একটি সাংঘাতিক আনন্দদায়ক অনুভূতি

ইতিহাসের প্রথম ‘টাই’ টেস্ট ম্যাচের অন্যতম নায়ক, ষাটের দশকের কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান নরম্যান ও’নিল।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান দর্শকদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তাঁর সহজাত আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে। সমসাময়িক অন্য ব্যাটসম্যানদের তুলনায় বেশ দ্রুতগতিতে রান তুলতে পারতেন তিনি। বিশেষত ব্যাকফুটে তিনি ছিলেন সাংঘাতিক রকমের স্ট্রং। বটম হ্যান্ড ডমিনেটেড স্ট্রোকপ্লে ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক; কাভার ড্রাইভ এবং ফ্লিকও খেলতেন দারুণ। স্পিনারদের বিপক্ষে তাঁর ফুটওয়ার্ক ছিল এককথায় দুর্দান্ত; আর প্যাডল সুইপ ছিল তাঁর অন্যতম পছন্দের একটি শট। তাঁর সময়ের সেরা স্পিনারদের বিপক্ষে দারুণ সফল ছিলেন তিনি।

ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি অ্যাথলেটিক ফিল্ডার হিসেবে ও’নিলের বেশ নামডাক ছিল। বিশেষ করে কাভার পজিশনে দুর্দান্ত ফিল্ডিং করতেন তিনি। থ্রোয়িং আর্মটাও ছিল অসাধারণ; অনেক দূর থেকেও পাওয়ারফুল ও নিখুঁত থ্রো করতে পারতেন তিনি।

ইংলিশ কিংবদন্তী ওয়ালি হ্যামন্ড একবার বলেছিলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ও’নিলই আমার দেখা সেরা অলরাউন্ডার।’

কিংবদন্তী বাঁহাতি পেসার অ্যালান ডেভিডসনের বক্তব্য ছিল, ‘ও আমার দেখা সবচেয়ে প্রাণবন্ত ক্রিকেটারদের একজন। ও স্রেফ একটা ডাইনামাইট।’

ও’নিল প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক ও কিংবদন্তী ধারাভাষ্যকার রিচি বেনো বলেছেন, ‘অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে ওর মত এনটারটেইনার আর আসেনি।’

জনপ্রিয় ক্রীড়া সাময়িকী উইজডেনের ভাষ্যমতে, ‘ওর প্রতিটি বড় ইনিংসই একেকটা সৌন্দর্য। ওকে স্ট্রোক খেলতে দেখাটা খুবই আনন্দদায়ক।’

ছেলেবেলা থেকেই ভীষণ প্রতিভাবান এই ক্রিকেটারের ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক মাত্র ১৮ বছর বয়সে, নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যদলের হয়ে। তার তিন বছর পরই খেলেন অভিষেক টেস্ট, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। তাঁর শৈশবের হিরো ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রখ্যাত অলরাউন্ডার কিথ মিলার।

অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার কল্যাণে অভিষেকের আগেই অবশ্য তাঁর নামের পাশে জুটে গিয়েছিল ‘নতুন ব্র‍্যাডম্যান’ তকমা। ও’নিলের বটম হ্যান্ড ডমিন্যান্স, পুল-হুক শট সবই নাকি দেখতে অবিকল ব্র‍্যাডম্যানের মত!

টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটা দারুণ হলেও পরে গিয়ে সেটা আর ধরে রাখতে পারেন নি তিনি। তবে ৪২ টেস্টে ৪৫.৫৬ গড়ে ২৭৭৯ রানের পরিসংখ্যানকে খারাপ বলা যাবে না মোটেও। ৬টি সেঞ্চুরির সাথে আছে ১৫টি ফিফটিও।

১৯৫৮-৫৯ মৌসুমে অ্যাশেজ সিরিজে অংশ নিতে অস্ট্রেলিয়া সফরে এসেছিল ইংল্যান্ড। পার্থে অনুষ্ঠিত একটি প্রস্তুতি ম্যাচে ইংলিশদের প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া সম্মিলিত একাদশ; যে দলে ছিলেন ২১ বছরের তরুণ নরমান ও’নিলও।

