ক্ষনিকের বাঁ-হাতি জাদুকর

যুগ যুগ ধরেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে বাঁহাতি শব্দটার প্রচলন সবচেয়ে বেশি। ব্যাটার থেকে শুরু করে পেসার কিংবা স্পিনার – সব দিক থেকেই বাঁহাতিদের আখড়া বলা চলে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে। বাঁহাতি স্পিনার যেন অলিগলিতেই মিলবে জনা কয়েক। মোহাম্মদ রফিক, আব্দুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসানরা – বাঁ-হাতি স্পিনেই নিজেদেরকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।

সাকিব-রাজ্জাকদের মতই আরও বহু বাঁহাতি স্পিনার এসেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে। কিন্তু তাদের কত কেউই আর নিজেদের ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারেনি। কেউ হেলায় হারিয়েছেন তো কেউ পারফরম্যান্সের ঘাটতিতে – একসময় বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে বাঁহাতিদের ছড়াছড়ি হলেও এখন আর তেমনটা দেখা মিলে না।

ইলিয়াস সানি, মোশাররফ হোসেন রুবেলরা আশা জাগালেও টিকতে পারেননি বেশি সময়। ইলিয়াস-রুবেলদের মতই আশা দেখিয়ে জাতীয় দলে এসেছিলেন আরেক সম্ভাবনাময় তারকা – আরাফাত সানি। নিঁখুত লাইন-লেন্থে বল করতে পারেন, অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে ব্যাটারকে মারার সুযোগ কম দেন, ইকোনমিক বোলিংয়ের পাশাপাশি উইকেটও শিকার করতেন – সব মিলিয়ে সানিকে নিয়ে বড় স্বপ্নই দেখেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা।

মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। এই ফরম্যাটে শিকার করেছে ছয়শোর বেশি উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে ২০১১-১২ মৌসুমে মাত্র ২০.৩৫ গড়ে নিয়েছিলেন ৫০ উইকেট। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর পেলেন অপ্রত্যাশিত এক পুরষ্কার। প্রথমবারের মত সুযোগ পেলেন জাতীয় দলে।

হুট করেই এসেছিলেন জাতীয় দলে। ঘরোয়া লিগের পারফরম্যান্স তাঁকে টেনে নিয়ে আসে জাতীয় দলের মঞ্চে। রাজ্জাক, সাকিবদের মত অভিজ্ঞ তারকাদের ভীড়েও ঠিক জায়গা করে নেন সানি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে জাতীয় দলের সবুজ গালিচায় পদার্পণ।

চট্রগ্রামে লঙ্কানদের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি অভিষেকেই নেন দুই উইকেট। দুই ম্যাচে বেশ কিপটে বোলিং করেন তিনি। ওই সিরিজেই ওয়ানডেতেও অভিষেক হয় সানির। খুব বেশি উইকেট না পেলেও কিপটে বোলিংয়ে নজর কাড়েন সবার।

একই বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও সুযোগ পান। পর পর দুই ওয়ানডেতেই শিকার করেন চার উইকেট। প্রথম ম্যাচে ২৯ রানে ৪ উইকেটের পর দ্বিতীয় ম্যাচে ২৭ রানে নেন ক্যারিয়ার সেরা ৪ উইকেট। পরের বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে এক ম্যাচে শিকার করেন তিন উইকেট। ভারত, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরের সিরিজেও সুযোগ পান। গন্ডায় গন্ডায় উইকেট না মিললেও রান দিতেন না খুব বেশি। রানে দেওয়ার দিক থেকে ছিলেন বেশ কৃপণ।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ভাল পারফরম্যান্সের পরেও ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়লেন। বাদ পড়লেন বললে ভুল হবে; অবৈধ বোলিং অ্যাকশনে ক্যারিয়ার থমকে গেল। ২০১৬ আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সুযোগ পান সানি। কিন্তু তখনই বাঁধে বিপত্তি। অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের জেরে নিষিদ্ধ হলেন তিনি। অ্যাকশনে খানিকটা বদল এনে পুনরায় শুরু করলেন।

তবে জাতীয় দলের যাত্রাটা শেষ। আর ফিরতে পারেননি তিনি। বেশ কিছু তরুণ উঠতি ক্রিকেটারের সাথে প্রতিযোগিতায় আর পেরে উঠেননি তিনি। ফেরার পর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও (বিপিএল) পারফরম্যান্স ছিল সাদামাটা। রান খরুচে ছিলেন প্রায় ম্যাচে; স্বভাবসুলভ বোলিংয়ের দেখা মিলছিল না। ধীরে ধীরে সেই জায়গায় উন্নতি করেন। ঘরোয়া লিগ বলেন আর বিপিএল – আবার সেই কিপটে বোলিং আর উইকেটের দেখা মিলল সানির বলে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে বল হাতে পার করলেন দুর্দান্ত সময়। মাত্র ২৫.৮৩ গড়ে নেন ৩১ উইকেট।

এখনও তিনি নিয়মিত মুখ ঘরোয়া ক্রিকেটে। তবে এক ঝাঁক তরুণ স্পিনারের ভীড়ে নিজের জায়গাটা আর জাতীয় দলে দেখেন না তিনি। স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই, স্বপ্নটা হয়ত দেখছেন তিনি। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে এই স্বপ্ন পূরণের যে বিন্দুমাত্র আর সম্ভাবনা নেই সেটাও তিনি জানেন।

মাত্র ১৬ ওয়ানডে আর ৩১ টি-টোয়েন্টিতে সানির ক্যারিয়ার আপনি বিচার করতেই পারেন। পরিসংখ্যান বিচারে সানি গড়পড়তা মানের এমনটাও বলার সুযোগ নেই। নিঁখুত লাইন-লেন্থের কারণে ব্যাটাররা সহজে তাঁকে বাউন্ডারি হাঁকাতে পারত না। সানি সুযোগ যে খুব বেশি পেয়েছেন এমনও না। ফেরার একটা সুযোগ হয়ত ছিল! কিন্তু নারী কেলেংকারিতে জড়িয়ে সেই সুযোগও নষ্ট করে ফেলেন এই বাঁহাতি স্পিনার। আপাতত ঘরোয়া ক্রিকেটকেই আপন করে রেখেছেন তিনি। বিদায়ের মঞ্চটাও হয়ত এটাই হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link