ব্র্যাডম্যানের পুনর্জন্ম

কাকডাকা ভোর। সূর্যকিরণ তখনও ঠিক ছুঁয়ে দেখেনি পিচঢালা রাস্তা। ছোট ভাই মুসির খান এবং বাবা নওশাদ খানকে নিয়ে ছুটে চলেছেন একজন। তাঁর বয়সের বাকিরা হয়ত তখন ঘুমোতে যাচ্ছিলেন। তবে তিনি ঘুম থেকে উঠে ছুটে গেলেন ক্রিকেট মাঠে। একজন সরফরাজ খান ঠিক এভাবেই গড়ে তুলছেন নিজেকে।

রঞ্জি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনালের আগেই তিনি তাঁর বাবা নওশাদ খান-কে ফোন করে বলেন, ‘বাবা আমি তো নেটে ঠিক মত অনুশীলন করতে পারছি না।’ সরফরাজের বাবাই তাঁর অভিভাবক, কোচ, মেন্টর সব। বাবার কাছ থেকেই সব ক্রিকেটের সমাধান খোঁজার চেষ্টা সরফরাজের। বাবার নিয়ম মেনে তিনি এখন সেরাদের একজন।

প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটে সরফরাজের এখন গড় ৮০.৪২। কেবলমাত্র স্যার ডন ব্রাডম্যানের গড় তাঁর থেকে খানিক বেশি। তবে এই রঞ্জি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনালের আগে বেশ এক সময় বিরতি ছিল। ঠিক ক্রিকেট থেকে নয়, দূরত্ব ছিল কেবল ফরম্যাটের। মাঝে বিরতিটা হয়েছিল আইপিএলের কারণে। এবারের আইপিএলে তিনি ছিলেন দিল্লি ক্যাপিটালসে।

মাত্র অল্প কিছুদিনের বিরতিতে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। সরফরাজ জীবনটা যেন ক্রিকেটের সাথে সম্পৃক্ত। কিংবা বলা যেতে পারে সরফরাজের জীবনটাই ক্রিকেট। তাইতো তিনি তাঁর বাড়ির বাইরে একটা কৃত্রিম পিচ বসিয়েছেন। সেখানটায় তিনি পেসারদের দ্রুত ছোড়া বল খেলার অনুশীলনটা করে থাকেন। তবে সে পিচটা স্বাভাবিক উইকেট থেকে খানিকটা ছোট।

১৮ গজের সে পিচের কারণে ঠিক তাঁর টাইমিংয়ের তারতম্য হচ্ছিল। তাই তিনি ঠিক নিজের স্বাভাবিক অনুশীলন করতে পারছিলেন না নেটে। কেননা কৃত্রিম উইকেটে বল খানিকটা দ্রুত আসে। তাছাড়া সেখানে বোলারও থাকে না। সেখানে ‘থোয়ার’ দিয়ে বল ছোড়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই বোলারের রানআপের সাথে সেখানটায় সময়ের একটু গড়মিল হবেই।

সেটাই হচ্ছিল। তিনি তাঁর অনুশীলনের ভিডিও করে পাঠান বাবাকে। বাবা নওশাদের চোখে আটকে যায় ছেলের সমস্যা। তিনি সে সমস্যার সমাধান বের করে জানান। মূলত সময়ের হেরফের। ছেলে সরফরাজ নিজের ভুলটা খুঁজে পান। পরে তাঁর সমাধান বের করেন। এর পরেই তিনি রঞ্জি ট্রফিতে মুম্বাইয়ের হয়ে ১৬৩ রান করেন। ফিরেই আবার চমক।

লাল বলের ক্রিকেটটা যেন তাঁর খুব প্রিয়। সাদা পোশাকটাই যেন তাঁর শরীরের আবরণ। তিনি ক্রিকেটকে ভালবাসেন বলেই প্রতিদিন অনুশীলনে কম করে হলেও আটশ’র আশেপাশে বল খেলার চেষ্টা করেন। স্কুল ক্রিকেটের শচীনের রেকর্ড ভাঙ্গতে বোধকরি সেজন্যেই পেরেছিলেন সরফরাজ। ৪৩৯ রান করেছিলেন সরফরাজ। সম্ভাবনা তাঁর মধ্যে ছিল কি না সেটা বলার উপায় নেই।

তবে তিনি সর্বদাই ছিলেন একজন পরশ্রমী ক্রিকেটার। মূলত তাঁর বাবাই দিকনির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে। এখনও দিয়ে যাচ্ছেন। হাজার ম্যাচ থাকা সত্ত্বেও তিনি সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে রাতের খাবার সেড়ে ফেলেন। এরপর ন’টা নাগাদ ঘুমোতে চলে যান। কোন কিছুতেই যেন এর ব্যতিক্রম ঘটে না। মাঝে তিনি ফিটনেসের ঘাটতি অনুভব করেন। তাঁর মনে হয় রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার কারণটাই ছিল ফিটনেস।

এরপর হাঁটুর পেশির ইনজুরি। তিনি পিছিয়ে পড়ছিলেন ক্রিকেট থেকে। তবে পরিশ্রম আর একাগ্রতা আর বাবা নওশাদের মত একজন দিকনির্দেশক তাঁকে কক্ষচ্যুত হতে দেননি। তিনি ফিরে আসেন, তিনি ফিরে এসে পারফরম করেন নতুন উদ্যমে। এসেই তিনি গত পাঁচ প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটে তিনটি শতক তুলে নিয়েছেন।

তিনি নিজের মধ্যে সে ক্ষুধাটার জন্ম দিয়েছেন। তিনি আর ৬০ কিংবা ৭০ রানের ইনিংসে সন্তুষ্ট নন। এই ক্ষুধা তাকে ক্রমশ হিংস্র বাঘে পরিণত করছেন। যে বাঘ শুধু মাত্র বোলারদের শিকার করে রান সংগ্রহ করেন। এমন হিংস্র বাঘেদেরই বোধহয় বিশ্ব ক্রিকেটে বড্ড প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link