যুদ্ধক্ষেত্র, যেকোন ক্রীড়াঙ্গনই এখন পরিণত হয়েছে একেকটি যুদ্ধেক্ষেত্রে। এই লড়াইয়ে ঢাল-তলোয়ার থাকে না। এই যুদ্ধে থাকে না কামান কিংবা গোলা। এখানে যুদ্ধটা হয় প্রতিভা আর পরিকল্পনার। মাঝে-সাঝে ভাগ্যের। ক্রিকেটও এর বাইরে নয়। তবে দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটার এবি ডি ভিলিয়ার্স যুদ্ধক্ষেত্রকে বানিয়ে ফেলতেন এক অপূর্ব অসাধারণ চিত্রশিল্প।
আক্ষেপ হয়। হওয়াটাও যেন বেশ স্বাভাবিক। একটা প্রজন্মের জন্যে রোল মডেল তো ছিলেন তিনি। একটা প্রজন্মের বিনোদনের সব খোরাক তো মিটিয়েছেন ভিলিয়ার্স। সে ভিলিয়ার্স এখন আর নামেন না ব্যাট হাতে। তিনি এখন ক্রিকেট থেকে অনেকটা দূরে।
দূরত্ব যেন বেড়ে হয়েছে এক আলোকবর্ষ। কিন্তু তবুও কি ডি ভিলিয়ার্সের সে চোখ ধাঁধানো ব্যাটিং শিল্প চাইলেই স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা যায়? যায় না! তিনি তো ছিলেন ঝর্ণার বহমান জল। যে পাত্রেই পড়ুক তিনি আকার ধারণ করতে অন্তত সময় নেননি এক বিন্দু। বরং তিনি মুহূর্তেই ছড়িয়েছেন মুগ্ধতা।
একরাশ জলরাশির মাঝে শুয়ে থেকে জোছনা উদযাপনের মতই সুন্দর তাঁর ব্যাটিং। এবি ডি ভিলিয়ার্সকে নিয়ে আসলে লিখতে গেলে শব্দের সংকট হওয়া যেন অবধারিত। এই যেমন রুপক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন একজন ব্যাটারকে ঠিক শেষ কবে পেয়েছিল ক্রিকেট? এই উত্তর দেওয়াটাও বড্ড কঠিন।
প্রতিটা ব্যাটার নিজেদের আলাদা সত্ত্বা দিয়ে আলোকিত করে গেছেন। কেউ ছিলেন মারকুটে, কেউ করেছেন ব্যাকরণ মেনে দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং। কেউ আবার ছিলেন ভীষণরকম কুৎসিত, তবে কার্যকরি। তবে এসবকিছুই যেন নিজের মধ্যে ধারণ করতেন এবি ডি ভিলিয়ার্স।
শুধু ক্রিকেটের ব্যাকরণে সীমাবদ্ধ থাকেন নি। তিনি আবিষ্কার করেছেন। তিনি সেটা মাঠের ক্রিকেটে করেও দেখিয়েছেন। ভয় বলে কোন শব্দ বোধহয় ভিলিয়ার্সের নিজস্ব অভিধানে ছিল না। আরেকটা বিষয় হতে পারে। তিনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। না অতিরিক্ত নয়। হতেও পারে, তবে সেটার একটা নিয়ন্ত্রণ সুইচ তাঁর হাতে ছিল নিশ্চয়ই।
তিনি যেন ক্রিকেটের চিন্তাধারায় একটা আমুল পরিবর্তনই এনে দিয়েছেন। তিনি আবার ব্যাটারদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, ব্যাটটা চালাতে জানতে হয় তবে তা সময় বুঝে। ভিলিয়ার্স ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন পারতেন বাইশ গজে। বোলারদের শত ঘাত-প্রতিঘাত উপেক্ষা করে শুধুমাত্র একটা হার এড়াবেন বলে।
নিশ্চিত হারা টেস্ট ম্যাচের গতিপথ নিজে টেনে নিয়ে যেতে পারতেন ড্র-য়ের দিকে। সে জন্যে তিনি কোনরকম ঝুকি না নিয়ে বলের পর বল, সেশনের পর সেশন খেলে যেতে পারতেন। আবার সেই ডি ভিলিয়ার্স যেন ‘টর্নেডো’। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিতে যেন তিনি পরোয়া করেন না কারো। ক্রিকেটটা যে দুই ক্ষেত্রেই সুন্দর।
এই দুই ধরণের ব্যাটিংই যে উপভোগ্য সেটাই দেখিয়ে গেছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স। যেমন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’ আমাদেরকে মুগ্ধ করে, ভাবতে বাধ্য করে। ঠিক তেমনই একটা কিছুর ছাপ ফেলে দিয়ে গেছেন ভিলিয়ার্স। আমরা ঠিক এখনও তাকে নিয়ে ভাবি। তাঁর ব্যাটিং নিয়ে ভাবি। তিনি ঠিক কি করে হলেন এমন দুর্ধর্ষ ব্যাটার!
থাকুক, বিস্ময় থাকুক। তিনিও থাকুক আমাদের মনে। আফসোসটা দীর্ঘায়িত হোক, কেন আরো লম্বা সময়, কেন অনন্তকাল তিনি রইলেন না বাইশ গজে – এই আক্ষেপ করেই জীবনটা কাটিয়ে দেই। আক্ষেপের সাথেই হোক সন্ধি।