সফরকারী ইংলিশ দলে ছিলেন বিখ্যাত ফাস্ট বোলার ‘ফিয়ারি ফ্রেড’ খ্যাত ফ্রেড ট্রুম্যান। তিনি ও’নিলের পরীক্ষা নিতে চাইলেন দ্রুতগতির শর্ট বল দিয়ে। ও’নিলের পাঁজর বরাবর একটার পর একটা বাউন্সার দিয়ে গেলেন ট্রুম্যান। কিন্তু ও’নিল ছিলেন নির্বিকার, সবগুলো বাউন্সারই ছেড়ে দিলেন গা বাঁচানোর ভঙ্গিতে। আসলে তিনি সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ট্রুম্যানের বলে হুক শট একদম খেলবেনই না!

ট্রুম্যানের বলে আক্রমণাত্মক স্ট্রোক খেলা থেকে বিরত থাকলেও ও’নিল সেদিন চড়াও হয়েছিলেন জিম লেকারের ওপর। সাবেক এই কিংবদন্তী অফ স্পিনারের এগেইনস্টে চমৎকার কিছু সুইপ ও ইনসাইড আউট শট খেলেছিলেন তিনি। প্রায়ে সাড়ে চার ঘন্টা টিকে থেকে ও’নিল খেলেছিলেন ১০৪ রানের আত্মবিশ্বাসী এক ইনিংস যার বেশিরভাগ রানই এসেছিল ‘অফ সাইড’ থেকে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আরও দুটো প্রস্তুতি ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন ও’নিল। যেখানে ৮৫ ও ৮৪ রানের দারুণ দুটো ইনিংস ছিল তাঁর।

প্রস্তুতি ম্যাচে ভাল খেলার পুরস্কারটা তিনি হাতেনাতে পেয়েছিলেন ব্রিসবেনে সিরিজের প্রথম টেস্টের মূল একাদশে সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে। অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে ও’নিল করেছিলেন ৩৪ রান। ওই রানের সুবাদেই ইংলিশদের বিপক্ষে ৫২ রানের লিড পেয়েছিল স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। তবে ও’নিল নিজের জাত চিনিয়েছিলেন দ্বিতীয় ইনিংসে; চারে নেমে অপরাজিত ৭১ রানের ‘স্ট্রোক ঝলমলে’ এক ইনিংস খেলে দলকে এনে দিয়েছিলেন ৮ উইকেটের অনায়াস জয়। ইংলিশ ফাস্ট বোলাররা ‘লেগ থিওরি’ প্রয়োগ করেও তাঁকে থামাতে পারেন নি সেদিন। দুর্দান্ত সব পুল আর হুক শটের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন ও’নিল।

অভিষেক ম্যাচেই ও’ নিলের অনবদ্য সেই ইনিংস সম্পর্কে ইংলিশ অধিনায়ক পিটার মে’র মন্তব্যটা ছিল মাত্র ‘এক’ শব্দের – ‘ঝলমলে’।

তবে ঐতিহাসিক সেই ব্রিসবেন টেস্টটা বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত!) হয়ে আছে অন্য কারণে। ‘টাইম ওয়াস্টিং’ এর মত নেতিবাচক কৌশলের কারণে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল ইংলিশরা। অজি অধিনায়ক রিচি বেনোর ভাষায়, ‘সবচেয়ে ধীর ও বাজে ক্রিকেটের নজীর।’

উল্লেখ্য, ওই ম্যাচেই টেস্ট ইতিহাসের ‘মন্থরতম’ ইনিংসটি খেলেছিলেন ইংলিশ ব্যাটসম্যান ট্রেভর বেইলি; ‘মাত্র’ ৪২৬ বল খেলে করেছিলেন ৬৮ রান! শম্বুকগতির সেই ব্যাটিংকে তুলনা করা হয়েছিল ‘বন্ধ দরজা’র সাথে।

