অলিভার কান, দ্য টাইটান

২০০২ বিশ্বকাপের কথা, রোনালদো-রিভালদোরা তখন গোল করে ফাইনালে নিয়ে এসেছিলেন ব্রাজিলকে। অন্যদিকে জার্মানিকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের গোলরক্ষক। প্রতিপক্ষের গোল ঠেকিয়ে। ম্যাচের পর ম্যাচ গোল ঠেকিয়েই ২০০২ বিশ্বকাপে দলকে সাফল্য এনে দিয়েছিলেন তিনি। সেই বিশ্বকাপে জিতেছিলেন ‘গোল্ডেন গ্লাভস’।

সেখানেই শেষ না। সেবারের আসরের গোল্ডেন বলটা উঠেছিল তাঁর হাতে। তাঁর অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের সামনে গোল্ডেল বলটাও যেন বড্ড ফিঁকে। এখন পর্যন্ত আর কোন গোলরক্ষক পারেননি বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল জিততে। অনন্য কীর্তির অধিকারী এই জার্মান গোলরক্ষক ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বেশ পরিচিত – তাঁর নাম অলিভার কান।

আগের দুই বিশ্বকাপে স্রেফ ‘ডাগ-আউট’ গরম করার পর ২০০২ সালে বিশ্বকাপ অভিষেক হয় কানের। সেবার দলের আর্মব্যান্ড ছিল তাঁর হাতেই। অধিনায়ক হিসেবে মাঠে একেবারে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কান। কাগজে-কলমে দুর্বল জার্মান দলের ওপর বিশ্বকাপে খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল না কারও।

কিন্তু গোলবারে চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অলিভার কান। প্রতিপক্ষের পাঠানো বল ঢুকে জার্মান জালের দেখা পাবে কীভাবে! গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচের ইনজুরি সময়ে জার্মানির বিপক্ষে একটি গোল করেছিলেন আয়ারল্যান্ডের রবি কিন। এরপর ফাইনাল পর্যন্ত টানা চার ম্যাচে কান নামক দেয়ালে চিড় ধরাতে পারেনি কোনো দল।

অবশ্য ফাইনালে দুর্ভাগ্য ছুঁয়ে যায় জার্মানিকে। সেই ম্যাচে দলীয় অধিনায়ক অলিভার কানকে খেলতে হয়েছিল ডান হাতের অনামিকায় চিড় নিয়েই।  খেসারতও দিতে হয়েছে, এক ম্যাচেই দুইবার জার্মানির জালে বল জড়িয়েছিলেন রোনালদো লিমা। তবে পুরো টুর্নামেন্টের বীরত্ব তাতে মিথ্যা হয়ে যায়নি। গোল্ডেন গ্লাভসের পাশাপাশি তাই গোল্ডেন বলও হাতে উঠেছিল কানের।

অলিভার কান ১৯৬৯ সালের ১৫ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জার্মানির (তৎকালীন পশ্চিম জার্মানী) কার্লসরুহ শহরের সকাল টা সেদিন বোধহয় একটু বেশি ঝকঝকে ছিল, কেননা সেদিন পৃথিবী আলোকিত করে জন্ম হয়েছিল  ছোট্ট এক শিশুর, যে তার দু’হাতের কারিশমায় মাতিয়ে রেখেছিল পুরো একটি ফুটবল বিশ্বকে।

ক্রিকেট নিষিদ্ধ হওয়ায় তখন জার্মানি ছিল ফুটবলার তৈরির চারণভূমি। তাই কানের বাবা-মা সন্তানকে ফুটবলের বিদ্যে দিতে দেরি করেন। মাত্র তিন বছর বয়সেই ফুটবলে হাতেখড়ি হয় অলিভার কানের। প্রতিভার ঝলক আর ফুটবলের প্রতি অগাধ ভালবাসার কারণে মাত্র ছয় বছর বয়সেই স্থানীয় ক্লাব ‘কার্লসরুহ সকার ক্লাব’ তাদের একাডেমিতে ভর্তি করে নেয় জার্মান বালককে।

প্রথমে অবশ্য একজন মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেছিলেন অলিভার। কিন্তু একদিন ম্যাচ চলাকালীন দলের গোলরক্ষক ইনজুরিতে পড়ায়, কানকে দাঁড়াতে হয়েছিল গোলবারের সামনে। সেই ম্যাচে অসাধারণ পারফর্ম করেন কান। বেশ কয়েকবার কিছু নিশ্চিত গোলও বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

তারপর থেকে গোলরক্ষণের দায়িত্ব আসে কানের উপর, আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হয় নি তাকে। মজা করে বলাই যায়, সেদিনের সেই গোলকিপার ইনজুরি হয়তো বিধাতার আশীর্বাদ স্বরূপ এসেছিল। কেননা, সেসময় গোলরক্ষক অলিভার কানের দেখা না পেলে হয়তো তাঁর গ্লাভসের জাদু থেকে বঞ্চিত হত ফুটবলপ্রেমীরা।

১৯৭৫ থেকে ১৯৮৭ সাল, দীর্ঘ এক যুগ কার্লসরুহ ইয়ুথ টিমের সদস্য ছিলেন অলিভার কান। এরপর ১৯৮৭-৮৮ সিজনে প্রথমবারের মত মূল-দলে ডাক পান তিনি। তবে তিনি ‘কার্লসরুহ এসসি’ দলের ব্যাক-আপ গোলকরক্ষক হিসেবেই ছিলেন।

