২০১৯ অ্যাশেজ সিরিজ। হেডিংলিতে স্টিভ স্মিথের কনকাশন বদলি হিসেবে খেলতে নামে মার্নাশ লাবুশেন। এক বছর আগে জাতীয় দলে অভিষেক হলেও নিজেকে তখনো সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি এই তরুন সম্ভাবনাময়ী তারকা। স্মিথের বদলি হিসেবে নেমেই খেললেন ৭৪ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। এরপর থেকেই বদলে যায় লাবুশেনের ক্যারিয়ারের চিত্র। দুই বছরের মাথায় লাবুশেন বনে গেলেন টেস্টে সময়ের সেরা ব্যাটার।
লাবুশের এই উঠে আসার পেছনে অনেক বড় অবদান কোচ নিল ডি’কস্টার। এই কস্টার হাত ধরেই উইকেটরক্ষক থেকে পেসার বনে যান অজি তারকা মিশেল স্টার্ক।
ভারতীয় বংশদ্ভূত নিল ডি’কস্টার জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়। কস্টার বাবা-মা চেন্নাই থেকে পাড়ি জমান তাসমান পাড়ে। এরপর সেখানেই বেড়ে ওঠা কস্টার। সেখানেই দেখা হয় বর্তমানের টেস্টের সেরা ব্যাটার অজি তারকা মার্নাশ লাবুশেনের সাথে। কুইন্সল্যান্ডের এক কোচ ব্লেয়ার কপেলিন ছিলেন কস্টার বেশ ভাল বন্ধু। তাঁ র মাধ্যমেই লাবুশেনের সাথে কস্টার পরিচয় হয়। ব্লেয়ার একদিন কস্টাকে বলেন, ‘একটা তরুণ ছেলেকে একবার দেখে যাও, নাম মার্নাশ। অন্যদের চেয়ে সে বেশ আলাদা।’
এক সাক্ষাৎকারে কস্টা বলেন, ‘এটা শোনার পর আমি কুইন্সল্যান্ড ও নিউ সাউথ ওয়ালসের মধ্যকার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের একটি ম্যাচ দেখতে গেলাম। আমি দেখলাম ডিপ স্কোয়ার লেগ থেকে একটি ছেলে লেগ বিফোরের আবেদন করছে। আমি আমার বন্ধুকে ডাকলাম। বললাম এই কি তোমার সেই ছেলে? যে ছেলেটা বাউন্ডারি লাইন থেকে লেগ বিফোরের জন্য আম্পায়ারের কাছে আবেদন জানাচ্ছে?’
সবশেষ অ্যাশেজ সিরিজের আগে গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে লাবুশেন বলেছিলেন কিভাবে কস্টা তাঁর ব্যাটিংয়ে অবদান রেখেছেন। লাবুশেন বলেছিলেন, ‘ওই গ্রেড পর্যন্ত আমি খুব ভাল খেলোয়াড় ছিলাম। আমি বলবো না যে আমি সেরা ছিলাম। আমি বেশ দৃঢ় ছিলাম। আমি অনেক বল খেলতাম। আমি সবকিছু সঠিকভাবে করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এরপরই দেখা যেত আমি অনেক কিছু ভুল করে বসতাম। কস্টার সাথে দেখা হবার পর সম্ভবত প্রথমবার আমি স্বাধীনভাবে খেলাটা শিখেছি।’
অনূর্ধ্ব ১৯ এর ওই ম্যাচের পর অল্প কিছু সময় কস্টার সাথে কাটান লাবুশেন। এরপরই ব্রিসবেন থেকে সিডনির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান কস্টা। হঠাৎ করেই কস্টার ফোন বাজতে লাগলো। লাবুশেনের ফোন! কস্টার সাথে কাজ করতে চান লাবুশেন। তবে ডি’কস্টা কেন যেন রাজী ছিলেন না।
কস্টা বলেন, ‘বিশেষ কোনো কারণে তখন আমি কোচিং করাতে রাজি ছিলাম না। তাই আমি তাকে কোনো না কোনো কারণ দেখাতে লাগলাম। কিন্তু সে একপ্রকার নাছোড়বান্দা। সে আমার পেছনে লেগে ছিল। আমি বললাম ঠিকাছে। যদি আমার সাথে কাজ করতে চাও তাহলে আমার মতো করেই করতে হবে। এটা মোটেও সহজ হবে না। সেও দ্রুত আমার কাছে চলে আসে।’
কস্টা বলেন, ‘আমি শারীরিক, মানসিক, টেকনিক্যাল এবং ইমোশনাল – এই চার জায়গা নিয়ে কাজ করতে চেয়েছি। শারীরিক ভাবে সে ঠিক থাকলেও তাঁকে আরও শক্তিশালী করতে চেয়েছিলাম আমরা।’
- বিরাটের অদৃশ্য হাত
তরুন লাবুশেনের লেগ সাইডে খেলতে খুব সমস্যা হতো। ডি’কস্টা বলেন, ‘সে লেগ সাইডে খেলতে ভয় পেত। তার ভয় ছিল লেগে মারতে গেলে এলবিডব্লিউ হতে পারে।’ লাবুশেন বলতেন, ‘আমি আউট হতে চাই না। আমি আউট না হওয়ার জন্য সবকিছু করতে চাই। আউট হওয়ার এই ভয়টা আমার মধ্যে কাজ করতো।’
ডি’কস্টা বলেন, ‘আমি মার্নাশকে শিখিয়েছি কিভাবে লেগ সাইডের বল খেলতে হবে। বোলাররাও লেগ সাইডে বল করে তাঁকে লেগে খেলতে বাধ্য করছিল। সে লেগ বিফোর আউট হওয়ার ভয়ে ছিল। সে বলছিল আমি হয়তো মিস করবো এবং এলবিডব্লিউ হবো। আমি তাঁকে বললাম যদি সে লেগ সাইডে না খেলে তাহলে সে রান বাড়াতে পারবে না। এবং তোমাকে তোমার রানের রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বাস করো আমাকে এবং এটা নিয়ে কাজ করো। এরপরই ধীরে ধীরে সে বিরাটের সেই অফ সাইড থেকে লেগ সাইডে টেনে খেলার মতো করে শট মারতে শিখলো। এখন কেউ বলবে লেগ সাইডে তাঁর দূর্বলতা আছে?
