ক্লাব ফুটবলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ইউরোপিয়ান ফুটবল। প্রথম সারির পাঁচটি লিগের দিকেই পুরো পৃথিবীর নজর সবচেয়ে বেশি। কেননা ক্লাব ফুটবলের যত ঐতিহ্যবাহী কিংবা সফলতম ক্লাবগুলো তো সে পাঁচটি লিগ থেকেই উঠে এসেছে। ইতালিয়ান সিরি-আ হোক কিংবা স্প্যানিশ লা-লিগা থেকে শুরু করে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, জার্মান বুন্দেসলিগা ও সবশেষে ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ান এই লিগগুলোই তো মাতিয়ে রাখা সারাটা বছর।
আরও একটি মৌসুমের অবসান ঘটেছে। মৌসুমের ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মঞ্চ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা চলে গিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদের ঘরে। ইউরোপা লিগ জিতেছে জার্মান ক্লাব এইনট্র্যাক্ট ফ্রাঙ্কফুর্ট আর কনফারেন্স লিগের বিজয়ী দল ইতালিয়ান ক্লাব এএস রোমা। এইতো গেল গোটা ইউরোপের খবর।
স্প্যানিশ লা লিগার চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ। অন্যদিকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতেছে ম্যানচেস্টার সিটি। জার্মান বুন্দেসলিগায় রীতিমত রাজত্ব করছে বায়ার্ন। ইতালিয়ান সিরি ‘এ’ তে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এসি মিলান। আর বরাবরের মত লিগ ওয়ানের চ্যাম্পিয়ন দল প্যারিস সেইন্ট জার্মেই।
শিরোপার লড়াই তো শেষ। তো এবার একটা ইউরোপ সেরা একাদশ নিশ্চয়ই বানানো যায়। সে প্রচেষ্টাই থাকছে আজকের আয়োজনে, গোল.কমের সৌজন্যে।
- থিবো কোর্তোয়া (রিয়াল মাদ্রিদ)- গোলরক্ষক
রিয়াল মাদ্রিদের রক্ষণ বেশ কয়েকবারই প্রবল প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে। তবে সকল প্রতিকূলতা যেন একা হাতেই সামলেছেন দলটি বেলজিয়ান গোলরক্ষক থিবো কর্তোয়া।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালের দিন নয় খানা গোলের সুযোগ নস্যাৎ করে দেন থিবো কর্তোয়া। তাছাড়া ঐ এক চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল নয়, পুরো মৌসুম জুড়েই তিনি ছিলেন অভেদ্য এক দেয়াল। প্রায় পঞ্চাশের বেশি গোল তিনি ঠেকিয়ে দিয়েছেন মৌসুমের আদ্যোপান্ত।
- ট্রেন্ট অ্যালেকজান্ডার আর্নল্ড (লিভারপুল)- রাইট ব্যাক
এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা রাইট ব্যাক কে? এমন প্রশ্নের জবাবে চোখ বন্ধ করে নিঃসন্দেহে যে কেউ বলে দেবে ট্রেন্ট অ্যালেকজান্ডার আর্নল্ডের নাম। রক্ষণ ও আক্রমণ দুই ক্ষেত্রেই সমানতালে অবদান রেখে যেতে পারেন আর্নল্ড।
সে কাজটাই তিনি করে গেছেন ১৯ খানা অ্যাসিস্ট রয়েছে তার নামের পাশে। এবারের ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগে কেবল টমাস মুলার ও কিলিয়ান এমবাপ্পের অ্যাসিস্টের সংখ্যা আর্নল্ডের থেকে বেশি।
- ভার্জিল ভ্যান ডাইক (লিভারপুল)- সেন্টার ব্যাক
দীর্ঘকায় এক রক্ষণ ভাগের খেলোয়াড় নেদারল্যান্ডের ভার্জিল ভ্যান ডাইক। লিভারপুল এবার দুই খানা শিরোপা জিতেছে। একটি এফএ কাপ আরেকটি কারাবো কাপ। দুইটি শিরোপা জয়ের পাশাপাশি ছিল প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা দৌড়েও।
আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রানার্সআপ হয়েছে অলরেডরা। লিভারপুলের এমন সাফল্যের পেছনের অন্যতম এক নাম এই ভার্জিল ভ্যান ডাইক। শঙ্কা ছিল হাটুর ইনজুরি কাটিয়ে তিনি স্বরুপে ফিরতে পারবেন কি না। তবে শঙ্কার অবসান ঘটিয়ে বিধ্বংসী পারফরমেন্স করে গেছেন তিনি।
- ডেভিড আলাবা (রিয়াল মাদ্রিদ)- সেন্টার ব্যাক
বায়ার্ন মিউনিখ থেকে এসেই সার্জিও রামোসের চার নম্বর জার্সিটা গায়ে জড়ান ডেভিড আলাবা। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশার চাপ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সে চাপ সামলে রক্ষণে দারুণভাবে সফল হয়েছেন ডেভিড আলাবা।
তিনি রিয়ালের রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি আক্রমণ সাজাতেও সহয়তা করে গেছেন মৌসুমের শেষ অবধি। মাদ্রিদ ক্যারিয়ারের প্রথম গোলটাও করেছিলেন তিনি এল ক্ল্যাসিকোর মঞ্চে। দুই শিরোপা জয়ে তিনি ছিলেন অন্যতম সেনানী।
- থিও হার্নান্দেজ (এসি মিলান)- লেফট ব্যাক
অ্যান্ডি রবার্টসন কিংবা জোয়াও ক্যানসেলোর নাম হয়ত অনেকেই প্রত্যাশা করছিলেন। তবে আজকের একাদশে তাদেরকে ছাপিয়ে গেছেন এসি মিলানের থিও হার্নান্দেজ।
প্রায় ১১ বছর বাদে থিওর কল্যাণেই এসি মিলান আবার স্কুট্টেডোর শিরোপা নিজেদের করতে পেরেছে। তাছাড়া এই মৌসুমে দশখানা অ্যাসিস্টের পাশাপাশি পাঁচ খানা গোলও করেছেন থিও। যার মধ্যে একটি ছিল অ্যাটলান্টার বিপক্ষে। নিজ রক্ষণ থেকে প্রতিপক্ষের রক্ষণ অবধি একাই বল টেনে নিয়ে গিয়ে তিনি গোল আদায় করে নিয়েছিলেন।
- রদ্রি (ম্যানচেস্টার সিটি)- ডিফেনসিভ মিডমিল্ডার
ম্যানচেস্টার সিটি বেশ একটা দুশ্চিন্তায় ছিল যে ফার্নান্দিনহোর পর ঠিক কে তার খালি জায়গাটা পূরণ করবে। সে দুশ্চিতার সমাধান হয়ে দৃশ্যপটে হাজির রদ্রি। সময়ের সাথে তিনি বনে গেছেন দলের একজন আস্থাভাজন ফুটবলার। তাছাড়া ক্রমাগত তিনি নিজের পরিবর্তন ঘটিয়ে সেরাদের কাতারে সামিল হতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগের মধ্যে রদ্রির থেকে কেউ বল কেড়ে নিতে কিংবা সফল পাস দিতে পারেনি। রদ্রি ৩৯৯ বার প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়েছেন, অন্যদিকে ৩৩৮২ বার সতীর্থদের বল বাড়িয়ে দিয়েছেন।
- মোহাম্মদ সালাহ (লিভারপুল)- রাইট উইং
এই সময়ে পারফরমেন্স আর সফলতার বিচারে অন্যতম সেরা রাইট উইঙ্গার হচ্ছেন মিশরের মোহাম্মদ সালাহ। এমনকি গোল ও অ্যাসিস্টের বিচারে তিনি প্রিমিয়ার লিগে সবার সেরা। তিনি ৩১ খানা গোল করার পাশাপাশি ১৬ খানা অ্যাসিস্ট করেছেন। তাছাড়া তার দৃষ্টিনন্দন একক প্রচেষ্টার গোলগুলো নিশ্চয়ই মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতই।
গতির সাথে নিজের বা-পায়ের উপর দারুণ দখল আর ফুটবলীয় সুদক্ষতা এসব মিলিয়ে ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’ মোহাম্মদ সালাহ। তিনি হয়ত খানিক আফসোসই করছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং প্রিমিয়ার লিগ হাত ছাড়া হওয়ায়।
