ক্রিকেটের ফাঁকে ব্যবসা, নাকি ব্যবসার ফাঁকে ক্রিকেট!

প্রশ্নটা অনেকদিন ধরেই উঠছে। সাকিব যখন থেকে প্রায় পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন, তখন থেকেই এই প্রশ্নটা উঠছে যে, তার প্রায়োরিটি এখন কোনটা? ক্রিকেট, নাকি ব্যবসা?

অধুনা সাকিব আল হাসান এই প্রশ্নের মুখোমুখিও হয়েছিলেন। একটি ওয়েবসাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাকিব নিজেও এই প্রশ্নের কোনো মিমাংসা করতে পারেননি। বেশ দ্বিধা নিয়ে বলেছিলেন, ‘ক্রিকেটই টপ প্রায়োরিটি কি না, বলতে পারব না! তবে যখন খেলার ভেতরে ঢুকি, যদি চ্যালেঞ্জ আসে, সেটা ওভারকাম করার একটা তাড়না কিন্তু থাকেই।’

আর এখানেই আসলে সংকটের শুরু।

সাকিবের সংকটকে আর দশ জন সেলিব্রিটি ক্রিকেটারের সংকটের সাথে মেলানো যাবে না। সাকিবের বিজ্ঞাপনে অনেক সময় দিতে হয়। তিনি বিপিএল ফাইনালের আগের দিন অনুশীলন ও সংবাদ সম্মেলন মিস করে শুটিং করতে যান। এটা খুব বড় কোনো সংকট নয়। এমন বিজ্ঞাপনে সময় অনেক উপমহাদেশীয় তারকাকেই দিতে হয়েছে বা হয়।

হ্যাঁ, তারা হয়তো শিডিউল মেলানোর সময় আরেকটু হিসেবি থাকেন। যাতে ক্রিকেটের সাথে বিজ্ঞাপনের সেভাবে সংঘাত না হয়। কিন্তু সাকিবের এই শিডিউল মেলানোর মত সময় কই?

কেবল ক্রিকেট আর বিজ্ঞাপনকে সময় দিলেই তো তার চলছে না। সাকিব আজ ব্যাংক করছেন, কাল রেস্টুরেন্ট করছেন, শেয়ার বাজারে নামছেন, সোনার ব্যবসা করছেন, মোনার্ক মার্ট করছেন। সম্প্রতি সাকিব আর তার অংশীদারেরা মিলে বাজারে এনেছেন নতুন ই কমার্স প্রতিষ্ঠান মোনার্ক মার্ট। এই প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে বিপিএলে বরিশাল বুলস আর আফগানিস্তান-বাংলাদেশ সিরিজে আফগানিস্তানকে স্পন্সর করেছে।

ক্রিকেট, বিজ্ঞাপন, ব্যবসা; এই তিনটাতেও হয়তো শিডিউল মেলানো সম্ভব ছিলো। কিন্তু এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে, সাকিবের প্রায় প্রবাসী হয়ে ওঠা জীবন।

সাকিবের পরিবার প্রায় স্থায়ীভাবেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে। স্ত্রী, সন্তানরা সেখানেই থাকেন। ফলে তাঁকে নিয়ম করে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটতে হয়। সেখানে একটু হলেও থাকতে হয়। নিজেই বলেছেন, আমেরিকাতে যাতায়াতেই তার বড় একটা সময় নিয়ে নেয়।

এখন কথা হচ্ছে, মানুষের বছরে দিনটা তো সীমিত; মাত্র ৩৬৫টি দিন।

এই সামান্য ক’টা দিন দিয়ে তো সাকিবের পোষাচ্ছে না। তিনি এই সময়টাতে শিডিউল মেলাতে হাসফাস করবেন, কিছু খেলা মিস করবেন; এটা একেবারে অবধারিত। এর ফলে তিনি জাতীয় দলের হয়ে সব ফরম্যাটে নিয়মিত খেলতেও পারছেন না।

বাংলাদেশের সর্বশেষ ৩৩ টি টেস্টের মধ্যে মাত্র ১২ টি খেলতে পেরেছেন সাকিব। এর শেষ চারটি অধিনায়ক হিসেবে। এরপরও বোঝাই যাচ্ছে, পাঁচ দিনের এই ফরম্যাটে খেলার মত সময় তার হাতে নেই। যতই রেকর্ডের হাতছানি থাক, যতই মহান হওয়ার মোহ থাক; এটা সম্ভব না। বাস্তবিক অর্থে এটা সম্ভব না। ফলে সাকিব খুব যৌক্তিকভাবেই এক বছরের জন্য টেস্ট থেকে ছুটি চেয়েছিলেন। বিসিবি প্রায়ই তাঁর হাতেপায়ে ধরে তাঁকে রাজি করে ফেলেন। এরপর তো তাঁকে রীতিমত অধিনায়কত্বই দিয়ে দেওয়া হল। ফলে, হল যেটা এবার তাঁকে রঙিন পোশাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

বিসিবির কাছ থেকে ছাড় পেয়ে এবার তো তিনি বেটউইনার নামের অনলাইন বেটিং সাইটের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্রও বনে গেলেন। বিসিবিও একটু টনক নড়ার ভান করলো। এবার হয়তো বড় অন্যায়ে হালকা বকুনিও হজম করবেন সাকিব।

কিন্তু এরপর? এভাবে সাকিবকে জোর করে কতদিন খেলানো সম্ভব? কতদিন আটকানো সম্ভব?

না, বিসিবি সে আশা করছে না। তারা বাস্তবতা বুঝতে পারছে। প্রায়ই বিসিবি বলে, তারা এভাবে জোর করতে চান না। কেউ ছুটি চাইলে বা কোনো একটা ফরম্যাট খেলতে না চাইলে তারা জোর করবেন না। তবে পরিকল্পনাটা আগে থেকে জানিয়ে দিতে হবে। যদিও, বিসিবির চাওয়া কেবল মুখের কথাতেই সীমাবদ্ধ।

এই চাওয়ার কোনো ভিত্তি নেই। কোনো অর্থ নেই। ধরা যাক, সাকিব সেই পরিকল্পনা জানিয়ে দিলেন। তারপর? তারপরই কী আমরা সাকিবকে ছাড়া খেলতে প্রস্তুত হয়ে যাবো? নাকি সে জন্য আমাদের আসলেই প্রস্তুতি থাকতে হবে?

সাকিবকে ছাড়া টেস্ট তো চলছে কয়েক বছর ধরে। তাতে কী আমরা বিকল্প তৈরি করতে পেরেছি? পারলে তো সাকিবকে আজ এভাবে জোর করতে হতো না।

সাকিব ব্যবসা করবেন নাকি ক্রিকেট খেলবেন, এটা তার দুশ্চিন্তা। কিন্তু সাকিবকে ছাড়া আমরা কিভাবে সামনে এগোবো, সেটা আমাদের চিন্তা হওয়া উচিত। আমরা সাকিবকে টেবিলে ঠেলে দিয়ে কি নিজেদের আড়াল করতে চাচ্ছি?

আপাতত হয়তো একাধিক ফরম্যাটে নেতা বানিয়ে দিলেন। সংকট এড়ানো গেল, কিন্তু আখেড়ে বিকল্প খুঁজে বের করার কোনো বিকল্প নেই বিসিবির সামনে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link