দ্য কর্নেল

বছর আঠারো আগে উইজডেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ক্রিকেটারের উপমা দেওয়ার জন্য একটা বেশ জাঁকজমক পূর্ণ অনুষ্ঠান করে। অনেক আলাপ আলোচনা, তর্ক বিতর্ক এবং অবশেষে ক্রিকেট বোদ্ধাদের ভোটের ভিত্তিতে শিরোপাটা শেষ পর্যন্ত কপিল দেবকে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারটা মোটামুটি যারা একটু আধটু ক্রিকেট সম্বন্ধে খোঁজ-খবর রাখেন তারাই জানেন।

কিন্তু অনেকেই হয়ত জানেন না বা হয়ত জানতেন এতদিনে ভুলে মেরে দিয়েছেন যে এই পুরস্কারের জন্য বিভিন্ন প্রজন্মের ছয় ক্রিকেটারকে নমিনেট করা হয় উইজডেনের তরফ থেকে। কপিল, সুনীল আর শচীন তো ছিলেনই, আর ছিলেন চৌকস খেলোওয়াড় ভিনু মানকড় যিনি একসময় বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার হিসবে স্বীকৃত ছিলেন, ছিলেন ডাকসাইটে অধিনায়ক, দুরন্ত ফিল্ডার আর স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান টাইগার পতৌদি এবং ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার কর্নেল সি কে নাইডু।

এই এলিট লিস্টে শেষের নামটা দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম সেই সময়। রাহুল, কুম্বলে বা বিষেন সিং বেদির নাম নেই, অথচ এই মানুষটার নাম রয়েছে? তারপর ধরে নিলাম হয়ত সাবেক কালের ক্রিকেটারদের মধ্যে কাউকে নিতে হবে বলেই ওনাকে ইনক্লুড করা হয়েছে আমাদের সেই কোটা সিস্টেম অনুসরণ করে।

তারপর অবশ্য গঙ্গার মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা জল গড়িয়েছে, চুল পাকার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো দিনের বেশ কিছু ক্রিকেট সাহিত্যের সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়েছে। আর সেই সাহিত্যে ঘুরেফিরে এসেছে ১৯২৬ সালের একটা তিনদিনের ম্যাচের কথা।

টেস্ট খেলার দরজা পেতে আমাদের তখনও বছর ছয়েক বাকি, দেশে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম বেশ জোর কদমে চলছে। এর মধ্যেই ভারতে এমসিসির দল এল কয়েকটা ম্যাচ খেলতে। দলটা নামেই এমসিসি, আসলে পূর্ণশক্তির ইংল্যান্ডের টেস্ট দল। আমাদের টিম কচুকাটা হবে ধরে নিয়েই হিন্দুদের সঙ্গে বোম্বের জিমখানা মাঠে ম্যাচের আয়োজন হয়।

প্রথম দিনের শেষে এম সি জীর ৩৬৭ রানের জবাবে হিন্দুদের স্কোর নড়বড়ে ১৬/১। দ্বিতীয় দিনের খানিকক্ষণের মধ্যেই আরও দুটো উইকেট পড়ে যাওয়ার পর লম্বা লম্বা পা ফেলে হিন্দুদের ব্যাটিং এর হাল ধরলেন কর্নেল সি কে নাইডু। তৃতীয় বলটাই ‘ফুল স্যুইং অফ দ্য উইলো’র কল্যানে গিয়ে আশ্রয় নিল একেবারে টেন্টের ছাদে গিয়ে।

উপস্থিত দর্শকেরা নড়েচড়ে বসল। তাঁদের অনেকেই সি কে-কে চেনেন বলে জানেন যে এ তো সবে স্টারটার – চার কোর্সের মেন্যু এখনও বাকি।

তার পরের ঘটনা বারবার চোখ কচলে দেখার মত। চার চারটে টেস্ট বোলারের মধ্যে কেউই সেদিন রেহাই পান নি সিকের হাতে সেদিন। ওনার ইস্পাত কঠিন কব্জির মোচড়ে বল আছড়ে পড়তে লাগল মাঠের বিভিন্ন কোনায়। যখন লাঞ্চ করতে গেলেন তখন ওনার ব্যাক্তিগত স্কোর ৫৩।

ওদিকে বনে যেভাবে আগুন ছড়ায় সেইভাবে বোম্বের অফিস, কোর্ট, কলেজ, হাসপাতাল – চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল কর্নেলের কীর্তি। এবার আর মহাত্মাজির ডাকের অপেক্ষায় নয়, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই কাজকর্ম শিকেয় তুলে হেঁটে, বাস বা লোকাল ট্রেনে করে মাঠ তো বটেই, আশে পাশের সমস্ত বাড়ি এবং অফিসের ছাদ এবং গাছের ডাল ভরিয়ে ফেলল বোম্বের মানুষ। ইংল্যান্ডের এক রিপোর্টারের ভাষায় তখন যেদিকেই তাঁকানো হোক না কেন শুধু ক্ষুদে ক্ষুদে মাথা দেখা যাচ্ছে।

