১.
চৈত্রের শেষ রৌদ্রে হাইকোর্ট এন্ডের কোনো দূর মসজিদ হতে ভেসে আসছে আজানের শব্দ। কংক্রিট সৃষ্ট তাঁবুর মধ্যেকার সবুজ গালিচায় ঘেমো শরীরে ড্রেসিংরুমে ফিরছেন একজন। গলায় একটা রুমালের মতো জড়ানো। যাকে সাথে নিয়ে ফিরছেন তিনি পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন কন্নড়ী ধ্রুপদী সঙ্গীতের রাগ যার কাছে মাথানত করে সমস্ত আক্রমণের রেওয়াজ।
যে দলটার বিরুদ্ধে খেলে ফিরছেন, যুক্তি বলছে শেষ কুড়ি বছরের সেরা দল, টানা ষোলোটা ম্যাচে জয়ের রেকর্ড। আর যে টিমটার হয়ে তিনি ফিরছেন সে টিমটা সুদূর ভবিষ্যতে খ্যাত হবে ক্যাঙারুর দেশের ঔদ্ধত্যকে চোখ রাঙিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া এক সভ্যতা নামে। কিন্তু তিনি নিজে কি হয়ে ফিরছেন?
সৌরভ গাঙ্গুলির দর্পে যে সভ্যতার স্রোতস্বিনী আরম্ভ হয়েছিল,সেই স্রোতস্বিনীর গতিপথে প্রথম নুড়ির চাদর বিছিয়ে তার গতিকে সুরক্ষিত করা ‘লক্ষ্মণরেখা’। সভ্যতার পুষ্পগন্ধী ‘সৌরভ’ শুরু হওয়ার দিন সেই পুষ্পের বাগানে যে তিনজন প্রথম মাটি দিয়েছিলেন, তাঁদের দুজনের নাম রাহুল দ্রাবিড় আর হরভজন সিং।
আর আরেকজন? সাদা-কালো সিনেমার মতো রঙচঙে লাইমলাইট থেকে চিরকালীন দূরদেশের এক মৃৎশিল্পী, যার রঙ নেই কিন্তু আছে এক তুলি যা দিয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির সভ্যতার রঙকে প্রথম ‘নীল’ রঙে রাঙিয়ে তুলেছিলেন তিনি – ভাঙ্গিপুরাপ্পু ভেঙ্কট সাই লক্ষ্মণ!
২.
৬৩১ মিনিট। ৪৫২ টা বল। আর তুলি দিয়ে আঁকা ২৮১ টা নুড়িপাথর, যে নুড়ির বাঁধ হতে জন রাইটের ভারতবর্ষ, সৌরভ গাঙ্গুলির ভারতবর্ষ স্রোতস্বিনীর মতো প্রবাহ শুরু করেছিল। ২০০৩ বিশ্বকাপের অনেক আগে ২০০১ সালের ১৪ মার্চ উড়ান দিয়েছিল একটা সভ্যতা।কলকাতার হাইকোর্ট এন্ড থেকে সিডনির নাগরিক আকাশে নীল পায়রাদের অনাবিল বিচরণে খোদিত হয়েছিল স্টিভ ওয়ার দম্ভচূর্ণের গীতিকথা।
আর সেই উড়ানের জ্বালানী ছিল এক কন্নড়ী ধ্রুপদের ১৮০ আর ছিল এক হায়দ্রাবাদী কব্জির করা ঐতিহাসিক ২৮১। সৌরভের তেজস্বী নেই, শচীনের জনপ্রিয়তা নেই, নেই দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার লিপি। কিন্তু আছে বলিষ্ঠতা, আছে অজি আক্রমণকে শুষে নীরবতার সাথে পাল্টা দেবার ঐতিহ্য, যে নীরবতা সবিনয়ে অজি ঔদ্ধত্যকে চিরকাল বলে এসেছে – ‘Penetrate The Safe Line of Hyderabad, If You Can।’
আর আছে ‘ফোর্থ ইনিংস’ নামক নাটকের শেষ দৃশ্যে শিক্ষানবিশদের নিয়ে শেষ প্লট অবধি ‘অভিনয়’ করার নিশ্চয়তা, যে অভিনয়ে নন স্ট্রাইক এন্ডের ওপারে থাকত টেল এন্ডার,আর এপাড়ে থাকত বিন্ধ্য পর্বতঘেরা ‘সেফলাইন’। লাইনটা যতক্ষণ আছে, বাঁচবে সেই সভ্যতা। যে সেফলাইনের এপাড়ে চিরকালীন রয়ে গেছে নীল সভ্যতার প্রাণ আর ওপারে অস্ট্রেলিয় গাম্ভীর্যের আগুন। আর বারবার সেই হায়দ্রাবাদি রেখা শুষে এসেছে সেই আগুনটা।
ভেঙ্কটেশ প্রসাদকে সাথে করে ফলো অনের বোঝা নিয়ে ড্রেসিংরুমে যখন এক হায়দ্রাবাদি তরুণ ঘর্মসিক্ত হয়ে এসেছিল তখন নামের পাশে নুইয়ে পড়া ভারতীয় ব্যাটিংয়ের একমাত্র জ্বলন্ত শিখার মাধুকরী ৫৯। প্যাড খুলছেন, এমন সময় পিঠে হাত রাখলেন জন রাইট। বললেন – ‘প্যাড খুলোনা। আমরা ফলো অন খেয়েছি। দ্বিতীয় ইনিংসে তুমি তিন নম্বরে নামবে। দ্রাবিড় নয়।’
জন রাইট সেদিন পড়তে পেরেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু পরবর্তী দশ বছরে সিন্ধুসভ্যতার তীরে তৈরি হয়েছিল এক শিলালিপি। যে লিপির ভাষা আজও অজানা, আজও নিস্তব্ধ। কিন্তু সেই লিপির অন্তর্নিহিতে একটার পর একটা বিছানো রয়েছে নিরাপদ চাদর, যে চাদরে বারবার ধ্বংস থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রাণ নিয়েছে সৌরভ গাঙ্গুলি-শচীন-দ্রাবিড়ের সভ্যতা।
নেপিয়ার থেকে ইডেন, মোহালি থেকে সিডনি, কতবার যে সেই হায়দ্রাবাদি লিপির নৈঃশব্দ বারবার শুষে নিয়ে গেছে ব্রেট-ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি-মার্টিনদের তার হিসাব কে রাখে! সেই শিলালিপির ইতিহাসে বিশ্বকাপ স্পর্শের স্পর্ধা নেই, ফোর্বস ম্যাগাজিনের চরিত্রগুলোর গরিমা নেই, কিন্তু আছে নীরব ভাষা যে ভাষা পড়তে পারেনি স্টিভ ওয়া-রিকি পন্টিং-মাইকেল ক্লার্করা। এই না বোঝা ভাষাটিকেই তো আমরা ‘আ ভেরি ভেরি স্পেশাল’ বলে থাকি!