ট্রেভর বেইলির প্রায় সাড়ে ৭ ঘন্টাব্যাপী বিরক্তিকর ‘ম্যারাথন’ সেই ইনিংস প্রসঙ্গে অভিষিক্ত ও’নিলের বক্তব্য ছিল, ‘অবিশ্বা্য রকমের খেলা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেকোনো সময় ঘুমিয়ে পড়বো।’

পাঁচ ম্যাচ সিরিজের অ্যাশেজটা অস্ট্রেলিয়া সেবার জিতেছিল ৪-০ ব্যবধানে। ৩ ফিফটিতে ৫৬.৪০ গড়ে নরমান ও’নিলের সংগ্রহ ছিল ২৮২ রান; হয়েছিলেন সিরিজের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।

অভিষেক সিরিজে ব্যাট হাতে পাওয়া দুর্দান্ত ফর্মটাকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটেও। ভিক্টোরিয়া এবং ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ম্যাচে ১৫৫ ও ১২৮ রানের ‘ম্যাচ উইনিং’ দুটি ইনিংস খেলে নিউ সাউথ ওয়েলসকে জিতিয়েছিলেন শেফিল্ড শিল্ডের শিরোপা।

১৯৫৯-৬০ মৌসুমে ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলতে উপমহাদেশ সফরে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। ঢাকায় পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে তেমন কিছু করতে না পারলেও (২ ও ২৬*) দলের জয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন পরের টেস্ট লাহোরে। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটা পেয়েছিলেন ওই ম্যাচেই।

লাহোর টেস্টের প্রথম ইনিংসে ও’নিলের সংগ্রহ ছিল ১৩৪ রান; অস্ট্রেলিয়া পেয়েছিল ২৪৫ রানের বিশাল লীড। পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসে বোলিং করতে এসে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট উইকেটটাও পেয়ে যান ও’নিল; লেগ স্পিনের মায়াজালে বিভ্রান্ত করেছিলেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান সুজাউদ্দীনকে।

ম্যাচের শেষ বিকেলে জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্য ছিল ১২২ রান, কিন্তু হাতে সময় ছিল মাত্র দুই ঘন্টা। তার ওপর মাত্র ১৫ রানের মধ্যেই তারা হারিয়ে ফেলে দুই ওপেনারকে।

বাঁহাতি নেইল হার্ভের সাথে ডানহাতি নরমান ও’নিলের জুটিটা জমে ওঠে ঠিক এর পরপরই। আর তখনই বাধে বিপত্তি। সফরকারীদের জয়বঞ্চিত করতে ‘টাইম ওয়াস্টিং’সহ নানান টালবাহানা শুরু করে পাকিস্তানিরা।

লেফট হ্যান্ড-রাইট হ্যান্ড কম্বিনেশনের জন্য আলাদা ফিল্ডিং প্লেসমেন্টের নামে অনবরত সময় নষ্ট করতে থাকে তারা। প্রতিটি ওভার শেষ করতে তারা সময় লাগাচ্ছিল প্রায় ৭-৮ মিনিট!

পাকিস্তানের এই অন্যায় কৌশলকে প্রতিহত করতে একটা সময় বাজে শট খেলে নিজের উইকেট বিলিয়ে আসেন বাঁহাতি নেইল হার্ভে (৩৭)। ফলে ক্রিজে আসেন ডানহাতি রিচি বেনো। দুই ডানহাতি মিলে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে খেলা শেষের মাত্র কয়েক মিনিট বাকি থাকতে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। ১২২ রানের লক্ষ্যটা অতিক্রম করতে অস্ট্রেলিয়াকে খেলতে হয়েছিল ২৫ ওভারের মত।

