২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের সাথে বাকবিতণ্ডা, কথা চালাচালি চললো খানিকটা সময়। ব্যাট হাতে ক্ষোভে ফুঁসছিলেন ভারতীয় তারকা যুবরাজ সিং। সেই ক্ষোভটা পরের ওভারে ঝেড়েছিলেন তরুণ এক পেসারের উপর।
এক ওভারে পর পর ছয় বলে ছয় ছক্কা! ব্যাট হাতে সেদিন তাণ্ডব চালিয়ে ফ্লিনটফকে দাঁত ভাঙা জবাব দেন যুবরাজ। সেদিন যেন বলির পাঠা হয়েছিল তরুণ স্টুয়ার্ট ব্রড। ফ্লিনটফের সাথে কথা কাটাকাটির পরের ওভারেই ব্রডের উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালান যুবরাজ।
পর পর ৬ বলে ছয় ছক্কা হাঁকিয়ে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ছয় ছক্কার রেকর্ডে নাম লেখান। সেদিন যুবরাজের তাণ্ডবের সামনে ছয় ছক্কা হজমের লজ্জার রেকর্ডে নাম তুলেছিলেন ব্রড।
হয়তো সেদিন-ই ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন ২১ বছর বয়সী এই তরুণ পেসার। ক্যারিয়ার শুরু না হতেই যেন শেষ হবার উপক্রম। হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলেন। কিন্তু, সেদিন মনে মনে যেন পণ করে ফেললেন, ২২ গজে ত্রাশ করবেন।
মনের জেদটা পুষে রাখলেন। সেখান থেকে রচিত হয়েছিল ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন গল্প। লজ্জার রেকর্ড থেকে নামটা মুছে দিতে পারেননি ব্রড। কিন্তু, নিজের সামর্থ্যের সেরাটা দিয়ে তিনি ছুঁটছেন অনন্য এক মাইলফলকের দিকে।
জন্ম ১৯৮৬ সালের ২৪ জুন। এদিনেই পৃথিবীর বুক আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা আর্জেন্টাইন জাদুকর লিওনেল মেসি। উচ্চতার কারণে বাউন্সটা স্বভাবগত ভাবেই একটু বেশি পান ব্রড। সাথে নতুন বলে দুর্দান্ত ইনস্যুইং ব্রডের সেরা অস্ত্র।
ছয় বছর বয়স থেকে বাগানে ব্যাট হাতে ক্রিকেট খেলা শুরু। স্কুলের হয়ে ক্রিকেট দলে খেলতেন। সেখান থেকে পরবর্তীতে পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে যোগ দেন লিস্টারশায়ারে। এরপর সেখান থেকে সাময়িক সময় পর আবার স্থানান্তর হন ন্যটিংহামশায়ারে।
এই ন্যটিংহামেই জন্মেছিলেন তিনি। জন্মভূমির হয়ে খেলার ইচ্ছেও ছিল শুরু থেকেই। তবে, ন্যটিংহামের প্রতি মায়া জন্মাবার আরেকটা বিশেষ কারণ আছে ব্রডের। ন্যটিংহামের হয়েই খেলেছিলেন বাবা ক্রিস ব্রড। ক্রিস ইংল্যান্ড ক্রিকেটের বেশ পরিচিত এক নাম।
২০০৫ সালে ১৮ বছর পর অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে অ্যাশেজ ট্রফি জয় করে ইংলিশরা। সেই যে ৮৭ সালে জয় পেয়েছিল ইংল্যান্ড, এরপর ১৮ বছর ক্রিকেট বিশ্বের পরাশক্তি অজিদের বিপক্ষে অ্যাশেজে বার বার ধরাশায়ী হচ্ছিল ইংলিশরা। সেই ১৯৮৭ সালের অ্যাশেজ জয়ের নায়কটা ছিলেন ইংলিশ ওপেনার ক্রিস ব্রড।
ক্রিসের সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারটা ধ্বংস হয়ে যায় অল্পতেই। এর পেছনে কারণ হিসেবে অনেকেই বলেছেন ক্রিস নিজেই এর জন্য দায়ী। ক্রিজে নিজের রাগ, মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় না-কি মাত্র ৩০ বছর বয়সেই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় ক্রিসের।
বাবার মত ছেলের অবশ্য এত মেজাজ নেই। পেসারদের কাছে আগ্রাসন ব্যাপারটা বেশ স্বাভাবিক আর নিতান্তই সাধারণ ব্যাপার।
