‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা
ফুল তুলিতে যাই।’
শুধু কি ফুল তুলতে যাওয়া? ফুলের মালা গলায় দিয়ে পাড়া মাতিয়ে ছুটে বেড়ানো। সকাল বিকেল হাড়িভাঙ্গা, লুকোচুরি, এক্কাদোক্কা, ফুলটোকা, পলানটুক, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবাধা; আরও কতো কী খেলে সারা শরীরে কাঁদা মাটি মেখে ঘরে ফেরা।
কোথায় হারিয়ে গেল সেই দিন!
কোথায় হারালো, সে বলা কঠিন। তবে আমাদের চেনা সেই শৈশব, চেনা সেই খেলা, সেই কাঁদা মাটি আর ধুলোর গন্ধ যে চুরি হয়ে যাচ্ছে বা গেছে; সেটা সত্যি। শহর-গ্রামে যে খেলাগুলো শিশু-কিশোরদের দুনিয়াটাকে তাদের মতো করে রাখতো, সেগুলোকে এখন দূরবীণ দিয়েও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
এক্কা দোক্কার বদলে ফেসবুক, গোল্লাছুটের বদলে মেসির খবর, দাঁড়িয়াবাধার বদলে লর্ডস টেস্ট এখন আমাদের শিশুদের, কিশোরদের আক্রান্ত করে রেখেছে। বাংলার চিরচেনা খেলাগুলোর জায়গা নিয়েছে টেলিভিশনের খেলা আর কার্টুন বা মন কাড়া কোনো সিরিয়াল এবং ফেসবুক, ভিডিও গেম।
আমাদের নিজেদের খেলাধুলাগুলো কতোটা হারাচ্ছে, সে নিয়ে আলাদা করে খোঁজখবর না নিলেও বোঝা যায়। চোখ মেলে তাকালেই দেখা যায়, সেই খেলাগুলো আর নেই। কান পাতলেও সেই ‘হা-ডু-ডু’ বা ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ’ আর শোনা যায় না।
কিন্তু কেন এমন হলো?
গত এক-দেড় দশক ধরেই প্রশ্নটা সারা পৃথিবীকেই ভাবাচ্ছে। কারণ, সমস্যাটা শুধু আমাদের নয়; সারা পৃথিবীরই। পুরো বিশ্বে তো বটেই, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাতারাতি বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে তাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাগুলো। একটি গবেষণাপত্র দাবি করছে, শিশু-কিশোরদের চিরায়ত খেলাধুলা হারিয়ে ফেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ এই হারিয়ে ফেলাদের ভিড়ে বাকি বিশ্বের অনেকের চেয়ে এগিয়ে আছে।
ঠিক কিভাবে এতো দ্রুত আমাদের চেনা খেলাগুলো হারিয়ে গেল, সে নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে অনেক। একেবারে প্রথম এবং প্রধান দুটি কারণ হিসেবে সামনে চলে আসছে দ্রুত খোলা মাঠগুলোর বিলুপ্তি এবং শৈশব থেকেই পড়াশোনার প্রবল চাপ। এর সঙ্গে ড্রয়িংরুমে টেলিভিশন ও কম্পিউটারের প্রবল দাপটকেও কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
আগে স্কুলের পাশাপাশি এসব খেলার একটা বড় জায়গা ছিল স্কুলগুলোর মাঠ এবং প্রতিটি শহরে ভুরি ভুরি খোলা মাঠ। সেই মাঠগুলো নানা ধরনের ক্ষমতাধরদের তত্পরতায় গেছে দখল হয়ে। ফলে ইচ্ছেমতো খেলাধুলার জন্য আর জায়গাই খুঁজে পাচ্ছে না শিশুরা।