‘টাইম ওয়াস্টিং’ নিয়ে পাকিস্তান অধিনায়ক ইমতিয়াজ আহমেদের সাথে বেশ কবার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়েছিল বেনোর। বেনো করেছিলেন অপরাজিত ২৪, আর ও’নিল নট আউট ছিলেন ৪৩ রান করে।

উল্লেখ্য, ওটাই ছিল পাকিস্তানের মাটিতে ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সর্বশেষ টেস্ট জয়। যে দলটির গর্বিত সদস্য ছিলেন নরমান ও’নিল।

তিন টেস্টের সিরিজে ৭২.৬৬ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ছিল ২১৮ রান। প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে এই পারফরম্যান্সকে এককথায় বলতে হয় অসাধারণ!

পাকিস্তানের মাটিতে নরমান ও’নিলের ব্যাটিং বীরত্বে সাধারণ পাকিস্তানি দর্শকরা যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছিল। করাচীতে একটি পাকিস্তানি হিন্দু পরিবারের নবজাতক সন্তানের নামও রাখা হয় ও’নিলের নামের সাথে মিল রেখে! অনিল দলপত! কি নামটা খুব চেনা চেনা লাগছে? হুম, ঠিকই ধরেছেন। এই ‘অনিল দলপত’-ই পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট খেলা সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রথম ক্রিকেটার। আশির দশকে পাকিস্তানের হয়ে নয়টি টেস্ট ম্যাচে অংশ নিয়েছেন তিনি।

পাকিস্তান সফর শেষে এবার ভারত সফরের পালা। ভারতের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজটা অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে। দুটো টেস্ট ছিল অমীমাংসিত।

দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল এক ইনিংস ও ১২৭ রানে। কানপুরে দ্বিতীয় টেস্টটা আবার ভারত জিতে নেয় ১১৯ রানে। মুম্বাইতে তৃতীয় টেস্ট ড্র হওয়ার পর চেন্নাই টেস্টে আবার অস্ট্রেলিয়া কামব্যাক করে ইনিংস ও ৫৫ রানের ব্যবধানে জয়লাভের মাধ্যমে। ইডেনে শেষ ম্যাচটা ড্র হলে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জেতে অস্ট্রেলিয়া।

৫ ম্যাচের সিরিজে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক নরমান ও’নিলের সংগ্রহ ছিল ৬২.৬৬ গড়ে ৩৭৬ রান। একমাত্র সেঞ্চুরিটা (১১৩) এসেছিল কলকাতার ইডেনে। দুর্দান্ত সেই সেঞ্চুরির ওপর ভর করেই প্রথম ইনিংসে লিড নিতে পেরেছিল অস্ট্রেলিয়া।

চমৎকার একটা উপমহাদেশীয় সফর শেষে দেশে ফিরেই ও’নিল খেলতে নেমে পড়েন শেফিল্ড শিল্ডের ফাইনালে। তাঁর অনবদ্য ১৭৫ রানের ইনিংসের সুবাদেই ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে টানা ৮ম বারের মত শিরোপা জেতে নিউ সাউথ ওয়েলস।

১৯৬০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম সিরিজের একটা প্রস্তুতি ম্যাচে ও’নিল করেন অপরাজিত ১৫৬ রান। এরপর ব্রিসবেনে ইতিহাসের প্রথম ‘টাই’ টেস্টে খেলেন ক্যারিয়ার সেরা ১৮১ রানের ‘মহাকাব্যিক’ এক ইনিংস। যে ইনিংস নিয়ে সতীর্থ বব সিম্পসনের বক্তব্যটা ছিল এরকম, ‘আমাকে যদি সৃষ্টিকর্তা বলেন, এক ঘণ্টা ধরে একজনকে দেখতে হবে, তাহলে আমি নরম্যান ও’নিলকে চাবো। ওর মধ্যে ওই স্টাইলটা আছে।’

১৯৫৮ সালে অভিষেকের পর থেকে ১৯৬০ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ। নরমান ও’নিলের টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম দুটো বছর কেটেছিল রীতিমতো মধুচন্দ্রিমার মতন! ১৪ টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৬৭.৬৮! ‘নতুন ব্র‍্যাডম্যান’ তো আর তাঁকে এমনি এমনি বলা হত না!

