দুই বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারটা একেবারেই সাদামাটা। ১০ টেস্ট খেলে উইকেট মাত্র ১১ টা। বোলিং গড় ৮১.৫৪! সেই এবাদতই নিউজিল্যান্ডে কেমন বদলে গেলেন। অবশ্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টেও একটা আভাষ দিয়েছিলেন তিনি। তবুও এই টেস্টে তার একাদশে জায়গা পাওয়া নিয়ে অনেক সমালোচনা ছিল। তবে সেসব এবাদত থোরাই কেয়ার করেন।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন আপ একাই ধ্বসিয়ে দিলেন। প্রথমে ফেরালেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ডেভন কনওয়ে কে। এরপর নিলেন বড় হুমকি হয়ে উঠা উইল ইয়ঙ এর উইকেট। এরপর হেনরি নিকোলাস, টম ব্লানডেলও ফিরলেন এবাদতের স্বীকার হয়ে।
এবাদতে কাছে টপ অর্ডার হারিয়ে এখন ঘরের মাঠে ভুগছে নিউজিল্যান্ড। এখন বড় গলায় বলা যায় ম্যাচ বাঁচাতে লড়ছে কিউইরা, আর ম্যাচ জেতার জন্য লড়ছেন এবাদত। এবাদত লড়াইটা জিততে পারলেই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম জয় পেয়ে যায় বাংলাদেশ। সাকিব-তামিমদের ছাড়া জয়, শান্ত, এবাদতদের বাংলাদেশ।
সেই এবাদত, যিনি কেন টেস্ট একাদশে থাকেন? – একদিন আগেও এই প্রশ্ন তোলার লোকের অভাব ছিল না। এবাদতও নিজেও নিশ্চয়ই জানতেন, কতশত সমালোচনার তীর ধেয়ে আসছে তাঁর দিকে, প্রতিনিয়ত। কিন্তু, তাঁতে চোখ না দিয়েই নিউজিল্যান্ডের সোনালি রোদে সোনালি হাসিটা হাসতে পারলেন এবাদত। এবার কেবল শেষটা রাঙানোর পালা। আরেকটা বুলেট, আরেকটিবার স্যালুট!