পাশাপাশি পড়াশোনার ভয়ানক চাপকে দায়ী করা হচ্ছে এই পরিস্থিতির কারণে। প্রতিনিয়ত নানা ধরনের বিজ্ঞাপন আর প্রচারণার ফলে অভিভাবকরা এখন সবাই যার যার সন্তানকে ‘এক নম্বর’ করে তোলার প্রতিযোগিতায় মেতেছেন। সেই প্রতিযোগিতায় দারুণভাবে ইন্ধন দিচ্ছে আমাদের নানা ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান– স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট, গাইড; অনেক কিছু। এসব শেষ করে, এই ভয়ানক প্রতিযোগিতায় সময় দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা থেকে আর সময় বের করে এক্কা দোক্কা খেলতে যাওয়া অন্তত সম্ভব না। বরং শিশুদের দৈনিক সূচি বলছে, দিনটা চব্বিশ ঘণ্টা না হয়ে আরেকটু বেশি হলে ‘প্রথম হওয়া’র চাপটা আরেকটু বাড়ানো যেত।
আবার কোনো কোনো অভিভাবক বলছেন, তারা বাচ্চাকে চাপ দিচ্ছেন না; তাদের প্রথম হওয়ার নেশা নেই। কিন্তু তারাও বাচ্চাকে বাইরে বের হতে দিতে রাজি নন। কারণ, নিরাপত্তাহীনতা।
এই নিরাপত্তাজনিত সমস্যাটা অবশ্য শুধু নগরঅঞ্চলের সমস্যা। রাস্তায় দুর্ঘটনার ভয়, মাঠে গেলে হারিয়ে যাওয়ার ভয়; আরও অনেক অনেক ভয় গ্রাস করেছে নাগরিক অভিভাবকদের। এইসব ভয় এড়িয়ে সময় ও স্থান পাওয়া গেলেও সেখানে বাচ্চাকে পাঠানোর সাহস করে উঠতে পারছেন না অনেকে।
আর গবেষণা বলছে, এই তিনটি শীর্ষ সমস্যার সঙ্গে আরো ভয়ানক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ড্রয়িংরুম বিনোদন এবং প্রতিযোগিতামূলক খেলার ভয়ঙ্কর উত্থান।
এখন শিশুদের যেটুকু ফাঁকা সময় কোনোক্রমে বের হচ্ছে, তা আবার দখল করে নিচ্ছে টেলিভিশন। ঠিক বিকেলে খেলাধুলার সময়টাকেই লক্ষ্য করে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো একটার পর একটা অত্যন্ত লোভনীয় ভিনভাষার কার্টুন বা এনিমেশন চালাচ্ছে। এই কার্টুনের হাতছানি এড়িয়ে খেলার মাঠে যাওয়া তো দূরের ব্যাপার। এমনকি অভিভাবকরা এখন চাইলেও কার্টুনের হাত থেকে সন্তানকে উদ্ধার করে হাতে কমিকস বই বা গল্পের বই তুলে দিতে পারছেন না!
শৈশব পার হয়ে কৈশোরে পা দিতে না দিতে আরেক ড্রয়িংরুম বিনোদন এসে সময়টা আরও কেড়ে নিচ্ছে—তা হচ্ছে কম্পিউটার; বিশেষত ফেসবুক।
বাস্তব জীবনের সবকিছুই ফেসবুকে করা যায়; এমন এক মহা ভ্রান্তির মধ্যে কেটে যাচ্ছে কৈশোর। এখানেই গোয়েন্দাগিরি, এখানে পরস্পরের সঙ্গে আড্ডা এবং এখানেই একটু একটু সমাজ সচেতনতা। ফলে বাইরে বের হওয়ার আর দরকারই নেই। এর সঙ্গে আরেকটু বড় হলে রাত জেগে ইউরোপের খেলা দেখে, ভোর রাত থেকে ক্রিকেট অনুসরণ করা।
এই ফুটবল, ক্রিকেট বা এ রকম প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অবশ্য কিছু আগ্রহ থাকছে। যেখানে সমর্থিত দলের জয় বা পরাজয় এই শিশুদের, কিশোরদের উদ্বেল করে তুলছে। ‘নায়ক’ হিসেবে সামনে চলে আসা মেসি-রোনালদোর সাফল্য বা ব্যর্থতায় তারা হাসছে-কাঁদছে। পন্ডিতরা বলছেন, বাজার ধরে রাখতেই শিশু-কিশোরদের কাছ থেকে তাদের চিরচেনা খেলা কেড়ে নিয়ে সেখানে এই মেসি-রোনালদোকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে বড় দ্রুত আমাদের পরের প্রজন্মগুলোর সময় চুরি হয়ে যাচ্ছে। চুরি হয়ে যাচ্ছে শৈশব, চুরি যাচ্ছে কৈশোর। ঠেকানোর কোনো উপায় নেই?