সিরিজের তৃতীয় টেস্টটা হয়েছিল সিডনির ‘ডাস্টবোলে’। টার্নিং উইকেটে ক্যারিবীয় ‘স্পিন জুটি’ ল্যান্স গিবস ও আলফ ভ্যালেন্টাইনকে সামলাতে দারুণ হিমশিম খেতে হয়েছিল অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন নরমান ও’নিল। স্পিন জুজুকে জয় করে দুই ইনিংসে করেছিলেন যথাক্রমে ৭০ ও ৭১ রান।

অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা হেরেছিল ৩২২ রানে; দুই স্পিনার ভ্যালেন্টাইন আর গিবস মিলে নিয়েছিলেন ১৬ উইকেট। ৫ ম্যাচের টেস্ট সিরিজটা অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে। এতে বড় ভূমিকা ছিল ৫২.২০ গড়ে ৫২২ রান করা ব্যাটসম্যান নরমান ও’নিলের।

১৯৬১ সালের ইংল্যান্ড সফরে এক সিজনে নরমান ও’নিলের সংগ্রহ ছিল ৭ সেঞ্চুরিতে ৬০.০৩ গড়ে ১৯৮১ রান; অল্পের জন্য মিস করেছিলেন ডন ব্র‍্যাডম্যানের এক সিজনে ২০০০ রানের অনন্য রেকর্ড স্পর্শ করার সুবর্ণ সুযোগ! সে যুগে অ্যাশেজ ট্যুরগুলোতে প্রস্তুতি ম্যাচ, টেস্ট সব মিলিয়ে ১৪-১৫টা করে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলতে হত সফরকারী দলকে।

সে বছর অ্যাশেজ সিরিজটা ড্র হয়েছিল ১-১ ব্যবধানে। নরমান ও’নিলের ব্যাট থেকে এসেছিল ৪০.৫০ গড়ে ৩২৪ রান। একমাত্র সেঞ্চুরিটা (১১৭) পেয়েছিলেন ওভালে সিরিজের শেষ টেস্টে।

আন্তর্জাতিক ও ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ব্যাট হাতে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের পুরস্কারস্বরূপ ১৯৬২ সালে উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন নরমান ও’নিল।

১৯৬১-৬২ সালের অ্যাশেজ ট্যুরের পর থেকেই হঠাত করে ফর্ম হারাতে থাকেন তিনি। ইনিংসের শুরুতেই ‘এক্রস দ্য লাইন’ খেলতে যাওয়ার প্রবণতা থেকেই বার বার আউট হচ্ছিলেন। ব্যাট হাতে শুরু থেকেই কেন জানি আত্মবিশ্বাসের অভাব ও নার্ভাসনেসে ভুগছিলেন। নড়বড়ে স্টার্টিংয়ের কারণে একসময় তো তাঁর নামই হয়ে যায় ‘Nervous Norm’.

নরমান ও’নীলের ফর্মহীনতার প্রমাণ হিসেবে বলা যায় ১৯৬১-৬২ সিজনের শেফিল্ড শিল্ডের পারফরম্যান্সকে। মাত্র ২ ফিফটিতে ২৫.১৩ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৩৭৭ রান।

১৯৬২-৬৩ মৌসুমের শেফিল্ড শিল্ডে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি (১৩১ ও ১৪৩) হাঁকিয়ে ফর্মে ফেরার আভাসও দিয়েছিলেন নরমান ও’নিল। দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাশেজ সিরিজের প্রথম টেস্টেই হাঁকান অর্ধশতক (৫৬)। তবে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন পরের দুই টেস্টে। চার ইনিংসে একবারও দুই অংক ছুঁতে পারেন নি তিনি!

