‘আন্ডারডগ’ হয়েই খেলতে নেমেও পুরো বিশ্ব ফুটবলকে নিশ্চুপ করে দেওয়াটা নিশ্চয়ই রিয়াল মাদ্রিদের থেকে ভাল কেও জানে না। শৈল্পিক ফুটবল আর যাই হোক আপনাকে ট্রফির নিশ্চয়তা দেয় না। যারা ১৩ খানা ইউরোপ সেরার মুকুট নিজেদের করে রেখেছে তারা অবশ্য এ বিষয়ে সবচেয়ে ভাল করেই জানে। নিরপেক্ষ ভেন্যু হওয়ার কথা থাকলেও কেন জানি দেখে মনে হয়েছে অ্যানফিল্ডেই হচ্ছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল।
বিকেল থেকেই তো সেখানটায় লিভারপুল সমর্থকদের গান বাজনায় মুখোরিত সমগ্র স্টেডিয়াম পাড়া। রাজপথ যেন কৃষ্ণচূড়া। রক্তবর্ণে ছেয়ে গিয়েছিল পুরো প্যারিসের রাজপথ। ‘ইংলিশ চ্যানেল’ পাড়ি দিলেই তো ঘুচে যায় ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের দূরত্ব। সে মামুলি দূরত্ব পেরিয়ে লিভারপুল সমর্থকদের দখলে চলে যাবে পুরো স্টেড দে ফ্রান্স। প্রত্যাশার উলটো চিত্র ঘটেনি।
ফ্রান্সের জাতীয় স্টেডিয়ামের ৭০ ভাগ ছিল লিভারপুল সমর্থকদের দখলে। ম্যাচ শুরুর আগেও কতশত কাণ্ড মাঠের বাইরে। ভুয়া টিকিট দিয়ে লিভারপুল সমর্থকদের স্টেডিয়ামে প্রবেশ থেকে শুরু করে পুলিশের ‘পিপার স্পে’ ছোড়া। মাঠের ফুটবলটা শুরু হওয়ার আগেই একটা চাপা উত্তাপ বাতাসে মিশে ছেয়ে যায় পুরো প্যারিসের আকাশ-বাতাস। এরও বহু আগে থেকেই আগ্নেয়গিরির লাভায় পরিণত হয়েছিল সামাজিক যোগাযগ মাধ্যম।
লিভারপুল তো ছিল উজ্জীবিত প্রতিশোধের আগুনে। সে প্রতিশোধের আগুনে কী করে শুভ্র তুষার হয়ে ঝড়তে হয় তা আরও একবার দেখিয়ে দিল লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। হায়! কথার লড়াইয়ে যদি জেতা যেত মাঠের লড়াই! লিভারপুল সমর্থকরা সে চেষ্টাই করে গেছে পুরো নব্বইটা মিনিট। গলা ফাটিয়ে দুয়োধ্বনি দিয়ে গেছে, চিৎকার করে নিজ দলকে সমর্থন জুগিয়ে গেছে।
সে সব কি আর কানে নেয় থিবো কর্তোয়া? সে যেন হিমশীলত এক বরফের পাহাড়। হিমালয় কিংবা আন্টার্টিকা মহাসাগরের তলদেশের লুকিয়ে থাকা কোন এক দৃঢ়, মজবুত দেয়াল। সে দেয়াল ভেদ এ সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় মোহাম্মদ সালাহ যেমন পারেননি তেমনি পারেননি সাদিও মানে। অথচ লিভারপুলের আক্রমণ ভাগ এবারের মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ৯৪বার বল প্রতিপক্ষের জালে জড়িয়েছিল।
তবে এই যে থিবো কর্তোয়া যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালেই হঠাৎ কোন এক ধুমকেতু হয়ে সামনে চলে এলেন তা কিন্তু নয়। এই মৌসুমের রিয়ালের রক্ষণ ছিল বেশ নাজুক। বারেবারেই আক্রমণের লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে ঝড়ের দিনে উপকূলের মত। তবে আমাদের সুন্দরবন বনে গিয়েছিলেন কর্তোয়া, রিয়ালের হয়ে। পুরোটা মৌসুম তিনি নিজ সন্তান ভেবেই যেন আগলে রেখেছিলেন রিয়ালের জাল।
