দ্য বিগ গ্লাভস

সত্তরের দশকে অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, গর্ডন গ্রিনিজ, ভিভ রিচার্ডসদের নিয়ে গড়া দলটা ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করেছিল। ক্যারিবিয়ানদের এই পেস দাপটের সামনে প্রতিপক্ষ ছিল অসহায়। এই দলটায় তখন উইকেটরক্ষক হিসেবে আসেন তরুণ ডেরেক মারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ংকর এই পেস বিভাগকে উইকেটের পেছনে তিনি দারুণভাবে সামলেছেন। মারেকে বলা হয় জ্যাকি হেন্ড্রিকস ও কিংবদন্তি ক্যারিবিয়ান উইকেটরক্ষক ব্যাটার জেফ ডুজনের ক্যারিয়ারের সংযোগ মানব।

স্বভাবগত দিক থেকে ছিলেন খুব শান্ত আর ভদ্র। উইকেটের পেছনে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। গ্লাভস হাতে ক্যাচ মিস কিংবা বল মিস করাটা মোটেও মারের মাঝে ছিল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিধ্বংসী পেসারদের সামনে উইকেটের পেছনে ক্যারিয়ার জুড়ে মারে ছিলেন ত্রুটিহীন। ভুল শব্দটা যেন মারের জন্য ছিল না। উইকেটের পেছনে অনায়াসে লুফে নিতেন দুর্দান্ত সব ক্যাচ। রবার্টস, গার্নারদের বল সামলেছেন অনায়সেই।

অনেকটা তরুণ বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসেন। প্রতিভা কিংবা সামর্থ্যের কমতি ছিল না। গ্লাভস হাতে ছিলেন দুর্দান্ত। ক্রিকেট ক্যারিয়ার থেকে যখন বিদায় নেন – তিনি ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে উইকেটরক্ষক হিসেবে সর্বোচ্চ রান ও ডিসমিসালের মালিক। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৮৪৮ ডিসমিসাল ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের রেকর্ড তার নামে আছে। ইংলিশ ক্রিকেটারের বাইরে অস্ট্রেলিয়ার রডনি মার্শের পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডিসমিসালের মালিক তিনি।

পোর্ট অব স্পেনে জন্ম ডেরেক মারের। বাবা ল্যান্স হ্যামিল্টন মারে ছিলেন পঞ্চাশের দশকে ত্রিনিদাদের ক্রিকেটার। ডেরেকের কাজিন ভাই কলিন এভারটন মারেও পরবর্তীতে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড তোবাগোর হয়ে খেলেন। এছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়েও খেলার সুযোগ পান তিনি।

ডেরেক অবশ্য স্কুল জীবনেই ত্রিনিদাদের হয়ে খেলার সুযোগ পান। ক্যারিয়ারের শুরুতে ব্যাটার হিসেবে তিনি নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। ধীরে ধীরে ত্রিনিদাদের উইকেটরক্ষক হিসেবে আবির্ভাব হয়ে ডেরেকের।

১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক। তবে পুরো সিরিজে ব্যাট হাতে ছিলে সাদামাটা। তবে উইকেটকিপিংয়ে প্রমাণ করেছিলেন নিজের দক্ষতা। ওই সিরিজে উইকেটের পেছনে ২২ ক্যাচ ও ২টি স্টাম্পিং করেন তিনি। এক সিরিজে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের রেকর্ড গড়েন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। বর্তমানে ২৯ শিকার নিয়ে এই রেকর্ড আছে অস্ট্রেলিয়ার ব্র‍্যাড হাডিনের নামে।

ত্রিনিদাদের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দেখা পান মেইডেন সেঞ্চুরির। ঘরোয়া ক্রিকেটে রান বন্যায় ভাসাচ্ছিলেন ডেরেক। তবে ইনজুরি আর অফ ফর্মের কারণে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। প্রায় পাঁচ বছর পর ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্ম করে ১৯৬৮ সালে ফেরেন জাতীয় দলে। এবার পাঁচ ম্যাচে করলেন মোটে ১০৪ রান; উইকেটের পেছনে ছিলেন অসাধারণ। তবু বাদ পড়লেন দল থেকে। এবার আবারও পাঁচ বছর সাদা পোশাকে ফিরতে পারলেন না।

