বিতর্কের শেষ নাই, বিতর্ক খোঁজা বৃথা তাই!

ভারতের সানি – কপিলের সম্পর্কের কথাই ধরুন। আজকের সুনিল গাভাস্কার প্রায় সব লেখা, সব সাক্ষাৎকারেই বার বার কপিলের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কপিলই যে আমাদের চিরশ্রেষ্ঠ ম্যাচ উইনার সেটাও উল্লেখ করতে ভোলেন না। কপিলের মুখেও সানির সম্বন্ধে ভালো ভালো কথাই শুনতে পাবেন আজকাল। সানি গাভাস্কারের টেকনিক তো বটেই, সেই সঙ্গে তাঁর অধিনায়কত্ব, তাঁর ক্রিকেট মস্তিষ্কের তারিফও বারবার করেন কপিল। তাঁদের একসঙ্গে খেলার দিনে কিন্তু দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা এতটা সম্প্রীতির ছিল না।

সদ্য সমাপ্ত হওয়া ভারত ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজে পিচ নিয়ে বেশ বিতর্ক ছড়িয়েছে ক্রিকেট বিশ্বে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে একদিকে যেমন দুই বা তিনদিনের মধ্যে টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়, তেমনি এটাও ঠিক যে স্যুইং আর বাউন্স ভর্তি পিচে যখন ম্যাচ তাড়াতাড়ি শেষ হয় তখন পিচের মান নিয়ে খুব একটা হৈচৈ হয় না।

তবে এই লেখার বিষয় ক্রিকেটের পিচ বা ভারত–ইংল্যান্ড সিরিজ নয়। বিষয়টা হচ্ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্রিকেটারের দৃষ্টিভঙ্গি কী ভাবে বদলায় সেটা নিয়ে।

সেদিন দেখলাম ভিভ রিচার্ডস ব্রিটিশদের উপদেশ দিয়েছেন পিচ নিয়ে অযথা কান্নাকাটি না করতে। ভিভের হয়ত মনে আছে আটের দশকের গোড়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস ব্যাটারির সামনে উপর্যুপরি হেনস্থা হওয়ার পর গেল গেল রব তুলেছিল ব্রিটিশ মিডিয়া।

নিজেদের ব্যাটসম্যানদের রক্ষার্থে বেশ কয়েকটা নতুন নিয়মের দাবীও তোলা হয়েছিল। ওভার পিছু বাউন্সারের সীমাও এরপরই লাগু হয়। মজার ব্যাপার দেখুন, এর বেশ কয়েক দশক আগেই কিন্তু ‘বডিলাইন’ নামের কুখ্যাত সিরিজ হয়ে গেছে। তখনও কি এই নিষেধাজ্ঞা আনা যেত না?

তবে ভিভ নিজেও কিন্তু ভারতের ঘূর্ণি পিচে ব্যাট করে বিশেষ খুশি হন নি। ১৯৮৮ সালে হিরওয়ানির লেগ স্পিনে ধরাশায়ী হওয়ার পর তিনি আমাদের শাসিয়ে যান পরবর্তী ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে আমাদের ব্যাটসম্যানদের ফুটন্ত কড়াইয়ে ভাজা হবে।

সময়ের সাথে সাথে অবশ্য মানুষ বদলায়। অন্তত তাদের মত প্রকাশের ধরন বদলায়। ভারতের সানি – কপিলের সম্পর্কের কথাই ধরুন। আজকের সুনিল গাভাস্কার প্রায় সব লেখা, সব সাক্ষাৎকারেই বার বার কপিলের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কপিলই যে আমাদের চিরশ্রেষ্ঠ ম্যাচ উইনার সেটাও উল্লেখ করতে ভোলেন না। কপিলের মুখেও সানির সম্বন্ধে ভালো ভালো কথাই শুনতে পাবেন আজকাল। সানি গাভাস্কারের টেকনিক তো বটেই, সেই সঙ্গে তাঁর অধিনায়কত্ব, তাঁর ক্রিকেট মস্তিষ্কের তারিফও বারবার করেন কপিল।