লাঞ্চের পর নাইড়ু যেখানে ছেড়েছিলেন ঠিক সেখান থেকেই ব্যাটিং শুরু করলেন। শেষে দুই ঘণ্টার কিছু কম সময়ে যখন ১৫৩ রানের একটা অভাবনীয় ইনিংস খেলে উনি ফিরলেন তখন ভারতীয়দের আত্মসম্মানের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। মোট এগারোটা ছয় উনি মেরেছিলেন সেদিন (সে সময়ের বিশ্বরেকর্ড), তার মধ্যে প্রথমটা ছাড়াও আরও দুটো গিয়ে পড়েছিল টেন্টের ছাদের ওপর।

এরপর বিদেশে গিয়েও সাহেবদের ঠেঙিয়ে এসেছিলেন তিনি। ওনার একটা হুক শট মাঠ আর তার পাশে উরস্টাশায়ার কাউন্টির নদী পেরিয়ে গিয়ে ওপাশে পড়েছিল। ওনার এর কমই কিছু শটের গল্প এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে পুরনো জমানার ক্রিকেট প্রেমিদের মধ্যে।

ভারত যখন টেস্ট খেলা শুরু করে তখন ওনার বয়স ৩৭, এই বয়েসে সাধারণত ক্রিকেটাররা রিটায়ার করে কমেন্ট্রি, কোচিং ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেন। সুতরাং ওনার টেস্ট রেকর্ড যে আহামরি হবে না সেটা স্বাভাবিক।

যারা ওনার সঙ্গে বা বিপক্ষে খেলেছেন বা ওনার পিক ফর্মে মাঠে বসে খেলা দেখেছেন তাদের মধ্যে সবাই মোটামুটি ইউনানেমাস যে কর্নেল সি কে নাইডু ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান, বারিং নান। ওনার ভক্তদের লিস্টে মুশতাক আলীর মতো নামি স্ট্রোক প্লেয়ার আর বিজয় মার্চেন্টের মত বিশ্ববরেন্য ব্যাটসম্যানও সামিল আছেন।

এরা দুজনেই বিজয় হাজারে, পলি উম্রিগড় বা সুনীল গাভাস্করের ব্যাটিং নিজের চোখে দেখেছেন। নেভিল কার্ডাস তো নাইডুকে কোন এক সাংবাদিক ‘ভারতীয় ব্র্যাডম্যান’ বলায় বিরক্ত হয়ে যা লিখেছিলেন তার সারমর্ম এই – ‘নাইডুর ব্যাটিং কাব্যময় – শিল্প এবং সুষমায় ভরা, কখনই তা ব্র্যাডম্যানের মত মেকানিক্যাল নয়। ওনার কাছে টেকনিক মাথা নিচু করে দাসত্ব করে, প্রভুত্ব নয়। ক্রিকেটের মহান অনিশ্চয়তাকে নাইডুর ব্যাটিং কখনই বিপদে ফেলে দেয় না।’

আরও একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি।

বিধাতার বিচিত্র রসবোধে সেদিন লিয়ারি কন্সট্যানটাইন আর কর্নেল এক দলের হয়ে খেলছেন, বিপক্ষ দলে বল হাতে আগুন ঝরাচ্ছেন মহম্মদ নিসার – সেই সময়ের বিশ্বের দ্রুততম বোলারদের অন্যতম। লিয়ারির বিষয়ে সম্ভব হলে অন্যত্র আলোচনা করব, এখানে শুধু এটুকু জানিয়ে রাখি যে ওনাকে অনেকে বিশ্বের প্রথম টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারের শিরোপা দিয়ে থাকেন। হামেশাই এক ঘণ্টার কম সময়ে সেঞ্চুরি করতেন এই ভদ্রলোক আর সেই সঙ্গে ছিল বিধ্বংসী ফাস্ট বোলিং। আর উইকেটের কাছে বা দূরে দুটোতেই উনি বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফিল্ডারদের মধ্যে অন্যতম।

তা এ হেন লিয়ারি নিসারের সম্মুখীন। ওপর প্রান্তের উইকেট পড়ে যাওয়ায় এবার ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন কর্নেল। কর্নেলকে লিয়ারি তেমন চিনতেন না, গম্ভীর মুখে এসে ওনার পিঠে হাত দিয়ে তিনি ওনাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে নিসারকে ডরাবার কোন কারণ নেই কারণ ওকে উনিই ফেস করবেন, কর্নেল যেন শুধু সোজা ব্যাটে খেলে নিজের উইকেট সামলে রাখে। বাধ্য ছাত্রের মত মাথা নাড়লেন কর্নেল।

কিছুক্ষন সবকিছু লিয়ারির প্ল্যানমতো চললেও শেষে দেখা গেল নিসারের একটা নতুন ওভারের সামনে ব্যাট নিয়ে দাঁড়াতে হল কর্নেলকে। নন স্ট্রাইকারের এন্ডে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে লিয়ারি দাঁড়িয়ে।

সি কে নাইডু যে কি জিনিস ওই এক ওভারেই বুঝে গেলেন লিয়ারি কন্সট্যানটাইন। নিসারের বাম্পারের জবাবে ওনার সপাটে মারা হুক শটগুলো আর লেন্থ বলে মারা দৃষ্টিনন্দন ড্রাইভগুলো দেখে ওভারের শেষে ইয়া বড় হাসি হেসে এসে জড়িয়ে ধরলেন তিনি কর্নেলকে,

‘বেশ ঠকিয়েছ আমাকে, অ্যাঁ? তুমিও তো দেখছি চ্যাম্পিয়ন। ইউ আর দ্য বেস্ট, ম্যান!’