‘সেদিন ইডেনের পিচে কতকগুলো রবার আছড়ে পড়ছিল,আর বারেবার একটা দেওয়ালে লেগে এমনভাবে ফিরে আসছিল, যে কোনদিকে যাবে বোঝা যাচ্ছিলনা। শেন ওয়ার্ন হলো রাবারের বলটা আর দেওয়ালটা ভি ভি এস লক্ষ্মণ’ – বক্তা স্বয়ং ইয়ান চ্যাপেল। মহেন্দ্র সিং ধোনির অপরাজিত ৯১ যদি সৌরভ গাঙ্গুলির মস্তিষ্কপ্রসূত বিকাশপথের শেষ স্টেশন হয়,তবে সেই পথটার প্রথম মাইলফলক ছিল ভিভিএস লক্ষণের অপরাজিত ২৮১।
আর খেলে যাওয়া ৬৩১ মিনিটটা কোনো সময়ের পরিমাপ ছিলনা, ছিল সেই নিরাপদরেখার পরিধি। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে লেগ স্টাম্পের বাইরে বল ফেলে যতবার সাইড স্পিন আদায় করেছিলেন ওয়ার্ন, ততবার এগিয়ে পিছিয়ে কবজির মোচড়ে স্টিভ ওয়ার দম্ভকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। চৈত্রের রোদে নিরাপদ চাদর বিছিয়ে যখন ফিরে আসছেন লক্ষ্মণ,ইয়ান চ্যাপেল জিজ্ঞেস করলেন শেন ওয়ার্নকে – ‘তুমি কি খারাপ বল করেছো?’।
উত্তরে ওয়ার্ন বলেছিলেন – ‘আমার মনে হয়না সেটা। হায়দ্রাবাদি অসাধারণ খেলেছে।’ ক্রিকইনফোর বিচারে গত পঞ্চাশ বছরের সেরা ইনিংসে প্রথম দশে নেই লারার ৪০০, নেই শচীন। আর সবার শীর্ষে আছে ওই হায়দ্রাবাদীর ২৮১। ঠিক নিচেই ইয়ান বোথাম। আসলে সুরের বিচার সংখ্যায় হয়না, হয় গরীমার বিচারে। সেদিন দ্রাবিড়ের ১৮০ যদি কন্নড়ী ধ্রুপদী সঙ্গীতে গাওয়া ‘দ্রাবিড় উৎকল’ হয়, তবে লক্ষ্মণ গেয়েছিলেন ‘ গাহে তব জয়গাথা।’
ক্যারিয়ারে বারংবার বিছিয়ে দিয়েছেন নিরাপদের চাদর, কখনও বা তুলে ধরেছেন ঈশান্ত শর্মাকে সাথে নিয়ে পিঠের ব্যাথায় কাতর হয়ে এক উইকেট জয় এনে দেওয়ার লড়াই, কিন্তু রিটায়ারমেন্টের আগে সেই মানুষটাই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বিদায়ী সিরিজ চেয়েও পাননি। তিনি সৌরভ গাঙ্গুলির শিরদাঁড়ার প্রথম বোনা অস্থি, তিনি দ্রাবিড়ীয় দেওয়ালের প্রথম খোদিত ইষ্টক, আবার তিনি মহেন্দ্র সিং ধোনির অজিবধের যন্ত্রণাশোষক স্তম্ভ,যে স্তম্ভের নীচে নিঃশ্বাস ফেলেছে টেলেন্ডারেরা, চিরকাল, চিরদিন। আর এই তিন সভ্যতাকে বেষ্টন করে থাকা ভেরি ভেরি স্পেশাল রেখাটা চিরকালীন রয়ে গিয়েছে আলোকবর্ষ দূরে।সে রেখার পরিচয় নেই, আস্ফালন নেই, আছে স্থৈর্য-আক্রমণ-রক্ষণের আশ্বাস।
যুগান্তরব্যাপী সিন্ধু সভ্যতাকে ঘিরে থাকা চিরকালীন এক লক্ষ্মণরেখা। সে রেখার কোনো অভিযোগ ছিল না। ছিল নৈশব্দের নিরাপত্তা।