অ্যাডিলেডে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি (১০০) হাঁকিয়ে আবারও নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদান দেন নরমান ও’নিল। তারই ধারাবাহিকতায় সিডনিতে সিরিজের শেষ টেস্টেও খেলেন ৭৩ রানের অনবদ্য একটি ইনিংস।

১৯৬২-৬৩ অ্যাশেজের পাঁচ টেস্টে নরমান ও’নিল করেছিলেন ৩৪.৪৪ গড়ে ৩১০ রান। ক্যারিয়ারের ২৮ তম টেস্টে এসে প্রথমবারের মত তাঁর ব্যাটিং গড় নেমে আসে পঞ্চাশের নিচে। সিরিজ শুরু করেছিলেন ৫৩.৮১ গড় নিয়ে, সিরিজ শেষে সেটা নেমে আসে ৪৯.৫৬ তে!

পড়তি ফর্মের পাশাপাশি হাঁটুর ইনজুরিটাও তাঁকে ভোগাচ্ছিল বেশ। যার প্রভাব পড়েছিল ঘরোয়া ক্রিকেটেও। সে বছর খেলা ৮ ইনিংসের মধ্যে মাত্র একবার ২৫ পেরিয়েছিলেন তিনি!

১৯৬৩-৬৪ সিজনের শেফিল্ড শিল্ডে প্রথম ৬ ইনিংসে মাত্র একবার দুই অংক ছুঁয়েছিলেন নরমান ও’নিল। এত বাজে ফর্মের পরও তার ওপর থেকে বিন্দুমাত্র আস্থা কিংবা বিশ্বাস হারান নি নির্বাচকরা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঘোষিত টেস্ট সিরিজের দলেও যথারীতি রাখা হয়েছিল তাঁকে।

প্রোটিয়াদের বিপক্ষে চার টেস্টের সিরিজে খুব ভাল করতে না পারলেও একেবারে খারাপও করেন নি ও’নিল। ২ ফিফটিতে ৪০.৭১ গড়ে করেছিলেন ২৮৫ রান।

১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ড সফরেও দলের সাথেই ছিলেন নরমান ও’নিল। তবে ৫ ম্যাচের মধ্যে সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র ৩ টিতে। সেখানে ব্যাট হাতে তাঁর পারফরম্যান্স ছিল বেশ গড়পড়তা মানের। ৬ ইনিংসে ৩১.২০ গড়ে করেছিলেন মাত্র ১৫৬ রান।

১৯৬৪-৬৫ সালের ‘উপমহাদেশ’ সফরের দলেও টিকে যান তিনি। তবে সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র দুই ম্যাচে। ভারতের বিপক্ষে মাদ্রাজ ও বোম্বাই টেস্টের দুই ইনিংসে ব্যাট করে মাত্র ২০ গড়ে করেছিলেন ৪০ রান।

করাচিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট ম্যাচের একাদশে ছিলেন না তিনি। দেশে ফিরে ৫টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেন ও’নিল। ১ সেঞ্চুরিতে ৫৯.৫ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৩৫৭ রান।

১৯৬৫ সালে ক্যারিবিয়ান সফরের প্রথম টেস্টেই ডানহাতি ফাস্ট বোলার ওয়েস হলের বলে ডান হাতে মারাত্মক চোট পান ও’নিল। হাসপাতালে গিয়ে এক্সরে পর্যন্ত করাতে হয়েছিল! ওই ম্যাচে আর ব্যাটিংয়েই নামতে পারেন নি তিনি।

দ্বিতীয় টেস্টে ব্যাট করতে নেমেই আরও একবার হাতে চোট পেয়ে হাসপাতালে যেতে হয় তাঁকে। এবারে অবশ্য ওয়েস হল নন; আরেক ‘গতিদানব’ চার্লি গ্রিফিথের হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা একটি বলে হাতের মাংসপেশিতে গুরুতর জখমের সৃষ্টি হয়েছিল।