এই ম্যাচের সময় নাইডুর বয়স ৪৫। তবে ৬২ বছর বয়সেও উঁচুমানের বোলিং ঠ্যাঙ্গাবার কৃতিত্ব উনি দেখিয়েছেন একাধিক বার।

কর্নেল সি কে নাইডু শুধু অসাধারণ ব্যাটসম্যানই ছিলেন না, ওনার মিডিয়াম পেস বোলিংও যথেষ্ট কার্যকর ছিল। সেই সঙ্গে উনি ছিলেন উচুমানের নির্ভরযোগ্য ফিল্ডার। একবার লর্ডসে সেই এম সি জিরই বিরুদ্ধে একটা শক্তি আর সৌন্দর্যে ভরপুর সেঞ্চুরি, ৩৯/৪ এনালিসিসের বোলিং আর একাধিক অসাধারন ক্যাচ নিয়ে ফিরে আসার পর বিপক্ষ দলের ক্যাপ্টেন ওনাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আর কি কি পারেন আপনি? উইকেট কিপিং?’

ওনার সঙ্গে ফ্র্যাঙ্ক উলির তুলনা করেন বডিলাইন খ্যাত ডগলাস জারডিন, আরও এক বোদ্ধা সোয়ানটনের মনে পড়ে গিয়েছিল রঞ্জিকে। আধুনিক প্রজন্ম হয়ত জানেন না – উলি বা রঞ্জিকে শিল্পময় ব্যাটিং এর বেঞ্চমার্ক হিসেবে ধরা হত।

তাহলে দাঁড়াল কি? বিভিন্ন সমঝদারেরা ব্র্যাডম্যান, উলি, রঞ্জি – এই সব বরেন্য ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে তুলনা করেছেন নাইডুর।

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে আমি এই লেখার মাধ্যমে ঠিক কি কনক্লুজনে পৌঁছতে চাইছি। এবার সেই কথাতেই আসছি।

বিয়েভোর‍্যাল ইকোনমিক্সে একটা খুব চালু কনসেপ্ট আছে, ‘রিসেন্সি বায়াস’। কথাটার মানে হচ্ছে এই যে আমরা কোন ডিসিজন নেওয়ার সময় রিসেন্ট কোন ঘটনাকে তার আগের ঘটনার থেকে বেশি ওয়েটেজ দিয়ে থাকি। যেমন ধরুন কিছুদিন আগেই হয়ত শেয়ার মার্কেটে একজন বেশ কিছু টাকা খুইয়েছে যদিও তার আগে সে তার থেকে বহুগুন বেশি লাভ করেছে ওই শেয়ার মার্কেটেই। কিন্তু তার বর্তমান ডিসিজনে রিসেন্ট ঘটনার প্রভাব অনেকটাই বেশি থাকবে।

তেমনই রিসেন্ট ভোগা কোন অসুখের বিরুদ্ধে আমরা অনেক বেশি সচেতন থাকি তার চেয়ে অনেক বেশী মারাত্মক অথচ আগে ভোগা রোগের চেয়ে। তেমনি, একজন মানুষের সম্পর্কে আমাদের ধারনা অনেকটাই নির্ভর করে সে ইদানিং আমাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছে তার ওপর। অর্থনীতিবিদরা আমাদের এরকম বায়াসের হাত থেকে নিজেকে সচেতন ভাবে রক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

আমাদের প্রিয় ক্রীড়াবিদ বাছার ক্ষেত্রেও এই বায়াস খুব কমন। এরই ফলে যে কোন বিশ্ব একাদশে দেখতে পাবেন ইদানিং খেলা ক্রীড়াবিদদের সংখ্যার আধিক্য।

এই কথাটা মাথায় রেখেই আমাদের ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটারদের প্রসঙ্গে আলোচনা করা উচিৎ। এই বায়াসের প্রভাব কাটাবার জন্য টেন্ডুলকার, কপিল, গাভাস্কার বা কোহলিদের শ্রেস্থত্বের সিংহাসনে বসাবার সময় অন্তত একটা-দুটো আসন আমাদের খালি রেখে দিতে হবে কর্নেল নাইড়ু বা ভিনু মানকড়দের মত প্রতিভার জন্য।

কে জানে, হয়ত উঁচুমানের টিভি ক্যামেরা আর আমরা বছর দশেক আগে টেস্ট স্ট্যাটাস পেলেই ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটারের নাম নিয়ে আর বিতর্কের অবকাশ থাকত না। সেটা যখন হয় নি তখন অন্তত ‘অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের’ শিরোপা থেকে যেন বঞ্চিত না করা হয় কর্নেলকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link