২০০৭ থেকে ২০২২ সাল। কত বছর হয়? ১৫ বছর।
হ্যাঁ, ১৫ বছর ধরে কমবেশি দেখছি সাকিব আল হাসানকে। এর মধ্যে বার কয়েক খুব কাছে বসে বিরাট লম্বা সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। ফোনে কথা হয়েছে। অনেক সংবাদ সম্মেলনে কথা শুনেছি। ক্যাজুয়াল আলাপেও দেখেছি। কিন্তু সাকিব আল হাসানকে এতোটা অসহায় ভাবে কথা বলতে কখনো দেখিনি।
এমনকি আইসিসি যখন এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করলো, তখনও সাকিবকে দেখে এতোটা বিপর্যস্ত মনে হয়নি। সেই ইষ্পাত দৃঢ় সাকিবকেই কাল মনে হলো আর পারছেন না।
বিমানবন্দরে তার বলা প্রতিটা শব্দ, মুখের প্রতিটা অভিব্যক্তি বলছিলো, প্লিজ, একটাবারের জন্য ছেড়ে দিন।
সাকিব এই অসহায়ত্বের কথা নানাভাবে গত কিছুদিন ধরে বলার চেষ্টা করছেন। সাকিব এখন আছেন এক ভয়াবহ সময়ের টানাটানি ও ছোটাছুটির মধ্যে। কেবল ক্রিকেট আর বিজ্ঞাপনকে সময় দিলেই তো তার চলছে না। সাকিব আজ ব্যাংক করছেন, কাল রেস্টুরেন্ট করছেন, শেয়ার বাজারে নামছেন, সোনার ব্যবসা করছেন, মোনার্ক মার্ট করছেন। সম্প্রতি সাকিব আর তার অংশীদারেরা মিলে বাজারে এনেছেন নতুন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মোনার্ক মার্ট। এই প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বিপিএলে বরিশাল বুলস আর আফগানিস্তান-বাংলাদেশ সিরিজে আফগানিস্তানের জার্সি স্পন্সর করেছে।
ক্রিকেট, বিজ্ঞাপন, ব্যবসা; এই তিনটেও হয়তো শিডিউল মেলানো সম্ভব ছিলো। কিন্তু এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে, সাকিবের প্রায় প্রবাসী হয়ে ওঠা।
সাকিবের পরিবার প্রায় স্থায়ীভাবেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে। স্ত্রী, সন্তানরা সেখানে থাকেন। ফলে তাকে নিয়ম করে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটতে হয়। সেখানে একটু হলেও থাকতে হয়। নিজেই বলেছেন, আমেরিকাতে যাতায়াতই তার বড় একটা সময় নিয়ে নেয়।
ফলে সাকিবের আসলেই একটা বিরতি খুব দরকার। তা না হলে যেটা হচ্ছে, সাকিব মনের বিপক্ষে খেলছেন; আমরাও সাকিবকে পাচ্ছি না। ঠিক এই কথাটাই কাল বলছিলেন সাকিব, ‘আফগানিস্তান সিরিজে মনে হয়েছে যে আমি একজন প্যাসেঞ্জার। আমি যা হয়ে কখনোই থাকতে চাই না। আমি খেলা একদমই উপভোগ করতে পারিনি। পুরো সিরিজই, টি-টোয়েন্টি এবং ওয়ানডে। আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়নি। আমার কাছে মনে হয় না, এরকম মন-মানসিকতা নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ খেলা আমার উচিত হবে।’
এখন প্রশ্ন হতে পারে, সাকিব বাকী সব বাদ দিয়ে ক্রিকেট খেলছেন না কেন?
এখানে উত্তর দুটো। প্রথমত এটা তার পছন্দ করার অধিকার আছে। তিনি ক্রিকেট খেলবেন, নাকি নিজের অর্থনৈতিক লাভের কথা ভাববেন, এটুকু তার হাতেই ছেড়ে দেই আমরা। তবে এটা তো আসল কথা না। আসল কথা হলো, ক্রিকেট ছাড়া বাকী কর্মকাণ্ডের কোনোটাই সাকিবকে এরকম ক্লান্ত করে ফেলতে পারে না।
বাকী তার যেসব কাজ, তা এতো ডিমান্ডিংও নয়। বিজ্ঞাপন করতে তাকে ৫ দিন ধরে সমান মনোযোগ দিয়ে রাখতে হয় না; ওটা এক ঘন্টার কাজ। ব্যবসা করতে নিজের ছোটা লাগে না। খবর রাখলেই চলে। ফলে ক্রিকেট থেকে তিনি দূরে থাকলেই কেবল আসল বিরতিটা পাবেন।
যেটা এই বয়সে এসে একজন ক্রিকেটারের খুব জরুরি হয়ে উঠতে পারে।
সাকিবের জায়গায় ভিন্ন কোনো দেশের খেলোয়াড় হলে হয়তো টেস্ট থেকে অবসরই নিয়ে নিতেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা এমন যে, এখানে সেই স্বাভাবিক কাজটা করলেও ছি! ছি! রব উঠবে। সেই ভয়েই হয়তো সাকিব মনের বিরুদ্ধে খেলে যাচ্ছেন। কিন্তু শতভাগ দিতে পারছেন না। আর এই শতভাগ দিতে না পারার ব্যাপারটাকে সাকিবের কাছে দলের সঙ্গেই প্রতারণা মনে হচ্ছে।
তিনি বলছিলেন, ‘আমি চাই যে, যখনই খেলব, লোকে যেভাবে প্রত্যাশা করে, নিজের প্রতি নিজের যে আশা, দল যেভাবে চিন্তা করে, সেভাবে যেন পারফর্ম করতে পারি, সেই অবস্থায় যেন যেতে পারি। হ্যাঁ, কোনো গ্যারান্টি নেই যে, সেরা অবস্থায় খেলতে নামলেও পারফর্ম করব, তবে অন্তত এটা জানতে পারব যে দেশের হয়ে পারফর্ম করার জন্য সম্ভাব্য সেরা অবস্থায় আছি। কিন্তু আমি যদি জানিই যে আমার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেখানে সময় নষ্ট করা ও অন্য একটা জায়গা নষ্ট করা এবং দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে গাদ্দারি করার মতোই বিষয় বলে আমি মনে করি।’
এই অবস্থায়ও আমরা কী সাকিবকে জোর করে মাঠে নামানোর চেষ্টা করবো? আমরা কী এতোটাই অমানবিক!