অবশ্য মূল গোলরক্ষকের বিশ্রামের অজুহাতে ১৯৮৭ সালের ২৭ নভেম্বর অভিষেক হয়ে যায় কানের। অভিষেক ম্যাচে দলের জয়ের পাশাপাশি ক্লিনশিট রাখেন কান। কিন্তু দুর্দান্ত ফর্মে থাকা দলের মূল গোলকিপার আলেক্সন্ড্রা ফর্মুলার কারণে নিয়মিত হতে পারেননি অলিভার।

দুই বছর অপেক্ষার পরে শেষ পর্যন্ত আসে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। ১৯৯০ সালে অলিভার কান মূল একাদশে একেবারে অধিনায়ক হিসেবে জায়গা পান। সেবার পুরো মৌসুমেই দুর্দান্ত ছিলেন কান। এরপর টানা চার বছর শৈশবের ক্লাবটিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

এসময় এই হীরের খবর ছড়িয়ে পড়ে জার্মানি সহ পুরো ফুটবল বিশ্বে। ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমের সময় তৎকালীন রেকর্ড ৪.৬ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ দলে ভেড়ায় অলিভার কানকে।

বায়ার্নে এসে নিজের জাত চেনাতে ভুল করেন নি কান। তাইতো প্রথম মৌসুমেই জিতে নেন সেরা গোলকিপারের মুকুট। অবশ্য নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরলেও বায়ার্নের হয়ে প্রথম শিরোপা জিততে সময় লাগে দুই বছর। ১৯৯৬ সালে উয়েফা কাপ এর শিরোপা জিতে শেষ হয় কানের শিরোপা খরা। ওই বছরই কান তাঁর দুর্দান্ত গোল কিপিং দিয়ে তাঁর দলকে জেতান বুন্দেসলিগা। পাশাপাশি লিগের সেরা গোলরক্ষকের পুরুষ্কারও নিজের করে নেন।

ঘরোয়া লিগ জিতলেও ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ পাওয়া বাকি ছিল অলিভার কানের জন্য। সেটারই একটা সুযোগ এসেছিল ১৯৯৯ সালের ফাইনালে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে সেদিন এগিয়েও ছিল জার্মান ক্লাবটি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পরপর দুই গোল করে একেবারে তাদের হাত থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নেয় রেড ডেভিলরা।

সেই আক্ষেপ পূরণেও কালক্ষেপণ করেননি অলিভার কান। ২০০১ সালে আবারও পৌঁছে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। এবার প্রতিপক্ষ ভ্যালেন্সিয়াকে টাইব্রেকারে রুখে দিয়ে দলকে শিরোপা উদযাপনের মঞ্চে তুলে আনেন অলিভার কান।  সেদিন কানে মুগ্ধ হয়েছিল লাখো জার্মানবাসী।

সবমিলিয়ে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে আটটি বুন্দেসলিগা, ছয়টি ডিএফবি পোকাল, ছয়টি ডিএফবি লিগা পোকাল, একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, একটি ইউয়েফা কাপ, একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জিতেছেন অলিভার কান। অনেকবারই জিতেছেন লিগের সেরা গোলরক্ষকের পুরুষ্কার।

১ মে ২০০৮, বায়ার্ন মিউনিখের জার্সি গায়ে ইউরোপিয়ান কম্পিটিশনে শেষ ম্যাচটি খেলেছিলেন কান, একই মাসের ১৭ তারিখে বুন্দেসলিগার শেষ ম্যাচটিও খেলেন এই কিংবদন্তি। ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ একটি ‘ফেয়ারওয়েল’ ম্যাচ খেলে শেষ পর্যন্ত নিজের গ্লাভস জোড়াকে পুরোপুরি বিশ্রাম দেন অলিভার। বর্তমানে বায়ার্ন মিউনিখেরই চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন এই তারকা।

জার্মানির জার্সি গায়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে আসলে কতটা সফল হয়েছেন সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কেননা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অলিভার পরিপূর্ণ সুযোগই পাননি বলতে গেলে। বিশেষ করে ১৯৯৪ এবং ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ তাকে বেঞ্চে বসে দেখতে হয়েছে। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে তো এক সুযোগেই বাজিমাত করেছিলেন, কিন্তু ২০০৬ সালে আবার বয়সের কাছে হেরে গিয়ে বসে থাকতে হয়েছিল সাইড বেঞ্চে।

২০০৬ বিশ্বকাপ শেষেই ইতি টানেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের। শেষ হয় কানের জার্মান অধ্যায়। এই কিংবদন্তি মোট ৮৬ ম্যাচ খেলেছিলেন জার্মানির জার্সি গায়ে, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৪৯ ম্যাচ। দলকে বিশ্বকাপ জেতাতে না পারলেও ২০০২ বিশ্বকাপে হয়েছিলেন রানার-আপ। আর ২০০৬ এর তৃতীয় স্থান অর্জন করে জার্মান দলের সদস্য ছিলেন তিনি।

অলিভার কানের কোন একটা দিক আলাদা করার মত নেই। বলতে গেলে সব দিক দিয়েই ফুটবল ইতিহাসের সেরা গোলকিপারদের একজন এই জার্মান। অসম্ভব ‘গোলকিপিং’ দক্ষতায় বারবার হতাশ করেছিলেন বিশ্বের সব সেরা সেরা স্ট্রাইকারদের। কানের সামনে শূন্যহাতে ফিরতে হয়েছিল অনেক বড় দলকেও। ভক্তরা ভালবেসে তাকে নাম দিয়েছিল ‘দ্য টাইটান’, কেউ আবার ডাকতো ‘কিং কান’ নামে।

ফুটবলের যেকোনো গোলরক্ষকের জন্য আদর্শ নাম অলিভার কান। সেরা গোলকিপারদের নিয়ে কোন বই যদি লিখা হয়, অলিভার কানকে সে-বইয়ের প্রচ্ছদে রাখতে বাধ্য হবেন যে কেউ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link