এত কিছুর পরেও ওই সিরিজের চার ম্যাচ (চোটের কারণে এক ম্যাচ খেলেন নি) থেকে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন ২৬৬ রান, ৪৪.৩৩ গড়ে। বারবাডোজে সিরিজের শেষ টেস্টে দুই ইনিংসেই হাঁকিয়েছিলেন ফিফটি (৫১ ও ৭৪*)।

শুধু তাই নয়, অকেশনাল লেগ স্পিনে ৯ উইকেটও নিয়েছিলেন তিনি, ২৫.৫ গড়ে। সেরা বোলিং ফিগার ছিল ৪/৪১, ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে দেশে ফেরার পরই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন নরমান ও’নিল। সিডনির জনপ্রিয় দৈনিক ‘ডেইলি মিরর’ পত্রিকার এক কলামে ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলার চার্লি গ্রিফিথকে সরাসরি ‘চাকিং’ এর দায়ে অভিযুক্ত করেন তিনি। এমনও ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, গ্রিফিথের মত ‘চাকার’দের বিপক্ষে আর কোনদিন খেলবেন না!

নরমান ও’নিলের ভাষায়, ‘ওকে (গ্রিফিথ) যদি এভাবে থ্রো করতে দেওয়া হয়, একদিন ও কাউকে না কাউকে মেরে ফেলবে।’

পত্রিকায় ‘বিতর্কিত’ কলাম লিখে ক্রিকেট বিশ্বে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন তিনি। তবে ও’নিলের সুরে সুর মিলিয়েছিলেন কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারও। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড (ডব্লিউআইসিবি) এ বিষয়ে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কাছে লিখিত অভিযোগ পর্যন্ত করেছিল। ফলে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের বড় কর্তারা। চাপের মুখে ও’নিলকে বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ দিয়ে দেন তাঁরা।

১৯৬৬ সালের অ্যাশেজ সফরের দল থেকে অনুমিতভাবেই বাদ পড়তে হয় তাঁকে। বিতর্কিত এই ঘটনার প্রভাব পড়েছিল তাঁর ঘরোয়া লীগের পারফরম্যান্সেও। সে বছর শেফিল্ড শিল্ডে ৩৯.৪২ গড়ে করেছিলেন ৪৭৩ রান।

১৯৬৬-৬৭ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দলেও উপেক্ষিত ছিলেন নরমান ও’নিল। তবে ঘরোয়া লিগে চার সেঞ্চুরিতে ৭৪.১০ গড়ে ৭৪১ রান করে দুর্দান্ত কামব্যাকও করেছিলেন; যার সুফলও তিনি পেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের হয়ে নিউজিল্যান্ড সফরের স্কোয়াডে ডাক পেয়ে। নিউজিল্যান্ড সফরে অকল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি হাঁকিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের শেষ ফার্স্ট ক্লাস শতক।

পরবর্তীতে হাঁটুর ইনজুরির কারণে একরকম বাধ্য হয়েই মাত্র ২৯ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরে যেতে হয় তাঁকে। নরমান ও’নিল সম্পর্কে এক বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক মন্তব্য করেছিলেন, ‘তিনি একটা আক্ষেপের নাম, তার ক্রিকেটটাও। তবে চাইলে তাঁর আক্ষেপের অংশটা ভোলা যায়, ভোলা যায় না ক্রিকেটকে।’

খেলোয়াড়ি জীবন শেষে কীর্তিমান এই ক্রিকেটার যোগ দিয়েছিলেন কমেন্ট্রি বক্সে ধারাভাষ্যকার হিসেবে। তাঁর সুযোগ্য সন্তান মার্ক ও’নিল বর্তমানে একজন স্বনামধন্য ক্রিকেট কোচ। কিছুদিন আগে ব্যাটিং পরামর্শক হিসেবে বাংলাদেশেও কাজ করে গেছেন। ২০০৮ সালের ৩ মার্চ, কণ্ঠনালীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৭১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন নরম্যান ও’নিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link