কারো কাছে বিশ্বকাপ জয় করা যতটা আনন্দ আর প্রাপ্তির তার চেয়ে বেশি প্রাপ্তির আবার বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়া। সেরা দলগুলোর বাইরে এমন সমীকরণ দেখা যায় প্রায়শই। আবার যেটি দেখা গেল কানাডার বিশ্বকাপের খেলার সুযোগ পাওয়ার মধ্যদিয়ে। তিন দশকেরও বেশি সময় পর বিশ্বসেরা আসরে সুযোগ পেয়ে আনন্দ যেন বাঁধনহারা।
অনেকে আবারো কানাডার সুযোগ পাওয়াকে দেখছেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের বছর বলে! পরিসংখ্যানই মূলত এই কথা বলার পক্ষে যুত্তি দাড় করিয়ে দিয়েছে। ১৯৮৬ সালে যে বছর সর্বশেষ বিশ্বকাপে খেলেছিল কানাডা সেই আসরের শিরোপা জিতেছিল ডিয়াগো ম্যারাডোনার দল।
এরপর থেকে কানাডাও বিশ্বকাপে নেই আর আর্জেন্টিনার ভাগ্যেও শিরোপার দেখা মিলছেনা। ১৯৯০ সালের পর ২০১৪ সালের আসরের ফাইনালে খেললেও শিরোপা ছুয়ে দেখা হয়নি। তাইতো কিছুটা হাস্যখর হলেও আর্জেন্টাইন সমর্থকরা স্বপ্ন দেখছেন আবারো বিশ্বকাপ জেতার। কারণ বয়সের বিবেচনায় কাতার বিশ্বকাপই শেষ আসর হতে পারে লিওনেল মেসির। তবে এখন সবদিকে আলোচনার বিষয়বস্তু এখন কানাডার বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া।
এদিকে উত্তর ও মধ্য আমেরিকা অঞ্চল থেকে প্রথম দল হিসেবে কাতার বিশ্বকাপের টিকিট অর্জন করল কানাডা। কনকাকাফ অঞ্চলের বাছাই পর্বের চতুর্থ রাউন্ডে জ্যামাইকাকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে এই অর্জণ হয় দেশটির। কানাডার পক্ষে একটি করে গোল করে জয় নিশ্চিত করেন ল্যারিন, বুকানন ও হোয়লেট। এছাড়াও জ্যামাইকার মারিয়াপ্পা একটি আত্মঘাতী গোল করে কানাডার জয়ের ব্যবধান বাড়িয়ে দেন।
এ জয়ে ১৩ ম্যাচে ২৮ পয়েন্ট নিয়ে কনকাকাফ অঞ্চলের বাছাইপর্বে তৃতীয় রাউন্ডে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে অবস্থান করে কানাডা কাতারের টিকিট পায়। যাতে করে বিশ্বকাপের চূড়ান্তপর্বও নিশ্চিত করেছে। কানাডা দেশটির ইতিহাসে প্রথম ও শেষবারের মতো ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ খেলেছিল। সেবার তারা গ্রুপ পর্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স ও হাঙ্গেরির বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ খেলে সবকটিতে হেরে বিদায় নেয়। এবার দীর্ঘদিন পর তারা বিশ্বকাপের চূড়ান্তপর্ব নিশ্চিত করল।
ফুটবলের বৈশ্বিক আসরে প্রায় চারদশক ধরে খেলার সুযোগ হয়নি ম্যাপল পাতার দেশটির। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হয়েছে বড় জয় পাওয়ায়। জাতীয় দল বিশ্ব মঞ্চে সুযোগ পাওয়ায় আনন্দ অশ্রুতে আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি করেছিলেন বায়ার্ন মিউনিখের কানাডিয়ান ডিফেন্ডার আলফোনসো ডেভিস। ঘরের মাঠ বিএমও ফিল্ডে দারুণ ফুটবল খেলে উপস্থিত দর্শকদের আনন্দে ভাসিয়েই বিশ্ব মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছে দলটি। প্রথমার্ধে সাইল ল্যারিন ও ত্যাজন বুকানানের গোলে ২-০ তে এগিয়ে যায় কানাডা।
শেষদিকে জুনিয়র হইলেট গোল করার পর জ্যামাইকার আদ্রিয়া মারিয়াপ্পা আত্মঘাতী গোল করে দলের পরাজয় নিশ্চিত করেন। দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় আনন্দিত আলফোনসো ডেভিস মাঠেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কানাডা জাতীয় দল ও বায়ার্ন মিউনিখের এই লেফট ব্যাক অসুস্থতার জন্য গত নভেম্বর থেকে খেলার বাইরে রয়েছেন। খেলা চলাকালীয় লাইভ ভিডিও স্ট্রিম করে ম্যাচ জিতে কান্নায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আলফোনসো।
তার কাছে বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়াটা অনেক বড় সাফল্য উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি ও আমরা বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছি। বিশ্বকে বলে দিতে চাই, আমরা বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছি। মত্যি কথা বলতে কি, বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার! আমি কাঁদছি, আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলার কারণে।’