তাঁদের একসঙ্গে খেলার দিনে কিন্তু দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা এতটা সম্প্রীতির ছিল না। ১৯৮০ সালের মাদ্রাজ টেস্টের কথাই ধরুন। এই টেস্টে সানি – কপিলের অসাধারন পারফর্মেন্সের ওপর ভর করে ১০ উইকেটে ভারত হারিয়ে দেয় পাকিস্তানকে। সানির ১৬৬ এবং অপরাজিত ২৯ এর পাশাপাশি কপিল ম্যাচে ১১ উইকেট নেন এবং ব্যাট হাতে ঝলমলে ৮৪ রানের ইনিংস খেলেন।

ভারতের প্রথম ইনিংসে দুইজনে কিছুক্ষনের জন্যে একসঙ্গে ব্যাট করেন। ইমরানের বলে সানির একটা সিঙ্গলের কলে সাড়া দেননি কপিল। পরবর্তী বলেই ইমরান আউট করেন সানিকে। পরে সানি নিজের আউটের জন্যে কপিলকে দায়ী করে বেশ ঝাঁঝালো ভাষায় আক্রমন করেন। বলাই বাহুল্য, সানির এই আক্রমণ পছন্দ হয় নি কপিলের।

আরও একবার কপিলের বেশ কয়েকটি কম রানে আউট হয়ে যাওয়া ইনিংসের পর অধিনায়ক গাভাস্কর প্রেসের সামনি বিবৃতি দেন যে কপিল আর কোন দিন হাফ সেঞ্চুরি করতে পারবে না। পরের ইনিংসেই কপিল হাফ সেঞ্চুরি করে সানিকে ভুল প্রমাণিত করেন।

সানির মত অনুযায়ী তিনি কপিলকে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যেই সেদিন এই কথা বলেছিলেন কিন্তু কপিল সেটা মেনে নেন নি। তার মতে সানি তাকে কথাটা একান্তে বলতে পারতেন, নিজের দলের খেলোয়াড়দের সর্বজনসমক্ষে সমালোচনা তাদের অনুপ্রাণিত করার শ্রেষ্ঠ পন্থা বলে মনে হয় নি তার।

সানি-কপিলের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় ১৯৮৪র দিল্লির টেস্ট আসবেই। দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং করে নিজের উইকেট ছুঁড়ে আসার জন্যে পরের টেস্টে, ইডেনে, বাদ পড়েন কপিল। সঙ্গে সন্দীপ পাতিলও। অথচ মজার ব্যাপার এই যে ভারতের প্রথম ইনিংসে কপিলের স্কোরই সর্বাধিক ছিল, সেই টেস্টে ভারতের পক্ষে দুই ইনিংস মিলিয়ে দ্বিতীয় সর্বাধিক রান করেন পাতিল।

প্রথম ইনিংসে ৬০ রান করেন কপিল। তার মধ্যে বেশ কয়েকবার পোককের বলে স্কোয়ার কাট করতে গিয়ে মিস করেন। দ্বিতীয় ইনিংসে কপিল ব্যাট করতে নামার সময় সানি নাকি মন্তব্য করেন, আর যাই কর, ভিশির মতো স্কোয়ার কাট খেলার চেষ্টা কোর না।

সানি চিরকালই বলে এসেছেন, আজও বলেন, ইডেন টেস্টে কপিলের বাদ যাওয়ার পেছনে তাঁর কোন হাত ছিল না। নির্ণয়টা নির্বাচকেরাই নিয়েছিলেন। টেকনিক্যালি কথাটা ঠিক কারণ দল অধিনায়ক ঠিক করেন না। কিন্তু সেই সঙ্গে বিভিন্ন সুত্রে এটাও জানা যায় যে সেদিন নির্বাচকদের এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিলেন সানি। ইডেন টেস্টে নয় কপিল খেলবে, নয় আমি – এই ছিল তার মনোভাব।

ক্যারিয়রের একটা সময়ে সানি টেস্টে ওপেনিং করতে চাইতেন না, তার পছন্দের ব্যাটিং পজিশন ছিল চার নম্বরের। সুনীলের এই আবদার ভালো চোখে দেখেন নি ক্যাপ্টেন কপিল, এই নিয়ে বিস্তর জল ঘোলাও হয় একটা সময়।

