সুঠাম দেহ, চওড়া কাঁধ, ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এক দীর্ঘকায় মানুষ। বাইরের রুক্ষতা দেখে নিশ্চয়ই ভেতরের মানুষটাকে আন্দাজ করে নেওয়া যায় না। আন্দ্রে নেল ক্রিকেট মাঠেই কান্না করে দিলেন। তাঁর ছোড়া এক বাউন্সারের আঘাত পান দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের কিংবদন্তি অ্যালান ডোনাল্ড। এমনকি তাঁকে মাঠ ছেড়েও উঠে যেতে হয়। আর নিজের ছোড়া বলে ডোনাল্ডের এমন পরিণতি দেখে নিজেকে আর সামলে নিতে পারেননি আন্দ্রে নেল।
গতির সাথে সখ্যতা ছিল তাঁর। ক্রিকেট জীবনে গতিতেই কাবু করেছিলেন প্রতিপক্ষের বাঘা বাঘা ব্যাটারদের। সুঠাম দেহি এই গতি তারকা জন্মেছিলেন ১৯৭৭ সালের ১৫ জুলাই। তাঁর শারীরিক গঢ়ন দেখে যে কারোরই হয়ত মনে হতে পারে যে তিনি একজন রাগবি খেলোয়াড়। হয়ত চাইলে তিনি একজন রাগবি খেলোয়াড়ও হতে পারতেন। সক্ষমতা ছিল। আর তাছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেক্ষাপটে ক্রিকেট অপেক্ষা রাগবি বেশ জনপ্রিয়। তবে জনপ্রিয়তা তাঁকে টানেনি।
টেনেছে বাইশ গজ বিস্তৃত শক্ত মাটি। যে মাটির রুক্ষতা আবেগ দিয়ে মোড়া। ঠিক নেলের উল্টোটা। বাইশ গজে আগ্রাসনে নেল যেমন পুড়িয়েছেন তেমন নিজেও পুড়েছেন। নিজের আবেগ কখনোই ঠিক ছিল না তাঁর অধীনে। হাত ফসকে যেত বারেবারেই। আর নিজেকে আবিষ্কার করতেন ভিন্নসব বিতর্কে। ২০০১ সালে তিনি প্রথমবারের মত প্রোটিয়া জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন।
নিজেকে একজন ভাগ্যবান হিসেবেই দাবি করতে পারেন তিনি। ২৪ বছর বয়সে যখন তিনি এলেন জাতীয় দলে তখন সেই দলে ছিলেন শন পোলক, মাখায়া এনটিনিদের মত কিংবদন্তি গতিদানব। এদের মত কিংবদন্তি বোলার থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের ছাপ ঠিকই ফেলে যেতে পেরেছিলেন প্রোটিয়াদের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
পোলক যেখানে ভরসা করতেন তাঁর লাইন লেন্থের উপর, এনটিনি তাঁর বোলিং অ্যাকশনের কারণে সৃষ্টি হওয়া অ্যাঙ্গেল ব্যবহার করে প্রতিপক্ষে ব্যাটারদের বিপাকে ফেলতেন। তখন নেলের প্রধান অস্ত্রই ছিল গতি। পরাস্ত হওয়া যেন অবধারিত।
তবে নিজের আবেগকে সংবরণ করতে না পারার অদক্ষতা তাঁকে বিভিন্ন সময় ঠেলে দিয়েছে বিতর্কের মাঝে। নিজের অবিষেকের বছরেই নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হন নেল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গাঁজা সেবনের দায়ে পাঁচ জন ক্রিকেটারকে শাস্তি দেওয়া হয় প্রোটিয়া ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে। সে পাঁচ জনের একজন ছিলেন আন্দ্রে নেল। আবার ২০০৩ সালে মদ্যপ অবস্থায় তাঁকে পাওয়া যায় গাড়ি চালাতে। এমন সব কাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন নেল।
