আগুনে পুড়েছিল নন্দন কানন

ওই অবস্থাতে মাঠে নামার প্রশ্ন ছিল না। প্রাণের ভয়ে অতিথি খেলোয়াড়রা দৌড়ে মাঠের বাইরে এসে রেড রোডের দিকে ছুটতে থাকেন নিরাপত্তার জন্য। হাজার হাজার দর্শকদের ভীড়ে পথ হারিয়ে যায় তাঁদের। পরে তাঁদের মাঠে ফিরিয়ে এনে প্যাভিলিয়নে আটকে দেয় পুলিশ। পরে তাঁদের হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সিএবি কর্তারা পতৌদিকে প্রায় পায়ে ধরে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে আশ্রয় নেন, নতুবা সেদিন তারা বেঁচে ফিরতেন কিনা সন্দেহ আছে।

কলকাতার ইডেন উদ্যান। ৫৪ বছর আগের কথা।

২০ বছরের তরুণ বাঁ-হাতি অফ স্পিনার বিষেন সিং বেদি প্রথম ইনিংসে ৩৬-১১-৯২-২ বোলিং ফিগার দিয়ে বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে শুরু করেছিলেন তার ১৩ বছরের টেস্ট জীবন। উইকেট দু’টি ছিল বেসিল বুচার আর ক্লাইভ লয়েডের।

বেসিল বুচারের ক্যাচ নিয়েছিলেন অধিনায়ক টাইগার পাতৌদি আর ক্লাইভ লয়েডের ক্যাচ গিয়েছিল উইকেটরক্ষক বুধি কুন্দরনের হাতে। দ্বিতীয় ইনিংসে বল করার সুযোগ পাননি বেদি কারণ দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ব্যাট করতে হয়নি। ম্যাচটা ইনিংস ও ৪৫ রানে জিতেছিল প্রথম ইনিংসে ৩৯০ রান করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর ভারত করেছিল ১৬৭ আর ১৭৮।

প্রথম টেস্টে দু’ইনিংসেই এই বোলারের উইকেট নিয়েছিলেন প্রতিপক্ষ অধিনায়ক স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স। প্রথম ইনিংসে স্ট্যাম্পড হন পাঁচ রানে আর দ্বিতীয় ইনিংসে ০ রানে রবিন বাইনোর হাতে ক্যাচ আউট হন তিনি। বেদির টেস্ট জীবনের সেরা বোলিং পরিসংখ্যান ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৬৯-৭০ সিরিজে, এই ইডেনেই, ৭/৯৮।

এই ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে, ১৯৬৭ সালের প্রথম দিনে ইডেন দেখেছিল সেই লজ্জাজনক ঘটনা। ২১২/৪ থেকে সেদিন আর খেলা শুরু করতে পারেনি অতিথিরা। ৫০০০০-এর জায়গায় প্রায় ৮০০০০ টিকেট ইস্যু হয়েছিল সেদিনের। ভিআইপি টিকিটও ব্ল্যাক হয়েছিল। মাঠে খেলা শুরুর আগেই অরাজকতা শুরু হয়। দর্শকে ঠাসাঠাসি আর গাদাগাদি হয়ে যাওয়া স্ট্যান্ডে স্ট্যান্ডে সংঘর্ষ শুরু হয়।

পুলিশ লাঠিচার্জ করে। টিকেট কেনা দর্শকেরা প্রতিবাদ করেন। সীতেশ রায় নামে এক বৃদ্ধ নিদারুণ আহত হন ও তাকে চোখের সামনে রক্তস্রোতে লুটিয়ে পড়তে দেখে জনতা ইডেনের স্ট্যান্ড থেকে বাঁশ খুলে নিয়ে পুলিসকে প্রতিআক্রমণ করে। বেকায়দায় পড়া পুলিশের তরফ থেকে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। মাথার উপরের ছাউনিতে এবং মাঠের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেয় পাগল হয়ে যাওয়া খেলা দেখতে আসা জনতা। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটতে থাকে গ্যালারিতে। তা ছড়িয়ে যায় মাঠের সবদিকে।

ওই অবস্থাতে মাঠে নামার প্রশ্ন ছিল না। প্রাণের ভয়ে অতিথি খেলোয়াড়রা দৌড়ে মাঠের বাইরে এসে রেড রোডের দিকে ছুটতে থাকেন নিরাপত্তার জন্য। হাজার হাজার দর্শকদের ভীড়ে পথ হারিয়ে যায় তাঁদের। পরে তাঁদের মাঠে ফিরিয়ে এনে প্যাভিলিয়নে আটকে দেয় পুলিশ। পরে তাঁদের হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সিএবি কর্তারা পতৌদিকে প্রায় পায়ে ধরে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে আশ্রয় নেন, নতুবা সেদিন তারা বেঁচে ফিরতেন কিনা সন্দেহ আছে।

পরের দিন অমৃতবাজার পত্রিকার বিবরণ ছিল এইরকম – ‘There was virtually a stampede when the spectators rushed out from the ghetto-like track of the ground. Policemen and their vehicles came under heavy attack. A police jeep belonging to S. T. Howrah was set on fire outside the All-India Radio buildings. Isolated policemen were also assaulted. Two police motor-cycles were set ablaze too. The tent of the Sporting Union Club erupted in flames. People ran pell-mell with their paraphernalia of kit bags and flasks dangling from their shoulders. A state bus in Esplanade East was set on fire, followed by another three, one single-decker and two double-deckers, which met with the same fate. The glass panes of display windows of some shops in Chowringhee Road tinkled down as brickbats smashed on them. Attempts were also made to break open some closed shops in Bharampalla Street, near New Cinema. Another state bus was found burning near Raja Subodh Mullick Square.’

দু’দেশের জাতীয় পতাকা আগুনের গ্রাসে চলে যেতে পারে বুঝে কেউ একজন বাঁশ বেয়ে উঠে গিয়ে পতাকা দু’টি খুলে নিয়ে আসেন। মিথ এটাই যে, তার নাম ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটার কনরাড হান্ট।

পরদিন ‘সত্যিকারের ক্রিকেট’ শিরোনামে আনন্দবাজার এ খবর ছাপে। অন্য পত্রিকা এবং লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে এটা মিথ হয়ে যায়। কিন্তু, অনেক পরে স্বয়ং কনরাড হান্ট তার আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং টু উইন’-এ লিখেন যে, ‘I looked up and saw our national flags fluttering in the breeze, threatened by the fire that was now coming towards the pavilion. I started to climb up to get the flags and avoid surrendering them, the symbol of sovereignty of our two nations, to ‘mob rule’. The plain-clothes policeman said, ‘Don’t you go. I’ll get them.’ He went and brought the two flags down, and gave them to me.’

পরে বিশ্রামের দিন একদিন এগিয়ে এনে (তিন জানুয়ারির আগে দুই জানুয়ারি) কোনোভাবে ম্যাচ শেষ করা হয়। অনেক অনুরোধের পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ রাজি হয়েছিল ম্যাচটা শেষ অবধি খেলতে। পুরনো লোকজন হয়ত মনে করতে পারবেন এই ঘটনাটা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...