ব্যাট-বল ও ব্যালট

ক্রিকেটের সাথে রাজনীতি না মেশানোই ভাল – এমন বচন প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু আদতে কি তাই? ক্রিকেটের সাথে রাজনীতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঠিক জড়িয়ে আছে। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতি যাওয়ার গল্প কম নেই।

বহু ক্রিকেটার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে রাজনৈতিক অঙ্গনে পা দিয়েছেন। কেউ কেউ তো প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পেয়েছেন। ক্রিকেটের সাথে রাজনীতি কোনো না কোনো ভাবে ঠিক জড়িয়ে আছে।

বব হক, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এক সময়

সাবেক অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী বব হক নেতা হিসেবে বিশ্বব্যাপি বেশ সমাদৃত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টির এই নেতা কখনোই ভোটে হারেননি। অস্ট্রেলিয়ার জনমানুষের বেশ প্রিয় মুখ ছিলেন। তবে সবকিছুর বাইরে তিনি ছিলেন এক ক্রিকেটপাগল। ক্রিকেটের প্রতি ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক।

রবার্ট মেনজিস – যিনি অস্ট্রেলিয়ায় প্রাইম মিনিস্টার’স ইলেভেন গঠন করেছিলেন; ওই দলে ডন ব্র‍্যাডম্যানও খেলেছিলেন। এই প্রাইম মিনিস্টার ইলেভেনের হয়ে খেলতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বব হক। সিডনির হয়ে বেশ কিছু সময় ক্রিকেট খেলেছেন তিনি। মূলত উইকেটরক্ষক হিসেবেই খেলেছেন ক্যারিয়ারে।

পালওয়ানকর বালু

১৯৮৪ সালে এক ম্যাচে ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা। পার্লামেন্ট দলের সাথে প্রেসের এক ম্যাচে বল লেগে ডান চোখে বেশ আঘাত পান বব; আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে বেশ কয়েকটি সেলাইও পড়ে। কিন্তু ব্যান্ডেজ চোখে নিয়েই ম্যাচ দেখতে মাঠে বসে পড়েন বব।

ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে অনেকেই ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর রাজনীতিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। শচীন টেন্ডুলকার, গৌতম গম্ভীর সহ অনেকেই এখন রাজনীতি করছেন। ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার সিবি ফ্রাই ক্রীড়াঙ্গনে লম্বা সময় বিচরণের পর নাম লেখান রাজনীতিতে।

হারারেতে ক্রিকেট খেলার আগে প্যাড পরছেন নওয়াজ শরীফ

ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট, ফুটবল, রাগবিসহ হাই জাম্প, লং জাম্পেও তিনি ছিলেন বেশ পরিচিত এক মুখ। অভিনয়ও করেছেন। তিনি সত্যিকারের এক সব্যসাচী। যদিও, রাজনীতিতে অবশ্য চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি তিনি।

বেশ কয়েকবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ালেও জয়ী হতে না পেরে অবশেষে হার মেনে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।

বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র প্রধানমন্ত্রী – ইমরান খান

পাকিস্তান একমাত্র এশিয়ার দেশ যেখানে দুইজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সাবেক ক্রিকেটার। সাবে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ক্রিকেটার হিসেবে জনপ্রিয়তা বেশি হওয়ায় তিনি সবার জন্যই পরিচিত এক মুখ। এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছেন। অবশ্য রেলওয়েসের হয়ে নিজের খেলা একমাত্র ওই ম্যাচটিতে শূন্য রানে আউট হন এই ডান হাতি ব্যাটার।

২০১৩ সালে ইমরান খানের বিপক্ষে ভোটে জয় পান নওয়াজ। এরপর ২০১৮ সালে নওয়াজকে হটিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি। বব হক, জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবেদের সাথে একটি তিন ওভারের ম্যাচেও খেলেছিলেন শরিফ।

মাধবরাও সিনডিয়া

একসময় ভারতের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল মাধবরাও সিনডিয়ার। তিনি অবশ্য প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি; রেইলওয়েস অব ইন্ডিয়ার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গোয়ালিওর থেকে আসা মাধবরাও অক্সফোর্ড স্কুল থেকে পড়াশোনা করেন।