তবে নিজের পারফরমেন্সে কখনোই প্রভাব ফেলতে দেননি তিনি। ২০০৩ সালের সে মদ্যপ অবস্থার বিতর্কের পরও তিনি ইংল্যান্ডগামী দক্ষিণ আফ্রিকা দলে জায়গা পেয়ে যান। সে বছরের শেষের দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের আগে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আর ঘরের লক্ষ্মী হয়ে আসেন তাঁর স্ত্রী। আর নেলের পারফরমেন্সও পায় নতুন মাত্রা। ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২২ উইকেট নিয়ে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রাখতে শুরু করেন নেল। তবে দুর্ভাগা আন্দ্রে নেল।
যখনই তিনি জাতীয় দলে থিতু হতে শুরু করেন তখনই ইনজুরি এসে হাজির হয়। কোমরের ইনজুরিতে তিনি মাঠের বাইরে চলে যান কিছুদিনের জন্য। তবে তাঁর মধ্যে থাকা অদম্য শক্তি এবং নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার স্পৃহা তাঁকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করায়নি।
প্রত্যাবর্তনে আবারও নিজের দ্যুতি ছড়ালেন নেল। ২০০৫ সালে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে তিনি ফেরেন মাঠে। সে সিরিজেই ১৫ উইকেট নিয়ে জানান দেন তিনি অপ্রতিরোধ্য, তিনি অদম্য। সে সিরিজেই তিনি প্রথমবারের মতো নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ফাইফার তুলে নেন।
ব্রায়ান লারাকে নিজের বানিতে পরিণত করেছিলেন তিনি। সেটাই হয়ত তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল চিত্র। ব্রায়ান লারাকে নিয়ে নতুন করে বলবার কিছু নেই। তিনি জগৎজোড়া, তিনি বিশ্বনন্দিত, তিনি কিংবদন্তি। তাঁর মত ব্যাটারকে গুণে গুণে আট দফা আউট করে প্যাভিলনের পথ দেখিয়েছেন নেল। লারার দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই তিনি এক টেস্টে দশ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েন প্রথমবার। টেস্ট, ওয়ানডেতে নেল পারফর্ম করেছেন সমানতালে।
৩৬ টেস্টে ৩১.৮৬ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ১২৩টি। রঙিন পোশাকে তিনি গতির রঙ ছড়িয়েছেন ২০০৬ সালে। সেবছর ১৭ ওয়ানডেতে তিনি নিয়েছেন ২৯টি উইকেট। তাছাড়া পুরো ক্যারিয়ারে ৭৯টি ওয়ানডে খেলে ১০৬টি উইকেট নিয়েছেন তিনি ২৭.৬৮ গড়ে। রঙিন পোশাকে মনে রাখার মত পারফর্ম করেছিলেন ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপে। বাংলাদেশের বিপক্ষে ৪৫ রান খরচায় নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট। আন্দ্রে নেলের ক্যারিয়ার সেরা বোলিং পারফরমেন্সের পরও সেদিন হেরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
খানিকটা দেরিতে শুরু হওয়া ক্যারিয়ারটা খুব বেশি লম্বা হয়নি। বিতর্ক, ইনজুরি ছাপিয়ে তাঁর ক্যারিয়ার সংক্ষিপ্তের অন্যতম কারণ হয়ত সে সময় স্ফুলিঙ্গ হয়ে আবির্ভূত হওয়া আরেক গতি তারকা ডেল স্টেইন। ২০০৮ সালে শেষবার বাইশ গজে নেমেছিলেন নেল। এরপর খেলোয়াড়ি পাট চুকিয়ে দিব্যি মন দিয়েছেন কোচিং ক্যারিয়ারে।
আন্দ্রে নেল আগুন ঝড়িয়েছেন। বাইরের রুক্ষতায় ভয় ধরিয়েছেন। আবার ভেতরের এক শিশু নেল চোখ ভিজিয়েছেন ক্রিকেটে সবুজ গালিচায়। বৈচিত্র্যময় এক গতিদানব আন্দ্রে নেল নিজের সেরাটা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টাটা করেছেন। তা করতে গিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকার ১১তম বোলার হিসেবে ছাড়িয়েছেন ১০০ টেস্ট উইকেটের মাইলফলক।