- চিনির প্রতি দূর্বলতা
লাবুশেনের চিনির প্রতি দূর্বলতা ছিল বেশ। মিষ্টিজাতীয় খাবার পছন্দ করতেন। খেলার প্রতি মনোযোগ কিংবা কঠোর পরিশ্রম সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল লাবুশেনের কিন্তু চিনি ছাড়াটা মোটেও সহজ ব্যাপার ছিল না তাঁর জন্য।
‘আমি তাঁকে বললাম তুমি এমন করতে পারো না। কিন্তু সে বললো সে এটা পছন্দ করে। আমি তাকে বললাম এটা শারীরিকভাবে তোমার ক্ষতি না করলেও ব্রেইনের জন্য ভাল না। তুমি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাবে। এটা ছেড়ে দেওয়া ভাল। তুমি জানতে চেয়েছিলেনা বড় বড় খেলোয়াড়দের আচরণ কেমন? তাদের মনের প্রতি তাদের নিয়ন্ত্রণ আছে। এরপর সে চিনি খাওয়া ছেড়ে দেয়।’
এছাড়া মানসিকভাবে ফিট থাকার জন্য কোচ অ্যালান মেন্টলের সাথেও কাজ করেন লাবুশেন। তিনি সবসময়ই চাইতেন ক্রিকেট মাঠে নিজের সেরাটা দিতে আর এর জন্য যা যা করা প্রয়োজন সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন লাবুশেন।
মার্নাশের নাম ধীরে ধীরে ক্রিকেট পাড়ায় পরিচিত হতে লাগলো। ২০১৪ সালে ডি’কস্টা একবার সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে মেসেজ বার্তায় বলেন, ‘তোমার রেকর্ডটি হুমকির মুখে! যেকোনো সময় এটি ভেঙে ফেলতে পারে কেউ।’ নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কেন ক্রিকেট প্রিমিয়ার লিগ ডিভিশনে এক মৌসুমে ১ হাজারের বেশি রান করেন। ল্যাঙ্গার কস্টাকে বলেন, ‘এই রেকর্ড কেউই ভাঙতে পারবেন না।’ এরপরই কস্টা আরেক মেসেজ বার্তায় ল্যাঙ্গারকে বলেন তোমার রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে দেখো।’
অ্যাশেজ সিরিজে কনকাশন বদলি হিসেবে এসে ক্যারিয়ারের শুরু। কস্টা বলেন, ‘আমরা প্রস্তুত ছিলাম ওই সিরিজে সে সুযোগ পাবে। যদিও এভাবে ভাবিনি। তবে আপনাকে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে কখন আপনার সুযোগ আসে। যখন তাকে বলা হলো বদলি হিসেবে নামতে হবে। আমি জানতাম সে প্রস্তুত। এরপর তো পুরো ক্রিকেট দুনিয়াই সেটা দেখলো। ওই রাতে আমি তাঁকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম জোফরা কেমন ছিল? সে আমাকে উত্তর দিল বজ্রের মতো! সে বললো জোফরাকে সে উপভোগ করেছে বেশ।’
লাবুশেন বর্তমান সময়ের সেরা ব্যাটার তিনি। যদিও টার্নিং উইকেটে এখনও পরীক্ষা দিতে হয়নি এই তারকাকে। পাকিস্তানের ফ্ল্যাট উইকেটে খুব বেশি ভাল সময় কাটিয়েছেন এমনও নয়। ২০২৩ সালের শুরুতে ভারত সফরে টেস্ট সিরিজের জন্য আসবে অস্ট্রেলিয়া। ভারতের মাটিতে টার্নিং উইকেটে কেমন করবেন তিনি? এমন প্রশ্নের জবাবে কস্টা বলেন, ‘এর জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। আমি জানি সে পারবে। ওই পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। অশ্বিন, জাদেজা, অক্ষরদের বিপক্ষে সে ভাল খেলবে। চিন্তার কারণ নেই।’