মাধবরাও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলছিলেন কিছু সময়। পরবর্তীতে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ – তিন বছর পর্যন্ত তিনি বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৫৬ বছর বয়সে এক বিমান দূর্ঘটনায় তিনি মারা যান।

ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ডগলাস হোম

১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন ক্লিমেন্ট অ্যাটলি। কখনো ক্রিকেট না খেললেও ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক আর ভালবাসা দুটোই ছিল। একটি খবরের মেশিন বসিয়েছিলেন – যার মাধ্যমে তিনি কাউন্টি ক্রিকেটের খবর জানতেন।

অ্যালেক ডগলাস একমাত্র ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন যিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছেন। মিডলসেক্স, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি সহ মোট ছয়টি দলের হয়ে তিনি ক্রিকেট খেলেছেন। ১৯৬৩-৬৪ – মাত্র এক বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্বে ছিলেন।

সিবি ফ্রাই (সবার বাঁয়ে), নির্বাচনের আগে ব্রাইটন থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাচ্ছেন

১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জন মেজরও কিছু সময় ক্রিকেট খেলেছেন। ২০০০ সালে সারে ক্রিকেট ক্লাবের প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৭ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেব দায়িত্ব শেষ হয় তিনি বিদায়ী ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি আশা করি আমি এবং নর্মা (স্ত্রী) বাচ্চাদের নিয়ে ওভালের লাঞ্চ করবো এবং বিকেলে কিছু সময় ক্রিকেট উপভোগ করবো।’

২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ শেষে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে কিছু সময় দলের বাইরে ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি মুর্তজা। এরপর নির্বাচনে অংশ নিজ জেলা নড়াইলে এমপি পদে নির্বাচিত হন। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে (অবসরের আগে) পার্লামেন্টের সদস্য হন মাশরাফি। নির্বাচনে ৯৬ শতাংশ ভোট পান সাবেক এই অধিনায়ক।

নির্বাচনী প্রচারণায় মাশরাফি, তখনও তিনি ওয়ানডে দলের অধিনায়ক।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক পেস বোলার লিয়ারি কন্টেস্টাইন প্রায় পাঁচ বছর খেলেছিলেন জাতীয় দলের হয়ে। এরপর আরও ভাল ক্যারিয়ার গড়তে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। পরবর্তীতে আবার ফিরে এসে যোগ দেন রাজনীতিতে। শ্রম মন্ত্রনালয়ে নিযুক্ত হন তিনি।

১৯৬১ সালে তিনি ব্রিটেনের হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬৯ সালে প্রথম ‘ব্ল্যাক ম্যান’ হিসেবে হাউজ অব লর্ডসে বসার গৌরব অর্জন করেন সাবেক এই ক্রিকেটার।

লিয়ারি কন্টেস্টাইন, হাউজ অব লর্ডসের সামনে, ১৯৬৬ সালে।

রাজনীতি আর ক্রিকেট মিলে একাকার হওয়া দেশটার কথা তো বলাই হল না। সেই দেশটা হল শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার রানাতুঙ্গা পরিবার ক্রিকেটের মত রাজনীতিতেও বেশ জনপ্রিয়। একই সাথে খানিকটা সমালোচিতও। রানাতুঙ্গারা তিন ভাই ক্রিকেট খেলেছেন, রাজনীতিও করেছেন।

এখানে সনাথ জয়াসুরিয়ার নামটা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনিও রাজনীতির ময়দানে এসেছিলেন তিনি। সংসদ সদস্যও বনে যান। তিনিও মাশরাফির মত খেলা আর রাজনীতি এক সাথেই কিছুদিন চালিয়ে গেছেন।

তাঁকে কে না চেনে? তিনি অর্জুনা রানাতুঙ্গা।

ভিন্ন একটা তথ্য দিয়ে লেখার ইতি টানি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার মধ্যে অনুষ্ঠিত ঢাকা টেস্টের তৃতীয় দিন শেষে ২৯ ডিসেম্বর বিরতি ছিল। কারণ, সেদিন ছিল বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের কারণে এর আগে-পরে টেস্ট ম্যাচে বিরতি দেওয়ার আর কোনো নজীর নেই।

– ক্রিকেট মান্থলি অবলম্বনে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link