বিশ্বকাঁপিয়ে নক্ষত্রের অকাল প্রস্থান

‘যাও তুমি দেখিয়ে দাও যে তুমি মেসির থেকেও সেরা।’ – এই কথাটি বলেছিলেন জার্মান কোচ জোয়াকিম লো। আর তিনি বলেছিলেন মারিও গোৎজে। আর্জেন্টিনার ভক্তদের কাছে নিশ্চয়ই এই নামটি খুব সুপরিচিত। কেননা লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখার স্বপ্নটা তো আট বছর পিছিয়ে দিয়েছিলেন এই গোৎজে।

২০১৪ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে যখন গোলশূণ্য সমতা। ঠিক তেমন এক মুহূর্তে নেমে মারিও গোৎজের এক দূর্দান্ত গোল গোটা স্টেডিয়ামের পাশাপাশি বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় দুই ভিন্ন সুর। একপ্রান্তে যখন আনন্দ ধ্বনি আরেক পাশে তখন বিষাদের করুণ সুর। একপক্ষ যখন আবার বিশ্বকাপ জয়ের উন্মাদনায় নিজেদের গা ভাসিয়ে দিতে প্রস্তুত তখন আরেক পক্ষ মুষরে গেছে কাছে গিয়ে বিশ্বকাপ ট্রফি ধরতে না পারের বেদনায়।

ঐ এক গোলের পার্থক্য গড়ে দেওয়া মারিও গোৎজের জন্ম তেসরা জুন ১৯৯২ সালে প্রফেসর বাবার ঘরে। জার্মানির চতুর্থ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক গোৎজের ক্যারিয়ারে শুরুটা হয়েছিল জার্মান ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে। ক্লাবটির অ্যাকাডেমির ছাত্র পরবর্তী সময়ে ক্লাবের হয়েই শুরু করেছিলেন নিজের পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার। ২০০৯ সালে বুন্দেসলীগায় খেলতে নামেন তিনি প্রথমবারের মত।

সে সময়ে ক্লাবটির কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ প্রতিভার ঝলক দেখতে পেয়েই তাকে সুযোগ দিয়েছিলেন মূল দলে। সেখান থেকে ধীর পায়ে এগোনো শুরু গোৎজের। একজন প্লে-মেকার হিসেবেই খেলেছিলেন তিনি নিজের ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময়ে। তবে মাঝেমধ্যে ‘ফলস নাইন’ রোলেও খেলতে দেখা যায় মারিও গোৎজেকে। প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় তরুণ হিসেবে জার্মান ফুটবল অঙ্গনে ক্রমশ নাম কুড়োতে থাকেন মারিও গোৎজে।

ভালই যাচ্ছিলো তার দিন শৈশবের ক্লাবে। এরপরই হঠাৎ করেই পরিবর্তনের হাওয়া লাগে তার গায়ে। আর সে পরিবর্তনে রীতিমত সরব হয় জার্মানি ফুটবল অঙ্গন। ২০১৩ সালে অর্থাৎ বিশ্বকাপের ঠিক আগের বছরেই রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি-তে তিনি যোগ দেন বুন্দেসলিগার সবচেয়ে সফল ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে। সেবার গোৎজের জন্যে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছিল ক্লাবটি।

এই খরচ অবশ্য গোৎজকে বানিয়ে দেয় জার্মানির সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়। তিনি প্রতিভাবান ছিলেন বলেই তার এত কদর। এত অর্থ খরচ তো একটা ক্লাব অযথাই করবে না। আর সে প্রত্যাশার প্রমাণও তিনি দিতে শুরু করেছিলেন বাভারিয়ানদের লাল জার্সিতে। তাদের একাদশে গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য হয়েই তিনি পরবর্তী সময়ে ডাক পেয়েছিলেন জোয়াকিম লো-র বিশ্বকাপ দলে।

আর তারপর তো তিনি বিশ্বজয়ে কারিগর। জার্মানিকে তিনি ভাসান চতুর্থবার বিশ্বজয়ের আনন্দে। তিনটে মৌসুম তিনি পার করেন অ্যালিয়েঞ্জ অ্যারেনাতে। তিন মৌসুমে ১১৪ খানা ম্যাচ মিলিয়ে তিনি কেবল ৩৬টি গোলই করতে পেরেছিলেন। তাই ক্রমশ জার্মান পরাশক্তিদের কাছে তার প্রয়োজন ফুরোতে শুরু করে। তাই তাকে কোন প্রকার অর্থকড়ি ছাড়াই ছেড়ে দেয় বায়ার্ন।

অন্যদিকে তার ঘরের ক্লাব, তার শৈশবের ক্লাব তাকে আপন করে নেয় আরও একটি বারের জন্য। ২০১৬-১৭ মৌসুমে তিনি আবার গায়ে জড়ান হলুদ জার্সি। তবে ভাগ্য তার হাটছিল ঠিক উলটো পথে। ২০১৭ সালের মার্চের শুরু দিকে গোৎজের ‘মেটাবলিজম ডিসঅর্ডার’ ধরা পড়ে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায় ‘মায়োপ্যাথি’ নামক এক রোগ বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। এই রোগে নাকি শরীরের পেশিগুলো ঠিক-ঠাক কাজ করে না।

সেটাই শুরু এই নক্ষত্র পতনের। কিংবা এরও আগে থেকেই তিনি মৃদু গতিতে হামাগুড়ি দিচ্ছিলেন সে পথে। সে সমস্যা নিয়ে তিনি আর ঠিক পারফরম করতে পারছিলেন না বড় মঞ্চে। আর জার্মান ফুটবলের মত গতিশীল ফুটবলের সাথে পেরেও উঠছিলেন না। তবুও তার শৈশবের ক্লাব তাকে সময় দিয়েছে, সুযোগ দিয়েছে। আরও চার মৌসুম তিনি ছিলেন বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে।

তবে নিজেকে যেন আর ফিরে পেলেন না। ততক্ষণে জাতীয় দল থেকে অনেকটা দূরেই সরে গিয়েছিলেন মারিও গোৎজে। তাকে জার্মানির মত দলে দেখার সুযোগ ফিকে হয়েছে সময়ের সাথে। জার্মানি ছেড়ে এরপর তিনি পাড়ি জমান নেদারল্যান্ডে। ডাচ ক্লাব পিএসভি এখন তার আবাসস্থল। ২০২০ এ তিনি সেখানে এসেছিলেন এবং নতুন চুক্তি অনুসারে ২০২৪ পর্যন্ত সেখানেই থাকছেন তিনি।

কিন্তু তার হয়ত কথা ছিল এখন ইউরোপিয়ান পরাশক্তি কোন ক্লাবের হয়ে মাঠ মাতানো। তার কথা ছিল জার্মানিকে আরও একটি বিশ্বকাপের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া। তার মধ্যে সে সম্ভাবনা তো সবাই দেখেছিল। তবে জীবনের হিসেবটা ঠিক মিললো না তার। বয়সটা ৩১ এখন। ৩৭ বছর বয়সেও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো দিব্যি খেলে যাচ্ছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। ওদিকে ৩৮ বছরের জলাতান ইব্রাহিমোভিচ ও ৩৬ বছর বয়সী লিওনেল মেসি নতুন করে শিরোপা জয়ের উল্লাসে মাতছেন।

সময় তো একেবারে শেষ হয়ে যায়নি মারিও গোৎজের। কোন এক অলৌকিকতায় তিনি নিশ্চয়ই খুঁজে পাবেন নিজের সে হারানো জৌলুস। এমনটাই হয়ত তিনি নিজেও প্রত্যাশা করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link