দ্য আল্টিমেট ওয়ারিয়র

১.

‘অন ডিফিকাল্ট উইকেটস ইউ নিড টু ব্যাট আগলি’

ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড লন্ডনের গ্র্যান্ড হোটেলে বসে যখন বলছিলেন তখন তার মননে কোথাও ৩৩ বছর বয়সী ভারতীয় যুবকের নাম ছিল কিনা তা অজানা থাকবে চিরদিন।

সেদিন লয়েড এর বক্তব্য ছিলো এই যে কঠিন উইকেটে টেস্ট ক্রিকেটে একটি উন্নত মানের পেস অ্যাটাকের সামনে ম্যাচ জিততে দলের একজন ব্যাটসম্যানকে সর্বদাই থাকতে হয় ‘আগলি’। কিন্তু তাকে হতে হবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং ক্রিজের ব্যাপারে নাছোড়বান্দা। তার সামনে আসতে পারে আনপ্লেএবল ডেলিভারি, তাকে শরীর দিয়ে থাকতে হতে পারে ক্রিজে তবুও আউট হবোনা এটাই যেন হয় তাঁর পাথেয়।

২.

ছেলেটার বয়স তখন ৮-৯ হবে। বাবা অরবিন্দ পূজারা ছিলেন সাবেক ক্রিকেটার কার্সন ঘাউড়ির বন্ধু। চেম্বুর এর ভারত পেট্রোলিয়াম গ্রাউন্ডে তখন বাচ্চাদের প্র্যাক্টিস করান কার্সন। নেটে দেড় ঘন্টা দেখে কার্সন বলেছিলেন- ‘দাম তো হ্যায় বাচ্ছে মে অউর ইসকে পিছে তুম মেহনাত ভি কার সাকতে হো।’

তার পর থেকে চেতেশ্বর পূজারার দিনলিপিতে বিকেল ৫টায় স্কুল থেকে ফিরে রেল কলোনীতে ফিরে স্ট্রেট ব্যাটে ব্যাট করাই যেন হয়ে গেছিলো একমাত্র ফোকাস। ফল এসেছিলোও সেইভাবে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাকে অভিষেক করানো হয় বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে যেখানে তার রান সংখ্যা ৭ ইনিংসে ২৫৪ হলেও তিনি তিনবার খেলেছিলেন ২০০ এর বেশি বল এবং বারোদার বিরুদ্ধে জাতীয় অনূর্ধ্ব ১৪ টুর্নামেন্টে করেন ট্রিপল সেঞ্চুরি তাও ৯ ঘন্টা ব্যাট করে!

এবং ওই টুর্নামেন্টে ১৭০ গড়ে করেন ৫১১ রান। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে প্রায় ৫০০০ রান করেছেন চেতেশ্বর পূজারা যার মধ্যে শুধুমাত্র ২০০২-০৩ এর কোচবিহার ট্রফি বাদ দিলে বাকি সব টুর্নামেন্টে ৭০ এর ওপর ব্যাটিং গড় এবং ২০০ এর বেশি বল খেলা থেকে গেছে ‘কমন’।

৩.

২০২১ এর গাব্বা টেস্টের চতুর্থ ইনিংস। নিজে ব্যাট করতে নামার ৭৬তম বল হেলমেটে লাগার পরে ৭৭তম বলটিই লেগেছিলো বাহুতে এবং দুটির পেস ছিলো ১৪১ এবং ১৩৮! আজ সাধারণ সহ্যশক্তির কোনো লোক হয়তো দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন না কিন্তু পূজারা ছিলেন।

শুধু ছিলেনই বা বলছি কেন? তারপরে তো আরো পাঁচবার বল নিয়েছেন নিজের শরীরে এবং বোলারদের নাম প্যাট কাম্মিন্স, মিচেল স্টার্ক এবং জস হ্যাজালউড। আজ যখন লেখাটি লিখতে বসছি তার একটু আগে পাড়ার মাঠে এক আনকোরা বোলারের বলে ব্যাট করতে গিয়ে আঙুলে চোট লাগায় বুঝতে বাকি নেই বিশ্বত্রাস ফাস্ট বোলারদের থেকে সেই চোট এলে তা হয় কতটা ভয়ঙ্কর।

তো কি বলেন চেতেশ্বর পূজারা? কেন এই অমানবিক কষ্ট সহ্য করা? বলছিলেন গাব্বার পিচের একদিকে ছিলো অসমান বাউন্স ও ক্র্যাক যেখানে পড়লেই বলের গতিবিধি ধরতে পারা হচ্ছিলো অসম্ভব। তাই ব্যাটের হ্যান্ডল বা গ্লভস ছুঁয়ে বল চলে যেতে পারতো ‘করিডোর অফ আনসারটেইনটি’ এর দিকে। সুতরাং ক্লাইভ লয়েড যে কথা বলেছিলেন ‘আগলি’ ব্যাটিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেই তত্ত্বে যেন শিলমোহর ফেলে দিয়ে গেলেন সৌরাষ্ঠ্রের ব্যাটসম্যান।

শেষ তিন বছরে তার ব্যাটিং গড় দাঁড়িয়েছে ২৭.৩৮। কিন্তু এই সময়ে প্রতি ইনিংসে তিনি খেলেছেন গড়ে ৭৩টি বল। নিতান্তই পড়তির দিকে তার পারফরমেন্স হলেও ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে দুটি দুর্দান্ত ডাউন আন্ডার সিরিজ জয়ের পেছনে ১২৫৮ বল এবং ৯২৮ বল খেলা পূজারা থেকে যাবেন সেই ‘আগলি’ ব্যাটসম্যান হিসেবে যাকে না তো বিচার করা যায় স্কোরবোর্ড দিয়ে না কাজে লাগে টেকনিকাল বিচার।

আর যাই হোক না কেন ভারতের ‘মেহনতি’ সম্প্রদায়ের লোকটা তো প্রমাণ করেছেন যে দশ ঘন্টা ক্রিজে কাটানোও হতে পারে সবচেয়ে ‘গ্ল্যামারাস’। এবং ‘গ্ল্যামারাস’ শব্দের ব্যবহার যখন করেন রবি শাস্ত্রী সেখানে অন্তত অতিকথন জিনিসটি বলে তার গ্ল্যামার ঢাকা দেওয়া শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতোই অবাস্তব। এই লোকেরা থেকে যান কার্যকরিতার চুলচেরা বিশ্লেষণের সময়ে। তখন এদের উপস্থিতি চলে যায় ঔজ্জল্যের শিখরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link