আর ফাইনালে তো তিনি ছিলেন অতিমানবীয়, দানবীয়, চীনের প্রাচীরসহ আর কত কি! কোন এক বিশেষণে তাকে ঠিক আর আটকে ফেলা যাচ্ছে না। তিনি দুর্দমনীয়! নয়খানা গোলমুখের শট তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। অন্য যেকোন দিনে মোহাম্মদ সালাহ কিংবা সাদিও মানের শটগুলো জালে ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার সম্ভবনা একশোতে একশো। থিবোর এমন অসাধারণ দিনে ক্যাসিমিরো যেন ফিরেছিলেন স্বরুপে।
বহুদিন বাদে যেন মাখনের মত মসৃণ ট্যাকেল উপহার দিলেন ‘ব্রাজিলিয়ান ট্যাঙ্ক’ খ্যাত ক্যাসিমিরো। তাকে পাশ কাটিয়ে বল নিয়ে যাওয়ার উপায় যেন ছিল না লুইস ডিয়াজ, থিয়াগো, কেইতা, হেন্ডারসনদের। তবে এদিন লিভারপুলের রক্ষণে দারুণ ছিলেন ইব্রাহিম কোনাতে। দীর্ঘকায় এই ডিফেন্ডার পুরো নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন মাদ্রিদের ক্ষুদে তারকা ভিনিসিয়াস জুনিয়রক।
তবে ধূর্ত, ক্ষীপ্র ভিনি জুনিয়র খুব ভাল করেই জানেন কি করে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হয়। প্রথম এক সুবর্ণ সুযোগ, প্রথম গোল অভিমুখে শট। ব্যাস ওই এক গোলের ব্যবধানে চৌদ্দতম শিরোপা। বাকি থাকা ত্রিশটা মিনিট যেন হৃদকম্পন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের। আক্রমণ কিন্তু থেমে থাকেনি। প্যারিস থেকে মাদ্রিদ, মাদ্রিদ থেকে এই ঢাকা, সেই ত্রিশ মিনিট যেন একই সুতোয় গেঁথে ছিল সকল মাদ্রিদ সমর্থকেরা।
উৎকণ্ঠার কি শেষ আছে! আর যাই হোক লিভারপুল তো বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা দল। তাদের আক্রমণ তো এই মৌসুমের অন্যতম সেরা। তাদের বিপক্ষে ১-০ গোলের ব্যবধান তো আর বেশি নয়। হাতের নখের অবস্থান তখন সামনের সাড়ির দন্তচাপে পিষতে ব্যস্ত। এই বুঝি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ! এই বুঝি ফুটবলের সৌন্দর্য!
হ্যা, মাঠের ফুটবলে পরিপাটি খেলা উপহার না দিলেও রিয়াল ঠিকই তাদের সমর্থকদের উপহার দিয়েছে আরও একটি শিরোপা। অথচ এই মৌসুম শুরুর আগেও কেউ যেন বিশ্বাসই করতে চাইতো না মাদ্রিদ জিতবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। কিন্তু এই যে প্রথম প্যারিস সেইন্ট জার্মেই, এরপর চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি শেষমেশ লিভারপুলকে হারিয়ে এই শিরোপা জয় নিশ্চিতরুপেই রিয়ালের ইতিহাসের একটা বড় অংশ জুড়েই থেকে যাবে।
নিন্দুকেরা হয়ত নিন্দায় মশগুল, তবে রিয়াল মাদ্রিদের ধ্যানে শুধুই শিরোপা!