ব্রডের নামকরণেও লুকিয়ে আছে অজানা আর অবাক করা তথ্য। ব্রডের পুরো নাম স্টুয়ার্ট ক্রিস্টোফার জন ব্রড। নামের মধ্যে জন শব্দটা রাখা হয় এক ডাক্তারের নামানুসারে। সম্ভাব্য সময়ের ১২ সপ্তাহ আগেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন ব্রড। ছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ঈশ্বরের কৃপা আর ডাক্তার জনের পারদর্শীতায় সেদিন বেঁচে যান ব্রড। এরপর ডাক্তার জনের নাম থেকেই ব্রডের নামে জুড়ে দেওয়া হয় জন।
২০০৫ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে অনূর্ধ্ব- ১৯ দলে সুযোগ পান। এরপর সেখান থেকে ইংল্যান্ড এ দলে ডাক পান। সে সময় ব্রড ছিলেন ইংল্যান্ডের ভবিষ্যত সম্ভাবনাময় এক তারকা। অবশ্য এই ভবিষ্যদ্বাণীটা মিথ্যে ছিল না। ব্রড জাতীয় দলের জার্সি গায়ে সেটি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন শ’য়ে শ”য়ে উইকেট শিকার করে।
২০০৬ সালে রঙিন পোশাকে ও ২০০৭ সালে টেস্ট দলে অভিষেক। রঙিন পোশাকের জার্নিটা খুব বেশি সময়ের না। টি-টোয়েন্টি থেমে গেছে অল্পতে। ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংলিশদের ভরাডুবির পর বেশ দ্রুতই দল থেকে বাদ পড়েন দুই অভিজ্ঞ তারকা জেমস অ্যান্ডারসন ও স্টুয়ার্ট ব্রড।
২০১১ সালে ঘরের মাঠ ন্যটিংহামে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে হ্যাটট্রিক উইকেট শিকারের কীর্তি গড়েন ব্রড। মাত্র ৪৬ ৬ উইকেট শিকার করেন তিনি। পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৭২ রানে ক্যারিয়ার সেরা ৭ উইকেট নেন এই পেসার। নিজের সেই সেরা ফিগারটা ভেঙে নতুন ফিগার গড়েন আরও বছর চারেক পর অজিদের বিপক্ষে।
২০১৫ অ্যাশেজে ন্যটিংহাম টেস্ট। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে অজিদের ব্যাটিং লাইনআপ। একের পর এক উইকেট নিজের ঝুলিতে পুরছিলেন ব্রড। বিধ্বংসী এক স্পেলে ওই টেস্ট জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। ব্রডের ধ্বংসাত্মক বোলিংয়ে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৬০ রানেই গুড়িয়ে যায় অজিরা। মাত্র ১৫ রানে ক্যারিয়ার সেরা ৮ উইকেট শিকার করেন এই পেসার।
ব্যাট হাতেও দলের হয়ে বেশ অবদান রেখেছেন তিনি। ২০১০ সালে ব্যাট হাতে রীতিমতো বিস্ময়কর এক ইনিংস খেলেছিলেন ব্রড। পাকিস্তানের বিপক্ষে লন্ডনে নয় নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ১৬৯ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলেন এই ইংলিশ তারকা। ওই ইনিংসে চার ইংলিশ ব্যাটার ফিরেছিলেন শূন্য রানে; এই তালিকায় ছিলেন কেভিন পিটারসেন, পল কলিংউড, ইয়ন মরগ্যানরাও।
টেস্ট ইতিহাসের ষষ্ঠ ও পেসার হিসবে তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি তিনি। সেই সাথে ব্যাট হাতে আট ও নয় নম্বরে টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের মালিকও তিনি। রঙিন পোশাকে ওয়ানডেতে তিনি ইংল্যান্ডের তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি।
পেশাদার ক্রিকেটার হবার আগে কৈশোরে গোলরক্ষক হিসেবে হকি দলে খেলতেন তিনি। এমনকি ইংল্যান্ড জাতীয় হকি দলের হয়ে খেলার জন্য ট্রায়ালও দিয়েছিলেন এই ইংলিশ পেসার। ভাগ্যিস, হকিতে না গিয়ে ক্রিকেটেই থিতু হয়েছিলেন, তাই তো আমরা চোখের সামনে অনবদ্য এক ফাস্ট বোলারের দেখা পেয়েছি।