কানাডার অন্যতম সেরা ফুটবলার আলফোনসো ডেভিস কাজ করেছেন বায়ার্ন মিউনিখ কোচ জুলিয়ান নাগেলসম্যানের সঙ্গে। জার্মান দলটির কোচ সতীর্থের দেশটির বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়ার বিষয়ে বলেন, ‘আমি আশা করছি দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠছেন ডেভিস। আগামী এপ্রিলে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে তার ফিট হয়ে মাঠে নামার সম্ভাবনা রয়েছে।’
সময়ে হিসেবে ৩৬ বছ কম তো আর না। এই লম্বা সময়টাতে সারা দুনিয়াতে অনেককিছুর সৃষ্টি হলেও বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি কানাডা। বিশ্ব সেরার আসরে সুযোগ পাওয়ার পর নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে আবেগী দলটির কোচ হের্ডম্যান বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এই বিশ্বাসটা ছড়িয়ে দিয়েছি কিন্তু যখন এটা সত্যিই ঘটে গেল, তখন কেমন করে যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।’
হের্ডম্যান অবশ্য বলছেন, এখানে কেবলই শুরু হলো, ‘সবাইকে বলতে পারবো আমরা আসছি। কোচ হিসেবে এটা কত আনন্দের ব্যাপার, তা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানে’! এদিকে হার্ডম্যানের যে অর্জন করেছেন সেটি নেই মারিও জাগালো-দেল বস্কদেরও। কোচ হিসেবে মার্সেলো লিপ্পি, ভিসেন্তে দেল বস্ক কিংবা মারিও জাগালো, এই তিনজন কিংবদন্তীর সঙ্গে কেউ জন হার্ডম্যানকে রাখবেন বলে মনে হয় না!
বরং নামটা শুনেই কেউ কেউ পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, জন হার্ডম্যান আবার কে, ফুটবলে এই নাম তো আগে শুনিনি! জাগালো-দেল বস্ক-লিপ্পিদের কাতারে হার্ডম্যানকে রাখাটা তাই বড় বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। আবার এটাও তো সত্যি যে ৪৬ বছর বয়সী হার্ডম্যানের অর্জনের একটি পাতায় কিংবদন্তি এসব কোচের কারোরই জায়গা হবে না।
পরিসংখ্যান দরজায় কড়া নেড়ে জানিয়ে দিচ্ছে, কোচ হিসেবে হার্ডম্যানের এমন একটা কীর্তি আছে, যা তাঁদের কারও নেই। কী সেই কীর্তি যা নিয়ে এতটা হৈ চৈ পড়ে গেল? ইতিহাসের প্রথম কোচ হিসেবে ছেলে ও মেয়েদের জাতীয় দলকে ফিফা বিশ্বকাপের মূল পর্বে তোলার অনন্য কৃতিত্ব তার। কনকাক্যাফ অঞ্চলের বাছাইপর্বে জ্যামাইকাকে ৪-০ গোলে হারিয়ে কাতার বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে জায়গা নিশ্চিত করে নেওয়ার পরই একক কোচ হিসেবে অসামান্য এই অজর্ন করেছেন।
মেয়েদের পর কানাডার ছেলেদের দলকে আবার বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার এই টিকিট এনে দেওয়ার নেপথ্য নায়ক এই জন হার্ডম্যান। এ অর্জনের মাধ্যমেই অনন্য ওই কীর্তি গড়েছেন ফুটবলার হিসেবে নয়, ছাত্রজীবনেই কোচিং শুরু করা এই ইংলিশ কোচ। কানাডা নারী দলের কোচের দায়িত্ব ছেড়েছেন চার বছর আগে ২০১৮ সালে। যে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০১১ নারী বিশ্বকাপের পর থেকে। ২০১৫ বিশ্বকাপে তাঁর কোচিংয়ের সুফল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল কানাডা। তার আগে ও পরে ২০১২ ও ২০১৬ অলিম্পিকেও হার্ডম্যানের হাত ধরে ব্রোঞ্জ জেতে কানাডার মেয়েদের দল।
এরপরই ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে মেয়েদের দায়িত্ব ছেড়ে কানাডার ছেলেদের জাতীয় দলের কোচ হন হার্ডম্যান। তিন বছর যেতে না যেতেই তিনি এখন নতুন এক ইতিহাসের স্রষ্ঠা হিসেবে মাত করে দিয়েছেন। হয়তো তার হাত ধরে আরও বড় স্বপ্নই দেখতে যাচ্ছে কানাডিয়ানরা। সেটি বিশ্বকাপে মনে রাখার মতো কোন পারফরম্যানই হতে পারে। যেখানে তার নামে গুনগান গাওয়া শুরু হয়ে যাবে।