- কেভিন ডি ব্রুইন (ম্যানচেস্টার সিটি)- অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আবার অধরাই থেকে গেল কেভিন ডি ব্রুইনের। তবে সে শিরোপা অধরা থাকলেও প্রিমিয়ার লিগের আরও একটি শিরোপা ছোঁয়া পেল এ সময়ের অন্যতম সেরা মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের। এই মৌসুমে তিনি সিটজেনদের হয়ে মৌসুমটা ভালই কেটেছে ব্রুইনের।
১৯ খানা গোলের বিপরীতে ১৪টি অ্যাসিস্টও রয়েছে তার নামের পাশে। তাছাড়া মৌসুম জুড়েই তিনি দূর্দান্ত পারফরম করে গেছেন। সিটির খেলার আক্রমণের প্রাণভোমরা ছিলেন তিনি বললে খুব একটা ভুল বলা হয় না।
- রাফায়েল লিয়াও (এসি মিলান)- লেফট উইং
তরুণ উদীয়মান খেলোয়াড় রাফায়েল লিয়াও এবারের মৌসুমে ছিলেন এসি মিলানের অন্যতম সেরা পারফরমার। প্রায় এগার বছর পর আবার লিগ শিরোপা জিতেছে এসি মিলান। তার কৃতীত্ব খানিকটা লিয়াও দাবি করতে পারেন।
অবশ্যই পারেন। কেননা তিনি লিগে ১১ গোল করেছেন, করিয়েছেন আরও ১০ খানা। তরুণ এই ফরোয়ার্ড যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই দলের জন্যে হাজির হয়ে নিজের সেরাটা নিঙড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। দারুণ সম্ভাবনাময় এই তরুণ তাই থাকছেন আজকের একাদশে।
- রবার্ট লেওয়ান্ডস্কি (বায়ার্ন মিউনিখ)- স্ট্রাইকার
৩৩ বছর বয়সে এসেও ইউরোপের বাজারে বেশ ভালই চাহিদা রয়েছে রবার্ট লেওয়ান্ডস্কির। থাকবেই বা না কেন? চলমান দুনিয়ায় তার মত আরও একজন স্ট্রাইকার খুঁজে পাওয়া তো রীতিমত যুদ্ধের সামিল। আর তাকে নিয়ে যুদ্ধ হওয়াটাও তো অত্যন্ত স্বাভাবিক।
তিনি এই মৌসুমেও সবধরণের টুর্নামেন্ট মিলে করেছেন ৫০ গোল। এমন একজন স্ট্রাইকারকে বাদ রেখে আসলে ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের একাদশ সাজানো বেশ দুষ্কর। গুঞ্জন আছে দল ছাড়বেন লেওয়ান্ডস্কি। নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে নিশ্চয়ই প্রস্তুত তিনি।
- করিম বেনজেমা (রিয়াল মাদ্রিদ)- স্ট্রাইকার
এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের সাফল্যের পেছনের অন্যতম চালিকা শক্তি ছিলেন করিম বেনজেমা। ফ্রেঞ্চ এই তারকা স্ট্রাইকার ছিলেন মাদ্রিদের আক্রমণের মধ্যমণি। তার উপর আস্থা রেখেছিল রিয়াল মাদ্রিদ কর্তা থেকে শুরু করে সমর্থকরা। আর সে আস্থার প্রতিদান তিনি দিয়েছেন।
মাদ্রিদের হয়ে ৪৪টি গোল করার পাশাপাশি আরও ১৫টি অ্যাসিস্ট করেছেন। তাছাড়া মাদ্রিদের প্রতিটা আক্রমণেই দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন বেনজেমা। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ গুলোতে তিনি বারংবার ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির হয়েছেন দৃশ্যপটে। আর ব্যালন ডি’অর জেতার অনেকটা এগিয়ে রয়েছেন তিনি।
এই একাদশের বাইরেও আরও অনেক খেলোয়াড় ছিলেন যারা কি না এই মৌসুমে ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে আলো ছড়িয়েছেন। বিশেষ করে লুকা মদ্রিচ, ক্রিস্টোফার এনকুনকু, বার্নাডো সিলভা ও অ্যালিসন বেকাররা যোগ্য দাবিদার ছিলেন এই একাদশে জায়গা পাওয়ার জন্যে। তবে প্রভাব বিচারে হয়ত তারা সুযোগ পেলেন না আজকের একাদশে।