বেশ কিছু বছর পর ভারতের অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়ের ইনিংস ডিক্লেয়ার করা নিয়ে একটা বড়সড় বিতর্ক হয়। বিতর্কের কারণ সেই সময় শচীন ১৯৪ রানে অপরাজিত ছিলেন। শচীন এবং শচীন ভক্তদের মতে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই পারতেন রাহুল। অন্যদিকে রাহুল এই ইস্যুতে নিজের ক্রিজ থেকে নড়তে নারাজ। সৌরভ সরাসরি এই বিতর্কে না জড়ালেও আমার মনে হয়েছে তিনি মানসিক ভাবে রাহুলের পক্ষে।

এ ছাড়াও কিছু বহু প্রচলিত ক্রিকেটের গল্প আছে যার সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যেমন ধরুন হার্শেল গিবস স্টিভ ওয়াহর ক্যাচ ফেলে দেওয়ার পর ওয়াহর চিরস্মরণীয় উক্তি – বন্ধু, তুমি বিশ্বকাপটাই এইমাত্র ফেলে দিলে।

আজ সবাই মেনে নিয়েছেন ওয়াহ এই কথাটা কোনদিন বলেন নি, গিবসও শোনেন নি। কিন্তু উক্তিটা যে দুর্দান্ত তাতে সন্দেহ নেই।

কিছুদিন আগে ইউ টিউবে দেখলাম ওয়াসিম আকরাম নিজের এবং ভিভ রিচার্ডসের ওপর একটা মজার ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সেই ঘটনাক্রমে আকরামের স্লেজিংয়ের উত্তরে ভিভ নাকি সন্ধেবেলায় খালি গায়ে ব্যাট হাতে ওয়াসিম আকরামকে পেটাতে আসেন। অধিনায়ক ইমরান, যিনি মাঠের মধ্যে আক্রামের স্লেজিংয়ের প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, আর এই ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে রাজি হন নি। তার বক্তব্য, এটা তোমার আর ভিভের ব্যাপার।

ভিডিওটা দেখে বহু বছর আগে এই তিনজন চরিত্রকে নিয়েই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। সে ক্ষেত্রে নাকি আক্রাম ভিভকে স্লেজিং করায় ইমরান মাঠের মধ্যেই তাকে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলেন চুপচাপ বল করে যেতে কারণ ভিভ ক্ষেপে গেলে পাকিস্তানের বোলারদের পিতৃপুরুষদের নাম বিস্মৃত হওয়ার সম্ভাবনা। ঘটনাটা সম্ভবত পাকিস্তানেরই এক খেলোয়াড়ের মুখ থেকে শুনে লিখেছিলেন সাংবাদিক।

প্রশ্ন উঠতে পারে দুটোর মধ্যে কোনটা ঠিক? সম্ভাব্য উত্তর চারটে। প্রথম বা দ্বিতীয়টির মধ্যে যে কোন একটা ঠিক হতে পারে আবার দুটোই ঠিক হওয়ারও সম্ভবানা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে দুটো আলাদা ঘটনা হিসেবে ধরে নিতে হবে। আবার এও সম্ভব যে দুটোর কোনটাই আদৌ ঘটে নি। শুধুমাত্র আক্রাম বলেছেন বলেই প্রথম ঘটনাটি সত্য মনে করার কারণ নেই।

ইয়র্কশায়ারের অ্যামট রবিন্সনের মুখে দিয়ে এমন কিছু কথা বলিয়ে নিতেন বিখ্যাত ক্রিকেটলেখক নেভিল কার্ডাস যে একবার রবিন্সন নাকি বলেছিলেন, আমি কার্ডাসের আবিষ্কার। অবশ্য এটাও তিনি বলেছিলেন কিনা সন্দেহ আছে কারণ এই কথাটাও কার্ডাসই লিখেছিলেন।

আকিরা কুরোসাওয়ার ক্লাসিক সিনেমা ‘রাশোমন’এর মূল বক্তব্য হোল একই ঘটনা বিভিন্ন মানুষের কাছে বিভিন্ন রূপে ধরা দেয়। সচেতন বা অবচেতন মনের প্রভাবে একই ঘটনার আমরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে থাকি। সময়ের সাথে সাথে সেই ব্যাখ্যা পাল্টেও যাওয়া সম্ভব কারণ বয়সের সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটে।

সুতরাং বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে বহুল প্রচলিত গল্পগুলী পড়ার সময় একটা ইংরেজি প্রবাদ মাথায় রেখে পড়তে হবে – ‘Don’t let the facts get in the way of a good story!’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...