এরপর কাউন্টিতে ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে খেলা শুরু করেন তিনি। জাতীয় দলে রানের ফোয়ারা ছোটাতে না পারলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাট হাতে ছিলেন উড়ন্ত ফর্মে। বিশেষ করে উইকেটকিপিং দক্ষতার কারণে ব্যাট হাতে বাজে পারফর্ম করলেও দলে টিকে যেতেন তিনি।

১৯৭৩ সালে আবার জাতীয় দলে ফেরেন তিনি। যদিও হেন্ড্রিকসের কাছে বেশ কয়েকবার জায়গা হারান ডেরেক। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেবার ওভাল টেস্টে ৯০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন ডেরেক। ডেরেকেরে অসাধারণ এক ইনিংসে ওই টেস্ট ড্র করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

দশ বছরে মাত্র দশ টেস্ট খেলার পর অবশেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের একাদশে জায়গা পাকা হয় ডেরেকের। অবশ্য এই দশ টেস্টের সবক’টি খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেবার ২-০ তে সিরিজ জয় করে ক্যারিবীয়রা। ডেরেকও নিজের জায়গাটা পাকা করে ফেলেন।

রবার্টস, বার্নার্ড জুলিয়ান, ভ্যানবার্ন হোল্ডারদের সামনে ভারত ও পাকিস্তান সফরে উইকেটের পেছনে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন ডেরেক। ভার‍তের বিপক্ষে ওয়াংখেড়েতে খেলেন ৯১ রানের ইনিংস।

অনেকটা বিস্ময়কর ভাবে ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপের প্রথম আসরে ক্লাইভ লয়েডের ডেপুটি হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দায়িত্ব পান ডেরেক মারে। সেবার পাকিস্তানের বিপক্ষে এজবাস্টনে ডেরেকের ব্যাটেই ম্যাজিকেও জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ডেরেকের অপরাজিত ৬১ রানে শেষ উইকেটে রোমাঞ্চকর এক জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেবার প্রথম আসরেই শিরোপা জয় করে ক্যারিবীয়রা।

ক্যারি প্যাকারের সিরিজে যাওয়ায় দুই বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছিলেন না ডেরেক। এরপর ১৯৭৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ফেরেন। আর লয়েডের অধীনে মারে আরও একবার বিশ্বকাপ শিরোপা জেতেন।

১৯৮০ সালে শেষবারের মত ইংল্যান্ড সফরে যান মারে। ৩৭ বছর বয়সেও তিনি উইকেটের পেছনে ছিলেন দুর্দান্ত। পাঁচ টেস্টে ১৪ ক্যাচ শিকার করেন তিনি। এরপর আর তিনি সাদা পোশাকে খেলতে পারেননি। জেফ ডুজনের উত্থানে শেষ হয়ে যায় মারের ক্যারিয়ার। ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে মারে ম্যাচ অফিসিয়ালস হিসেবেও কিছু ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেন।

৬২ টেস্টে প্রায় ২৩ গড়ে করেছেন ১৯৯৩ রান। গ্লাভস হাতে ১৮১ ক্যাচ আর ৮টি স্টাম্পিং করেন এই উইকেটরক্ষক। অপরদিকে, ২৬ ওয়ানডেতে ২৪ গড়ে করেছেন মাত্র ২৯৪ রান। ওয়ানডেয়ে ৩৭ ক্যাচ আর একটি স্টাম্পিং করেন তিনি। রঙিন পোশাকে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি প্রায় ১৫ হাজার রানের মালিক।

ব্যাট হাতে ছিলেন সাদামাটা; বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস অবশ্য আছে। কিন্তু উইকেটের পেছনে তিনি নি:সন্দেহে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরাদের একজন। সত্তরের দশকে গ্লাভস হাতে তিনি ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা কান্ডারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link